কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

শ্রাবণী দাশগুপ্ত




আমার পুরনো নাম    


কতদিন পরে হঠাৎ দেখলাম এইট-বীর ফুটপাথে! কতদিন, মানে কতবছর পরে!  এমন বদল যে চিনতে পারছিলাম না। ফুটপাথ ধরে কয়েক লক্ষবার হাঁটাহাঁটি করেছি, চোখে পড়েনি। আমাদের ইব্রাহিমপুরের পৈতৃক বাড়ি এখন ফ্ল্যাট, তাকে ঘিরে ফ্ল্যাটের দঙ্গল। নিউটাউন থেকে প্রতি সপ্তাহে আসি বলে অচেনা লাগে না, চোখ সয়ে গেছে। উল্টোদিকে ইউনিভার্সিটির লাগোয়া ফুটপাথ এখন মিনি গড়িয়াহাট। সবসময়ে দেখি বলে আলাদারকম দেখায় না। কারো সঙ্গে আগেকার কথা গল্প-টল্প করলে মনে পড়ে।

সুসীমের বাড়ি স্টেশন রোড, ফ্যামিলি-ম্যান। আমি এলে আড্ডা হয়ে যায় - মায়ের ফ্ল্যাটে বা ওর বাড়িতে। রাস্তায়, বাজারে দেখা হয়ে যায়।  

একথা-সেকথা আড্ডা মারলাম দুজনে ব্যাঙ্কের সামনের ফুটপাথে। ব্যস্ত বিরক্ত মানুষ ধাক্কা মেরে মুখ বেজার করে গেল। ঘড়ি দেখলাম, বাড়িতে শাশুড়ি অপেক্ষায় বসে আছেন। সুসীমকে বললাম, চলি রে।
সুসীম হাই তুলে বলল, যা। তবু তুই এদিকে আসিস বলে দেখা-টেখা হয়। সবাই যা ব্যস্ত!
আমি হাসলাম, আমিও ব্যস্ত। ছেলে-মেয়ে, শাশুড়ি-বর, নিজের চাকরি সামলে আসা। মা বড়ো ছটফট করে হপ্তায় একবার না দেখা দিতে পারলে।

চারদিকে কাতারে লোক, যানজট, আমার অভ্যাস। ভালো লাগে। অনুভব করি বেশ গতিবান্‌ প্রাণবন্ত আছি। আজ একটু রাত হয়েছে। ফুটপাথে দাঁড়িয়ে মোবাইলে ক্যাব ধরার চেষ্টা করতে থাকি। বাস পাওয়া যাবে, সময় বেশি লাগবে। দোনামনা করছি, পাশ থেকে ধাক্কা মেরে ‘এক্সকিউজ মী’ বলে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল একজন।
যত্তসব! অন্ধ নাকি দাদা? চেঁচিয়ে উঠতেই ঘাড় ঘুরিয়ে ‘স্যরি’ বলতে কয়েক সেকেণ্ড থামল সে। পরক্ষণে হনহনিয়ে এগিয়ে গেল। মুহূর্তে আটকে গেল মুখটা।
আরে! শুনুন একটু – বলে দেখি সে ভীড়ের মধ্যে মিশে হারিয়ে গেছে। তাড়া ছিল খুব! নাহলে পুরনো মানুষ দেখে এড়িয়ে যেতে পারার মতো উন্নাসিক সে নয়, অন্তত ছিলনা। ছাব্বিশ বছরে চিনতে না পারার মতো বদল নাকি আমার হয়নি। আমার ছোটোবেলার বন্ধুরা বলে, বরও বলে।

ও আর আমি বেশ কয়েকদিন এই ফুটপাথ ধরে পাশাপাশি হেঁটেছি। সোনারপুর না সুভাষগ্রাম কোথাও থাকত, ট্রেন ধরতে যেত। আমি রাস্তা পেরিয়ে উলটোদিকে। ফর্সা, রোগা, বেঁটে, স্বপ্নময় উদাস চোখ। ঢলঢলে শার্টের পকেটে পেন, ধুলোমাখা হাওয়াই চটি। বিশেষ কোনো কথা কখনো হয়ইনি আমাদের, পাশাপাশি হাঁটাটুকু ছাড়া। ফার্স্ট ইয়ারে আমি সচেতন আর অহঙ্কারী কনভেন্টেড গার্ল। সবার মাঝে ওকে বেশ লাগত – সরল সবুজ নিরীহ।

একঝলক দেখেই চিনতে পারলাম যে! গোলগাল, ফর্সা, ফ্রেঞ্চকাট, সাদা মাথা। ও-ই তো? ভুল হয়নি অবধারিত। একসাথে বেশ কয়েক-পা হেঁটেছিলাম এককালে। কেজো কথা বলতে বলতে একদিন লুকিয়ে ঢেউয়ের দোলা উঠেছিল। ওরটা অবশ্য জানতে পারিনি। কেউ কাউকে বলার চেষ্টা দূরের কথা, ইচ্ছাপ্রকাশ পর্যন্ত করিনি। যোগাযোগ রাখার কথা মনে হয়নি।

ক্যাবে উঠে জানালা দিয়ে দেখি চারদিকে অসংখ্য মানুষ ছুটে চলেছে। প্রত্যেকের মুঠোয় শক্ত করে ধরা আছে সময়। আমি তাকে খুঁজছি এই ভীড়ে। নামের খানিকটা গলে গেছে সময়ের ফাঁকে – জ্যোতির্ময় না জ্যোতিষ্মান? কী ছিল!  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন