খবর
রোজ
রাতে ডায়েরি খুলে হিসেব নিয়ে বসে শিহাব। হিসেব বলতে তেমন কিছু নয়। ঘরে তেমন টাকাও
আসে না। ইস্ট রিলায়েন্সে সেলসের কাজ করে। তাতে মাইনে কতই বা! নুন আনতেই পান্তা
ফুরায় যাদের, ডায়রিতে তারা কী লেখে এ্ তরু বোঝে না। কখনও উঁকি দিলে প্রবল বিরক্ত
হয় শিহাব। ঘর বলতে একটাই। সাবলেট। ভাগের
রান্নাঘর। ভাগে বারান্দা পেয়েছে তারা। ডায়েরিটা নিয়ে সেখানেই সরে যায় শিহাব। লেখা
শেষ করে। তারপর ঘরের উত্তর কোণে যে স্টিলের ফাইল কেবিনেট আছে তাতে রেখে তালা দেয়।
তরুর অভিমান হয়। একসাথে থাকছে তাও নয় নয় করে তিন বছর। কিসের এত আড়াল! কেন এই
ডায়েরি লুকিয়ে ফেলা! জিগ্যেস করলে উত্তর পায় না। একদিন কেবল বলেছিল প্রোডাক্টের হিসেব রাখতে হয়।
প্রোডাক্ট
নিয়ে শিহাবকে দূর দূরান্তেও যেতে হয় প্রায়ই। সেলসের কাজ। কখনও শিহাবের ফিরতে রাত
হয়। কখনও ফেরেই না। যেদিন ফিরতে পারে না সেদিন রাত বারোটা নাগাদ একটা মেসেজ ঢোকে
তরুর ফোনে। খেয়ে নিও। ভোরবেলা টুং করে
আবার একটা মেসেজ ঢোকে, গেটটা খুলে দাও। যদি ভোরের মেসেজের শব্দ সে না শুনতে পায়,
তরু সেসব রাতে তাই ঘুমায় না। জেগে কখনও জি সিনেমা দেখে কখনও অনাগত সন্তানের মুখ ভাবতে
থাকে। তিন বছর চলে গেল... শিহাব রাজি নয়।
কখনও
তরু ভাবে চাকরিটা শিহাবকে ছেড়ে দিতে বলবে। এভাবে মানুষ পারে! আজ নিয়ে দুদিন শিহাব আসেনি। আগেরদিন তরু
কুচোচিংড়ি দিয়ে পুঁইচচ্চড়ি রেঁধেছিল। নিপাট ধবধবে সাদা ভাত। কালোজিরে আর
কাঁচালঙ্কা ফোঁড়ন দিয়ে মুসুর ডাল। খাবার পড়ে আছে। আজ শিহাবের জন্মদিন। সাদা তেলে
পোলাও। প্রতিবেশীর কাছ থেকে তিনশ টাকা ধার
করে ঝাল ঝাল করে মুরগির ঝোল করেছে তরু। শিহাবের একমাত্র পাঞ্জাবিটা বের করে
ইস্ত্রি করে বিছানার ওপর রেখে দিয়েছে। একটা স্টিলের প্লেটে বারান্দার টবে ফোটা
বেলি তুলে এনে রেখেছে। শিহাবকে ফোন করেছে সারাদিনে অন্তত দশবার। শিহাব ফোন তুলছে
না।
সন্ধ্যার
পর টেলিভিশন খুলে বসে থাকল তরু। দুদিন না ঘুমানো শরীরে ক্লান্তি জমেছে। অপেক্ষাও
তো ক্লান্ত করে দেয় শরীর, মন। আর শিহাবের এই নীরবতা কেমন যেন ভয় ধরে ধরিয়ে দিচ্ছে। ফাইল কেবিনেটটার দিকে চোখ পড়ল হঠাৎ।
বুক ঢিপঢিপ সাথেসাথে। সোজা হয়ে বসেছে। কোণে চাবি ঝুলছে। কী ব্যাপার! শিহাব চাবি ফেলে যাবার লোক নয়। তিনবছরে কোনোদিন
ফেলে যায় নি। এবার কেন? গতকাল থেকে আজ তরু কতবার যে ঘর গোছালো! ঘরে আর কটাই বা
জিনিস! কিন্তু একবারও কেন চোখ পড়ল না! দ্রুত উঠতে গিয়ে টাল খেল শরীর। দেয়াল ধরে সামলে কেবিনেটের কাছে গেল।
ড্রয়ার খুলল একটানে।
কই,
ড্রয়ারে কিছুই নেই তো...
নিউজে
গত সাত ঘন্টায় মাদকবিরোধী যুদ্ধ ও সন্ত্রাস নির্মূল অভিযানে এনকাউন্টারে নিতহদের খবর
বলা হচ্ছে। ফ্যাকাশে
মুখে তরু একবার টিভি একবার কেবিনেটের ড্রয়ারের দিকে তাকাচ্ছে...
তরুর
মোবাইল বাজছে।
গল্পের শেষটায় যখন এসে ধাক্কা লাগে তখন গল্পের চরিত্র তরুর মতো পাঠকও একটু যেন কেঁপে উঠে। মধ্যবিত্তের যে কালক্রম চিত্র এখানে উঠে এসেছে সেটা যেন হাজারটা পরিবারের গল্প। শিহাবের মতো অনেকেই এভাবেই টুকে রাখে জীবনের কথামালা কিন্তু সে কথামালাও একসময় হারিয়ে যায়।
উত্তরমুছুনঝরঝরে সুন্দর সুবিন্যস্ত একটা গল্প। যে গল্প ভাবনার জন্ম দেয়, সে গল্প কয়েকবার পড়েও কোন কূল কিনারা করা যায় না। এ গল্পটা তেমনি একটা।