কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১ মে, ২০১৯

শিবাংশু দে




হরীতকী ফলের মতন



চিরকাল গায়ত্রীর শূন্য অলিন্দের দিকে চেয়ে গেয়ে যাওয়া সমুদ্রকল্লোল আর পঞ্চম সিম্ফনি। উদ্দাম একাকিত্ব, নিষ্করুণ দারিদ্র্য আর নির্নিমেষ অবসাদের নিম ইতিবৃত্ত।

প্রিয় কবির প্রতি সজল দৃষ্টিপাত ছাড়া বোধহয় আমাদের আর কিছু দেবার  থাকে না।

'...অঙ্গুরীয়লগ্ন নীল পাথরের বিচ্ছুরিত আলো
অনুষ্ণ  অনির্বাণ, জ্বলে যায় পিপাসার বেগে
ভয় হয়, একদিন পালকের মতো ঝরে যাবো। ' 

বলোতো কেন এমন হয়...অন্যরকমও তো হতে পারতো... আর কেউ আসতে পারতো কবির জীবনে... নতুন করে পাতা ধরতো, ফুল...

মনে মনে বলি, হয়তো পারতো, কিন্তু উৎফুল্ল আশা আর উদ্ভাসিত ভবিষ্যৎ তো  সবার জন্য নয়... জ্যোতিষ্কসম্ভব জীবন কজন পেয়েছে। সকলের জীবনেই রক্তাপ্লুত ট্রাম কখনো না কখনো একবার মাড়িয়ে দিয়ে যাবেই।

সুবর্ণরেখার জল সাক্ষী থাক, এমন বিষাদমগ্ন সময় পর্ণার সাথে কখনও কাটেনি।  কবিতাই শুধু পারে, প্রিয় নারীর সঙ্গ ছাপিয়ে এমন  গেরুয়া রঙে অন্তর রাঙিয়ে দিতে...

পরের সপ্তাহে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন শুরু হচ্ছে। তিনটে সন্ধে খালি রেখো। জর্জদা  আসবেন এবার। শেষ মুহূর্তে নো অজুহাত। এবার কবিতার সঙ্গে মিলিয়ে গান শুনবো।  পাগলের সঙ্গে যাবো, পাগল হবো, ভাসবো  রসে পাগলপারা।


'যাক তবে জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া যা হৃদয়।
সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই।
শুধু তার যন্ত্রণায় ভরে থাক হৃদয়শরীর।
তার তরণীর মতো দীর্ঘ চোখে ছিলো সাগরের
গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ, বাতাস।
কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন
দীর্ঘস্থায়ী তার চিন্তা;...'

'নেই কোনো দৃশ্য নেই, আকাশের সুদূরতা ছাড়া।
সূর্যপরিক্রমারত জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে শুধু
ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী; তোমার প্রতিভা
স্বাভাবিকতায় নীল, নর্তকীর অঙ্গসঞ্চালন
ক্লান্তিকর নয় বলে নৃত্য হয় যেমন তেমনি।
সুমহান আকর্ষণে যেভাবে বৃষ্টির জল জমে
বিন্দু হয়, সেইভাবে আমিও একাগ্র হয়ে আছি।
তবু কোনো দৃশ্য নেই আকাশের সুদূরতা ছাড়া।'

আজ তিনদিনের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন শেষ হলো। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে।  জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে এই চারদিক খোলামেলা প্রাঙ্গনে, পাশেই জুবিলি পার্ক, হুহু করে শীতহাওয়া ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে শীতহাওয়া, কিন্তু তাজা, তৃপ্ত স্পর্শ তার,  চোখ মুখ স্নিগ্ধ করে দেয় তার স্নেহ।  ভিড় পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছি এতোরাত হয়ে গেছে, সবার বাড়ি ফেরার তাড়া। কিন্তু সমস্ত শ্রোতারা এতো নিশ্চুপ শ্রদ্ধায় ধীরে ধীরে প্রাঙ্গন খালি করে দিচ্ছে, সত্যি দেখার মতো ঘটনা। কিশোরিরশীতহাত আমার হাতে, কিন্তু রোমাঞ্চে উষ্ণ সেই স্পর্শ। তার গাঢ় বেগুনি রেশমি শাড়ি, নীল শাল, কালো আঁকা চোখ, মদির ওষ্ঠ, মাদক বিদেশি সুরভির ঘ্রাণ।ডিভাইনলি টেমটিং,  সিম্পলি ইররেজিস্টিবল...




আজকের শেষ শিল্পী ছিলেন জর্জদা ।বহুদিন পরে এতো তাজা গলায় গান গাইলেন প্রায় দেড় ঘন্টা। শেষে বললেন, 'আমায় মাফ করেন, আর গাইতে পারতেসি না'স্তব্ধ, মুগ্ধ অতো শ্রোতাসমাগম,  অপূর্ণতার আক্ষেপ নিয়েও উচ্চকিত অনুরোধ থেকে সম্বৃত থাকলো। গেরুয়া ফতুয়া আর গেরুয়া লুঙ্গি, জর্জদা করজোড়ে বিদায়চাইলেন।

বাইরে বেরিয়েই পর্ণা বললো, একটু দাঁড়াও,
বলি, কী হলো?
কিছু বললে না, জর্জদার গান নিয়ে...
এখনও ঘোরে আছি, কী বলবো? তবে একটা কেমন  অনুভূতি হচ্ছে, জামশেদপুরের জন্য এটা যেন ওনার সোয়ান সং। জানিনা সামনে বসে ওঁর গান আর এখানেশোনা হবে কি না...
অমন কেন বলছো? ছিঃ, আরো অনেক অনেক দিন উনি আমাদের গান শোনাবেন...
তাই হোক... তাই যেন হয়
কোনও কবিতা মনে আসছে না?
আসছে, তাইতো চুপ করে আছি। তোমার মনে পড়ছে,

নেই কোনো দৃশ্য নেই, আকাশের সুদূরতা ছাড়া।
সূর্যপরিক্রমারত জ্যোতিষ্কগুলির মধ্যে শুধু
ধূমকেতু প্রকৃতই অগ্নিময়ী; তোমার প্রতিভা
স্বাভাবিকতায় নীল,...'
'...সুমহান আকর্ষণে যেভাবে বৃষ্টির জল জমে
বিন্দু হয়, সেইভাবে আমিও একাগ্র হয়ে আছি।
তবু কোনো দৃশ্য নেই আকাশের সুদূরতা ছাড়া।'

এতো কাছে বসে ওঁর গান শুনলুম, কিন্তু আসলে কতো দূরে ছিলেন তিনি, সুদূর  আকাশের দৃশ্যের মতন, অগ্নিময়ী ধূমকেতুর মতন।
 ঠিক বলেছো। চলোনা একটু হাঁটি...
মাথাফাথা খারাপ হয়েছে নাকি? এই ভিড়টা কেটে গেলেই এখানে রাস্তায় কুকুর বেড়ালও দেখা যাবেনা। শেষে পাঁড়েজি হাবিলদার উঠিয়ে নিয়ে যাবে দুজনকে। হিন্দিকাগজে কাল সকালে সনসনিখেজ হেডলাইন, ব্যাংক করমচারি সন্দিগ্ধ স্থিতি মেঁ  যুবতী কে সাথ গিরফতার। মাফ করো ভাই...
তুমি বড্ডো ভিতু
তা হবে হয়তোকিন্তু আপাতত তোমার উর্বর চিন্তায় সায় দিতে পারছি না।
পিছনে বসোতোমায় বাড়িতে ছেড়ে দিই....

একটু পরেই ওর বাড়ির কাছাকাছি। পৌঁছোবার আগেই বললোএখানে দাঁড়াও
কী হলো আবার?
বলছি না দাঁড়াও...
আচ্ছা বাবা..., ভালো পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে যাই হোক...
শোনো একটা জরুরি কথা তোমায় বলার ছিলো...
বোঝোচার ঘন্টা ধরে সঙ্গে আছোএখন মনে পড়লো 'জরুরিকথা...
হ্যাঁচেষ্টা তো করলাম অনেককিন্তু বলে উঠতে পারলাম না...
বেশ বলো
তোমায় বলেছিলাম নাএকটা প্রজেক্টের জন্য দিল্লিতে জে এন য়ুতে পেপার    পাঠিয়েছিলাম,
হ্যাঁবলেছিলে..
ওরা অ্যাক্সেপ্ট করেছে...
আরে বৌয়াএইসন খুশখবরি দবাকে রখল  বাড়ন...
তুমি বাংলায় খুশি হতে পারোনা?
কে জানেবোধ হয় তাই
শোনোআমাকে দিল্লি যেতে হবেদুমাসের জন্য... ভাবছি যাবোনা...
মান গয়ে উস্তাদদিমাগ বিলকুল সনকা গইল... যাবে না মানে?
মানে যাবো নাআমি দুমাস তোমাকে... মানে দিল্লি গিয়ে থাকতে পারবো না...
একদম পারবেএমন একটা সুযোগ বারবার আসে নাকি?
তুমিও আমাকে যেতে বলছোআমি তোমার জন্য যেতে চাইছি না... তোমার কোনো ফিলিংস নেই আমার জন্য...
সত্যিই নেইএবার যাবে তো?
নাতবু যাবোনাআমি জানতাম তুমি এখানে মধুরিমার সঙ্গে হাহাহিহি করবে আর আমি হস্টেলের বন্ধঘরে বসে থাকবো বইখাতা নিয়ে...
 এই ব্যাপারতা তুমিও ওখানে মধুরিমার প্রতিশোধ হিসেবে কোনও মনদীপ সিংকে জোগাড় করে নিও নাহয়। ছেলেগুলো খুব হ্যান্ড্সাম হয়আমার থেকেও বেশি...
হাও কনসিটআই' হিট য়ু...
যাঃ বাবাশেষে গালাগলি দিতে ইংরিজি... যাকগে তুমি যাচ্ছোপাক্কা... টিকিট হয়ে গেছে?
হ্যাঁবাবা করে নিয়েছে
তবে তো হয়েই গেলো
তুমি একবার না বলো প্লিজআমি সত্যি থাকতে পারবোনা...
বলছি নাবলবো নাচলো দিল্লি...

'...স্বর-সুর এক হয়ে কাঁপে বায়ুযেন তুষ্ট শীতে,
কেঁদে ওঠেজ্যোৎস্নার কোমল উত্তাপ পেতে চায়।
রোমাঞ্চ তো রয়ে গেছে শীতল সাপের স্পর্শে মিশে।'



 (ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন