কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১ ডিসেম্বর, ২০১৯

শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি  





“...ভালোবাসা মানেও হীনতা।
সে খুব বিস্তৃত নয়, জিরাফেরও মতো নয় অতিক্রান্ত উল্লোল নীলিমে,
সে খুবই নূতনভাবে করে গেছে শব্দে প্রাণপাত,
হে পরমেশ্বর, তুমি ধর্মে আছো, জিরাফেও আছো”।

পাড়া পাড়া সেই বার্তা  রটে গেছে ভ্রমে, কবি রাজচক্রবর্তী আজ চাইবাসায় আছেন। সুরা ক্লান্ত কবিকে নিয়ে যখন আমরা কৌশিকের বাড়ি ফিরে এলুম, ততক্ষণে অন্ততঃগোটা পঁচিশেক নানা মডেলের পদ্যওয়ালা ইধরউধর ঘোরাফেরা করছে। সবাই যে শ্যামলাল তা নয়, তবে অনেকেই। তাদের মধ্যে একজন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনিবাড়িমালিকের জামাতা, জামশেদপুরের বাসিন্দা। আমি তাঁকে চিনি, কিন্তু তাঁর কাব্যরোগ বিষয়ে কিছু জানতুম না। এই 'গুরু'জনটির অনুগ্রহে একতলায় একটি  বড়োঘরে কবির অভ্যর্থনা হবে, এমত বোধ হলো। কবি রিকশা থেকে নামতেই বেশ কজন ছুটে এলো, স্বাগত জানাতে। তাঁদের মধ্যে জামাতা বাবাজীবনও রয়েছেন।  তিনি স্নান করতঃ পাটভাঙা চিকনের পাঞ্জাবিপাজামা পরিধান পূর্বক ঘাড়ে বেশ
উদারভাবে পাউডার লাগিয়ে কপিবুক হোস্ট। আসলে এই গ্রাম শক্তিকে বহুকাল  ধরে চেনে। একসময় তাঁরও এই গ্রামের জামাতা হবার পূর্ণ সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু  তাঁর আরো দু'জন কবিবন্ধুর ভায়রাভাই হবার ভাগ্য তাঁর আর হয়নি। তবে সেই সব পুরাকথা ততদিনে কিংবদন্তি হয়ে গেছে।

রিকশা থেকে নামতেই, আসুন, আসুন, আমরা খবর পেলাম, আপনি এসেছেন... ইত্যাদি। তিনি নেমেই চেঁচিয়ে বললেন, মার্চ অন... তারপর লেফট-রাইট লেফট-রাইট বলতে বলতে কৌশিকের ঘরের দিকে যাত্রা করলেন। সমবেত কবিকুল বেশ
হতভম্ব, কিন্তু শ্যামলালের দল কবেই বা এতো সহজে নিবৃত্ত হয়। তারা এসে ধরলো কৌশিককে, আমরা একটু আয়োজন করেছি স্থানীয় কবিদের নিয়ে। উনি যদি একটু তাদের সঙ্গে আলাপ করেন তবে তারা খুব উৎসাহিত হবে। সে চেহারায় একটা বিপন্ন ভঙ্গি এনে বলে, দেখছেনই তো, উনি কী অবস্থায় আছেন। এখন কি আর ওসব করা সম্ভব? আপনারা যদি একটু আগে জানাতেন...। যেন, আগে জানলে এসব করা  যেতে পারতো ! জামাতাজি বলে ওঠেন, আমরা শুনেছি উনি নেশাটেশা করেন  তা  বলে এই ভর সন্ধেয় ?
-ওঁর আর সকাল-সন্ধে কী, এতো সারাদিনের ব্যাপার...
-তবে কি কোনও আশা নেই?
কৌশিক কিছু বলার আগেই কবিকে টানা বারান্দা ধরে “চলো যাই, চলো যাই, চলো  যাই, চলো যাই, চলো দুর্জয় প্রাণের আনন্দে...” উচ্চৈঃস্বরে গাইতে গাইতে  আসতে দেখা গেলো। শ্যামলালের দল ধীরে ধীরে হালকা। কীই বা আর করার ছিলো তাদের? এতো বিপজ্জনক একজন লোক কবিতা লেখে? তাদের কাব্যজীবন সমৃদ্ধ হলো।

“...দোলপূর্ণিমায় তুমি গিয়েছো কখনো-জৈনমন্দিরের কাছে
ওখানে নদীটি শুয়ে আছে
পরস্পর
যে-কথা বলেছি আগে তারই ফলে ভেঙে গেছে ঘর
এখন জানালা তার ভেসে যায় জলে
আমাকে গোপন কথা বলে
তীরের জোনাকি
'এখানে আসেনি কেহ, আমি একা থাকি!”

চমকটা নিঃসন্দেহে ছিলো জোরদার। এই মুহূর্তে এইভাবে মধুরিমাকে মেঘাতুবুরু'তেদেখতে পাবো, প্রায় অবিশ্বাস্য। ওর বিয়ে হয়েছে, বাঙালিমতে ভালো ছেলের সঙ্গে,  চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সে খবর পেয়েছিলুম  যথারীতি নেমতন্নোও ছিলো। কিন্তু
অনুষ্ঠানটি হয়েছিলো পাত্রপক্ষের ইচ্ছায় কলকাতায়। আমি তখন হরদ্বারে কুম্ভমেলা সেরে জয়শলমেরবাড়মের করছি। যাওয়া হয়ে ওঠেনি। তারপর আবার জামশেদপুর ছেড়ে অন্য হাটে, অন্য ঘাটে। মাঝখানে প্রায় বারোটা বছর। এই মুহূর্তে রিমা'কে  দেখে মনে হলো, লেভেল ক্রসিঙে  দাঁড়ানো সাইকেলের মতো সময় এতোদিন ধরে যেন এক জায়গায় থেমে আছে। রাশি রাশি কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরিয়ে ভোরবেলার
কিরনডুল গাড়ি যেন গড়িয়ে যাচ্ছে আরাকু টানেলের অন্যপার।

-আরে তুমি এনাকে ভালো-ই চেনো দেখছি। বাহ, দারুণ। পার্থ, পরশু হোলি, কাল তাহলে আমার বাড়িতে একটু দোলযাত্রার পার্টি হোক। পিওর বেঙ্গলি স্টাইল, কী বলেন?
কুন্তল আমার দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকান...
পার্থ বলে, ঠিক আছে, বাকি সব বাংলা চলবে, কিন্তু বোতলটা ইংরিজি চাই...
আরে সে আর বলতে? গতমাসে সিঙ্গাপুর ফেরত এক বছরের স্টক নিয়ে এসেছি, তুমিও তো খেয়েছো শালা, বাইরের লোকের কাছে বদনাম করছো কেন?
-আরে না না, সে তো আমি জানিই, সসুরালকে ইজ্জত বা...
পার্থ এবার আমাকে জানায়, কুন্তল শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বড়ো সমঝদার। ওর কাছে খুব ভালো কালেক্শন রয়েছে। আমি বলি, বাহ...কিন্তু গৃহকর্ত্রী এরকম নীরব
থাকলে সেটা কি মৌনং সম্মতির এলাকায় পড়বে?
-হ্যাঁ, ঠিক ঠিক, রিমা হবে তো?
-হমম, হয়ে যাবে...
-বাহ, আর কোনও কথা নেই....


“...কবিতাকে তার খুব কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি
যে-জন ঈশ্বর, বাঘ, পারিজাতময় স্বর্গ, নারী...
আমি কবিতাকে তারও কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারি”।

কৌশিক যে বাড়িটায় থাকে তার মাঝখানটায় মস্তো একটা উঠোন। একদিকে
কুয়োতলা আর বেশিটাই ঘাসপাতা ছড়ানো এলোমেলো জমি । চারদিকে বারান্দাঘেরা ভাড়াটে ঘরের সারি। উঠোনের বিভিন্ন কোণায় এদিকওদিক খাটিয়ারা শুয়ে বসে আছে। একদিকে দু'তিনটে খাটিয়া নিয়ে আমরাও জুড়ে বসি। কাব্যনেশাতুর জনতার দল ফিরে গেছে। উঠোনে ঢোকার মুখে কাঁটাতারের ভাঙাচোরা আগড়ের দু'দিকে লতিয়ে উঠেছে মালতীলতার গুচ্ছবীথি। মালতীলতা না মাতাললতা,
সৌরভমত্ত নৈরাজ্যের নেশা...
আকণ্ঠ মহুয়ার গরল কবিকে অন্যধরনের উৎফুল্লতা দিয়েছে। আড্ডা শুরু হয়,  প্রথমে ছাড়া ছাড়া, তারপর মজে আসি ক্রমশঃ তাড়ির মতো শৃঙ্খলহীন। হঠাৎ  প্রশ্ন করি, আপনাকে জীবনানন্দ এভাবে গ্রাস করলেন কীভাবে? সচেতন ছিলেন না, অবচেতনার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন শুরু থেকে?
তিনি ধমকে ওঠেন, এসব ভারি ভারি কথা বলে নেশাটা ছুটিয়ে দিসনা।
-বেশ, তবে হাল্কা কথাটা কী ?
মোদ্দা কথাটা হচ্ছে কবিতা একটা লাইট খেলা, কবিরা নিজেদের মধ্যে ভারি
ভারি কথা বলে এটার ওজন বাড়ায়...
-আপনিও বাড়ান?
-চোপ শালা, ইন্টারভিউ নিচ্ছিস নাকি?
নাহ, তা নয় আপনিই তো বলেন পদ্য ট্র্যান্স থেকে আসে। কবি নিজের ভিতর  সঙ্গোপনে  নিজেকে উন্মুক্ত করে, শব্দগুলি নিজের সাজে অতর্কিতে কাগজে  নেমে পড়ে, তারপর কবির কাজ শেষ। তাকে প্রকাশ্য সভায় কাটাছেঁড়া করে  কিছুই পাওয়া যায়না। জীবনানন্দ কিন্তু এরকম ভাবতেন না...
-তোকে কে বলেছে আমি জীবনানন্দের চ্যালা...
-সব্বাই বলে...
-কারা তারা?
-যারা আপনার কবিতা পড়ে, পড়তে ভালোবাসে...
-তারা সব..., তোদের মতো লোকজনসব....
অ্যাইই, গলাটা শুকিয়ে গেলো। জল আন, জল...

কৌশিক ঘরের ভিতর থেকে আধোশেষ বোতল বের করে আনে। একচুমুকে  খেয়ে ফেলেন তিনি। মুখটা মুছে হঠাৎ উঁচুগলায় গেয়ে ওঠেন,  “মরি লো মরি, আমায় বাঁশিতে ডেকেছে কে?”
নাহ, বলতে পারবোনা, তিনি উঁচুদরের গায়ক। গলায় সুর সরে যায়, উচ্চারণে আরোপিত কাঠিন্য... কিন্তু নিবেদনের আকুতি বড়ো স্পষ্ট। গান নয়,  আত্মসমর্পণের মন্ত্র শুনি আমরা। ঐ বাহিরে বাজিলো বাঁশি, পুনরাবৃত্ত তারসপ্তকে গলা ভেঙে যায়... কিন্তু জলের মতো গড়িয়ে আসে বালিকার অসহায় আর্তি, “বলো কী করি”...

ঐপাশে অন্য একটি খাটিয়ায় দু'টি নারী, কৌশিকের প্রতিবেশী, একজন  বিলম্বিত যৌবনে অন্যজন সদ্যোযৌবনে গরবিনী বিহারনন্দিনী, বাংলা বোঝেনা, কবির গান শুনে উচ্ছল হাসিতে ভেঙে পড়ে...
-বাবা বহুত পী লিয়া হ্যাঁয়...
কবির শাদা মোটা গুম্ফযুগল 'বাবা' হয়ে ওঠার প্রত্যক্ষ পাসপোর্ট। কবি গান  থামিয়ে বলেন, এই মেয়েগুলো, চুপ কর, সারাদিন শুধু বকবক করে চলেছে... তোরা দেখেছিস মেয়েগুলো শুধু কথা বলে...
কৌশিক জনান্তিকে তাদের গিয়ে বলে, বহনজি, বুরা নহি মানিয়েগা...তারা  আরো উৎসারিত প্রসন্নতায় হেসে ওঠে। কুছ জ্যাদা হী পী লিয়া হ্যাঁয় বাবা।
গান থামে এভাবেই। আমি বলি আজ কিছু লিখলেন?
-হ্যাঁ, লিখেছি, রোজই লিখি, কিছু থাকে, কিছু থাকেনা...
-একটু শোনাবেন...?
ভেবে ছিলুম প্রত্যাখ্যাত হবো। কিন্তু তিনি খুব উদারভাবে বললেন, কৌশিক  আমার বালিশের নিচে কাগজগুলো আছে নিয়ে আয় তো...
মন্দ্রসপ্তকে গলা নামিয়ে কবি পড়তে থাকেন শব্দ কেটে কেটে...

“রোরো নদীর ধার থেকে ঐ একটি বালক
কুড়িয়ে পেয়েছিলো রঙিন বুকের পালক
এবং একটি পাথর পেয়ে, সেই পালকে
জড়িয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলো এপার থেকে
পালক কি আর একাকিনী ওপার যাবে?
...কুড়িয়ে পেয়ে ছড়িয়ে দিলুম বুকের পালক
-আসছো কবে? আসছো কবে? আসছো কবে?"
- অ্যাই, চল রোরো যাবো....

কৌশিক দোনামনা করে, বেশ রাত হয়েছে। অনেকটা দূর, বেশি নেশা হয়ে গেলেফেরার সময় রিকশা পাওয়া যাবেনা। আমার দিকে তাকায়। বলি, চলনা দেখা  যাবে এখন...

 (ক্রমশ)




(সৌজন্য-গুরুচণ্ডালি)

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন