কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৪ জুলাই, ২০২১

প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

 

আমার জীবনে উত্তম-সুচিত্রা




(দুই)  

 

সুচিত্রা সেন

মহানায়িকাকে প্রথম দেখি ১৯৭৪/৭৫ সালে ‘দেবী চৌধুরানী’ রূপে (ভবানীপুরের বিজলীতে)বঙ্কিমের উপন্যাসখানি তখন কলেজে পাঠ্য ছিলো। ছবিটি সামগ্রিকভাবে বা মহানায়িকার অভিনয় কোনটাই ভালো লাগেনি। এর কিছুদিন পরে পূর্ণতে দেখি পুনর্মুক্তিপ্রাপ্ত ১৯৫৪ সালের ছবি ঢুলিএবার অনুভব করি সুচিত্রা সেনের মুগ্ধ-করা সৌন্দর্য এবং তাঁর অভিনয় ক্ষমতা। এটিই সম্ভবত একমাত্র ছবি যা’তে সুচিত্রা সেন এবং মালা সিনহা একসঙ্গে অভিনয় করেছেন। ছবির নাম জানা ছিল ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের কণ্ঠে ‘ত্রিনয়নী দুর্গা’ গানটির জন্যে। দেখতে গিয়ে টাইটেল কার্ডে উপরি পাওনাঃ নেপথ্য শিল্পীদের তালিকায় ‘ধনঞ্জয়’-এর পরেই সেই ‘হেমন্ত’! মেরুদণ্ডহীন নায়কের পাশে মহানায়িকা অপাত্রের প্রতি নীরব ভালোবাসায় দীপ্ত! এমনকি উচ্ছল কিশোরী ছাত্রীর ভূমিকায় মালাও মন কেড়েছেন।

১৯৭০-এ ধর্মতলার এলিট সিনেমায় দাদার সঙ্গে দেখেছিলাম হিন্দি ছবি খামোশীওয়াহিদা রহমানের অভিনয় খুব ভালো লেগেছিল, আর ছোটবেলার চেনা গান ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’র হিন্দি রূপান্তর শুনে মজা পেয়েছিলাম। ১৯৭৬-এর পর শ্যামবাজারে অধুনালুপ্ত শ্রী প্রেক্ষাগৃহে বসে বুঝলাম যে তখন খুবই ভালো, সুস্বাদু ঘোল খেয়েছিলাম বটে, কিন্তু আসল দুধ ঝরে পড়েছিল সেই ১৯৫৯ সালে! আজও বলি, মহানায়িকা যদি আর একটি ছবিও না করতেন, তা’হ’লেও দীপ জ্বেলে যাই- এর নার্স রাধা মিত্র তাঁর স্থান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীদের মধ্যে নিশ্চিত করে দিয়েছিল তখনই! এমনকি উত্তর ফাল্গুনীর দেবযানী বা সাত পাকে বাঁধার আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত অভিনয়কেও আমি রাধা মিত্রের পরে রাখব! ও, বলতে তো হবেইঃ কি বাংলা কি হিন্দি, দুই জায়গাতেই গানের সুরে পাগল করেছেন আমার সেই জীবনদেবতা! হিন্দি রূপান্তরটি তো আবার তাঁরই প্রযোজনা! একবার খামোশীতে আসল রাধা মিত্রকে রাখার কথা হেমন্ত ভাবতে পারতেন, তবে হিন্দি ছবির প্রযোজক হিসেবে বাণিজ্যিক চাপ ছিল, তাও বুঝি!

এর পরের কিস্তিতে যাবার আগে দু’টি ছবির কথা বলা দরকার, যেহেতু এখানে বড় পর্দায় দেখা ছবিরই কথা হচ্ছে। ১৯৮০-র দশকের শেষে বা নব্বইয়ের গোড়ায় নন্দনে দেখানো হয় সুচিত্রা সেন অভিনীত একাধিক ছবি। এখানেই প্রথম দেখি ‘সাত পাকে বাঁধা’ এবং ‘উত্তর ফাল্গুনী’র হিন্দি রূপান্তর ‘মমতা’। প্রথমটি মহানায়িকার একমাত্র আন্তর্জাতিক পুরষ্কার-প্রাপ্ত অভিনয়। পরে, দূরদর্শন (এ হ’লো প্রাক-কেবল যুগ!) তাদের ইতিহাসে প্রথম কোন একজন অভিনেতাকে নিয়ে সপ্তাহব্যাপী চলচ্চিত্র-উৎসব করে। তিনি সুচিত্রা সেন। সেখানেও প্রথম ছবি ছিল এই ‘সাত পাকে বাঁধা’। প্রতিটি ছবির আগে সেই ছবির  অপর কোন অভিনেতা মহানায়িকা সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব বক্তব্য রাখেন। ‘সাত পাকে বাঁধা’র আগে বলেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, ‘দীপ জ্বেলে যাই’-এর আগে সম্ভবত অনিল চট্টোপাধ্যায়। এছাড়া মনে আছে অনুপকুমারের কথা। কোন ছবির আগে তিনি বলেছিলেন মনে নেই, কিন্তু কথাগুলো ভুলতে পারি নি। অনুপকুমার আমাদের মনে করান যে মহানায়িকা তাঁর চলচ্চিত্র-জীবনের প্রথম দিকে অনেক অপমান আর দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হয়েছিলেন – এবং সেগুলি তিনি কখনো ভুলে যান নি। প্রতিষ্ঠা পাবার পর সেই লাঞ্ছনাকারীদের তিনি তাদের কুকর্মের যোগ্য প্রতিদান সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন! এর থেকে সুচিত্রার বহুকথিত রূঢ়তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। আরেকটা মজার কথা অনুপকুমার বলেছিলেনঃ শুটিঙের অবসরে সুচিত্রা বেশ আদিরসাত্মক রসিকতা করতেন। বয়ঃকনিষ্ঠ অনুপকুমার সেসব শুনে যারপরনাই লজ্জিত বোধ করতেন, আর সুচিত্রা তা উপভোগ করে উত্তমকে বলতেন, “দেখ, দেখ উতো, ও কীরকম লজ্জা পাচ্ছে!”

‘মমতা’ সম্বন্ধে একটি উল্লেখযোগ্য কথা বলি। অনেককেই বলতে শুনেছি যে সুচিত্রা নাচতে জানতেন না। ‘উত্তর ফাল্গুনী’তে বাঈজী সেজেও তাঁকে বসে-বসে গান গাইতেই দেখা গেছে। হিন্দি ‘বোম্বাই কা বাবু’তে কিন্তু একটি গানে ওঁকে নাচতে দেখেছি বলে মনে হয়। আর ‘মমতা’তে তো দস্তুরমতো দাঁড়িয়ে নাচ আছে। তবে, ‘উত্তর ফাল্গুনী’র কাছে ‘মমতা’র গুণে-গুণে এক ডজন গোল খাওয়ার কারণ দুটিঃ বিকাশ রায়ের শত যোজনের মধ্যেও অশোককুমার পৌঁছতে অক্ষম, আর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘আগুনের পরশমণি’র তুলনায় সমদৃশ্যে হেমন্ত-লতার দ্বৈত গানটি ভাবগম্ভীর ও মধুর হ’লেও, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঠিক ব্যবহারের কোন বিকল্প নেই! 

(ক্রমশ)

 


1 কমেন্টস্:

  1. অভিনেতা-শিল্পীদের বায়পিক হয় (যদিও 'তাঁর' হয়নি), কিন্তু অনুরাগী-শ্রোতা-দর্শকের হয় না। যদি সামর্থ্য থাকত, এই লেখাগুলো জুড়ে জুড়ে লেখকের বায়পিক বানাতাম।

    উত্তরমুছুন