কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

অপরাহ্ণ সুসমিতো

 

সমকালীন ছোটগল্প




বিকালটা আটকে থাকুক


রণিমা নাচের ক্লাস শেষ করে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে নামে। দেরি হয়ে গেছে। নাচের ক্লাস শেষ করে প্রতিটি বাচ্চার সাথে হাগ করতে করতে দেরি হয়ে যায়। সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে গাড়ির চাবি ক্লাসে ফেলে এসেছে। আবার দৌড়ে যায়।

আবার সিঁড়ি। তাড়াহুড়োতে আচানক গোড়ালিতে ব্যথা পায়। বেকায়দায় স্টেপ পড়েছে। কঁকিয়ে উঠল। ভাগ্যিস বড় আকারের কিছু না। মহা ঝামেলা হয়ে যেত। বাসার সামনে তার সোনার টুকরাটা আজ অপেক্ষা করবে। আজ শনিবার।

শহর থেকে কোভিড বাধানিষেধ উঠে যাচ্ছে ক্রমে। শিথিল হচ্ছে নিয়মকানুন। বিকেল ভরা জুনের রোদ। গাড়িতে উঠেই রণিমার ভালো লাগাটা একবাক্স চকলেটের মতো প্রসারিত হলো। সে রোদচশমা পরে নিলো, সাথে সাথে ওকে কপি করে যেন শহরের স্থাবর অস্থাবর রোদও।

বাসার সামনে আসতেই অনুভব করতে পারে তার সোনার টুকরাটা দাঁড়িয়ে আছে। এই ক’বছরে লম্বা হয়েছে বেশ। একটু কি শুকিয়েছে? এ রকম হয়। এ বয়সে হয়। এই তো সামনের আগস্টের ১৯ তারিখ ১৪ হবে। টিন টিন বালকটা।

সময় যেন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতো। লাফ দেয় লাফিয়ে ছোটে ধাবমান ক্ষিপ্রের মতো। গাড়িটা কোনোরকম পার্ক করেই দ্রুত নামে গাড়ি থেকে। আবার গোড়ালির ব্যথাটা জানান দেয় তার সীমিত অস্তিত্ব। রণিমা আজ ছোটখাটো ব্যথাকে আমলে নেবে না। দৌড়ে যায় তার সোনার টুকরা চৌদ্দ’র দিকে। মুহূর্তে জাপটে ধরে ছেলেকে।

এই বয়সী ছেলেরা রাস্তাঘাটে মায়ের এরকম জড়িয়ে ধরা-টরা পছন্দ করে না। বিব্রত হয়। ক্ষীণ কণ্ঠে বলে;

: মামান স্টপ ইট… ছাড়ো!

মা ছেলের কথাটাকে পাত্তা দেয় না। বাসার দরজা খোলে, ছেলেটাকে প্রায় জড়িয়েই রাখে। আজ শনিবার আজ রণিমার দিন। আজ ছেলেটা সারাদিন মায়ের সাথে থাকবে। রণিমা ই-মেইলের গতিতে বাসার কয়েকটা জানালা খুলে দেয়। ডাবের পানির মতো মিষ্টি বাতাস ছড়িয়ে পড়ে। ছেলেটাকে প্রায় টেনে আনে রান্নাঘরে।

: তুই এই চেয়ারটায় বসে থাক। গেম খেল। আমি হালিম রেডি করি।

ছেলের পছন্দ হালিম সাথে মুচমুচে পরোটা। কাল রাতেই কাজ থেকে ফিরে রণিমা অনেক কাজ এগিয়ে রেখেছে। সে জানে শনিবার সকালে তাকে নাচের ক্লাস নিতে হয়, তারপর ছেলের সাথে সারাটা শনিবার ভুবন। ছেলেটা মোবাইল থেকে  মনোযোগ সরিয়ে পরোটা হালিম খেতে শুরু করে দ্রুত। মা গভীর তাকিয়ে থাকে সেদিকে। হয়ত ছেলের অনেক খিদে। বাবার সাথে না জানি কী সব হাবিজাবি খায়।

: তোকে তোর বাবা রান্না করে খাওয়ায়?

: সামটাইমস..
: কি রাঁধে?

ছেলে জবাব দেয় না। ও বাম হাতে চামচ তুলে তুলে হালিম খায়, ডান হাতে মোবাইল টেপাটিপি করে এখন। মা মুগ্ধ হয়ে ছেলের খাওয়া দেখতে থাকে। কী যত্ন করে খাচ্ছে! মৃদু ধমক দেয় ছেলেকে;

: খাবার সময় ফোন কেন? রাখো। আগে খাও তো…

ছেলে ঠাণ্ডা গলায় বলল;

: মামান ইউ নো এখন আমাদের ক্লাস অনলাইনে…

রণিমা চুপ করে থাকে। রান্নাঘরের জানালার কাচে আকাশের ছায়া দেখে। চারদিকে মেঘের শাহানা, একটা তন্ময় বিকেল। মেঘের দাপট দেখে খুব খুশি হয় রণিমা। বৃষ্টি  নামুক জোরসে। দিকবিদিক কাঁপিয়ে নামুক। শুরু হয়ে যাক বৃষ্টির সহ্য সন্ত্রাস।

বৃষ্টিতে ছেলেটা আটকা পড়ুক তার বাসায়। দেরি হোক তার ফিরে যাওয়া। আচ্ছা ও কি এখনও সেই ছোটবেলার মতো বৃষ্টি ভালোবাসে? বৃষ্টি হলেই ব্যাকইয়ার্ডে দৌড়ে যেত ফুটবল নিয়ে।

চোখ বন্ধ করে রণিমা ফিরাক গোরখপুরী’র সেই অবিস্মরণীয় দুটো লাইন আবৃত্তি করতে থাকে মনে মনে;

বৃষ্টি তুমি এমন জোরে এসো না যাতে আমার প্রিয় না আসতে পারে

বৃষ্টি তুমি এমন জোরে এসো যাতে আমার প্রিয় এসে না চলে যেতে পারে।

চেরাপুঞ্জির আদলে নামল বৃষ্টি শহুরে ছন্দায়। জানালার কাচে, রণিমার অপেক্ষার মননে। খুশিতে বাকবাকুম হয়ে ছেলেকে বলল;

: বাবান, চল ব্যাকইয়ার্ডে আমরা দুজন ফুটবল খেলি…

ছেলেটা মোবাইল চালনা থামিয়ে মায়ের মমতা মুখে তাকিয়ে থাকে, তাকিয়েই থাকে।

 


1 কমেন্টস্: