কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৮

ফারহানা রহমান




বাহমান ঘোবাদি ও তাঁর বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘ টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ 
 আব্বাস কিরোস্টামির পর বাহমান ঘোবাদিকেই ইরানের সবচেয়ে প্রতিভাবান, আধুনিক ও ভিন্নধারার একজন চলচ্চিত্রকার বলে মনে করা হয়।  একইসাথে তিনি  একজন ইরানী-কুর্দি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক এবং লেখক।  ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি কুর্দিস্তানের বানেহে প্রদেশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।  ঘোবাদি ইরানি সিনেমাগুলোতে এক নতুন মাত্রা বা তরঙ্গ এনে দিয়েছেন বলেই ক্রিটিকরা মনে করেন। ঘোবাদি এমন একটি সীমান্ত শহরে জন্মগ্রহণ করেন যেটিকে নিয়ে ইরান প্রায়শই ইরাকের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়তো । শহরটির নাম বানেহ এবং এটি ইরানের ভিতর অবস্থিত একটি কুর্দি শহর যা ইরান নিজেদের বলে সবসময় দাবি করে আসছে ১৯৮১ সালে ঘোবাদির পুরো পরিবার সানন্দাজে স্থানান্তরিত হয় তিনি ইরানের ব্রডকাস্টিং  কলেজ থেকে চলচ্চিত্র  পরিচালনার উপর ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৯০ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত একনাগাড়ে তিনি মোট ১০ টি শর্ট ফিল্ম  তৈরির পর তিনি ২০০০ সালে তার প্রথম ফিচার ফিল্মএ টাইম ফর ড্রাঙ্কেন হর্সেস’ তৈরি করে।  শিল্প ফটোগ্রাফির সংক্ষিপ্ত কর্মজীবনের পর, ঘোবাদি ৮ মিলি মিটারের শর্ট ফিল্ম তৈরি করা শুরু করেনতার ডকুমেন্টারি ‘ লাইফ ইন ফগ ’ অসংখ্য পুরষ্কার জিতে নেয়। আব্বাস কিরোস্তামির দ্য উইন্ড  উইল ক্যার্রি আস’  ছবিটির সহকারী পরিচালক বাহমান ঘোবাদি কাজ করেন। ২০০০ সালে তিনি মিজ ফিল্ম প্রতিষ্ঠা করেনইরানের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠী সম্পর্কে চলচ্চিত্র উৎপাদনের লক্ষ্যে সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করা হয়
এ বছর অর্থাৎ ২০০০ সালেই তার প্রথম চলচ্চিত্রএ টাইম ফর ড্রাঙ্কেন হর্সেসমার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পাওয়ার মাধ্যমে বাহমান ঘোবাদি পৃথিবীর  মানচিত্রে প্রথমবারের মতো কুর্দিস্তানকে প্রতিস্থা করেন আমরা কেমিক্যাল আলীর কথা শুনেছিলাম, কিন্তু ১৯৮৮ সালে কুর্দি শহর হলাবচেহের উপর  ভয়াবহ রাসায়নিক আক্রমণের বিষয়ে আমাদের অধিকাংশই কিছুই জানি নাযেখানে ২০০১ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে মারা যাওয়ার, হাজার  হাজারের চেয়েও বেশি মানুষ চোখের পলকে মৃত্যু বরণ করেছিলো। তার দ্বিতীয় ছবি মারুনড ইন ইরাকএ ঘোবাদির তৈরি করা  চরিত্রগুলি  হালাবচেহের ঘটনায় বলি হওয়া মানুষগুলোকে উদ্ধারের জন্য যাত্রা শুরু করেছিলইরান- ইরাক সীমান্তের এই প্রাত্যহিক বাস্তবতাগুলির ভয়াবহতার উপর অতিশয়োক্তি মন্তব্য করাকে ঘোবাদি ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে মনে করেন এবং তিনি মনে করেন এতে করে তাঁর প্রতিভাকেই আসলে ছোট করে দেখা হবে। ঘোবাদির পরিচালিত মুভিগুলো যে কারণে সবার চেয়ে কিছুটা আলাদা তা হচ্ছে তিনি ফিল্মের কাহিনী এবং চরিত্রগুলো অর্থাৎ অভিনেতাকে তিনি বাস্তবতার অন্তঃস্থল থেকে তুলে আনেন। ঘোবাদি মনে করেন, “ইরানে ফিল্ম তৈরি করা মানেই নানা মিথ্যে দিয়ে ফিল্মটি আগাগোড়া সাজানো । কোন সত্য বা বিতর্কিত বিষয় নিয়ে মুভি তৈরি করার কোন সুযোগ বা পারমিশন ইরানে কখনই পাওয়া সম্ভব নয়। ইরানে ভিসা, পাসপোর্ট ও ডকুমেন্ট পেতে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। এখানে মিউজিককে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হিসেবে দেখা হয়। তরুণ প্রজন্ম যাতে মিউজিক থেকে উদ্ভূত যে শক্তি সেটা দ্বারা একত্রিত ও শক্তিশালী হতে না পারে সেজন্যই কর্তৃপক্ষ মিউজিককে নিয়ন্ত্রণ করে রাখতে চায়।”
মুসলিম দেশগুলো থেকেই কেন সবচেয়ে বেশি মিথ্যাচার বেড়িয়ে আসে আর মধ্যপ্রাচ্য ও এই মুসলিম দেশগুলোতেই কেন সবচেয়ে বেশি সামাজিক  অনাচার, পাপাচার হয় ? এই প্রশ্নের উত্তরে বাহমান ঘোবাদি বলেন, ‘ আপনি যখন কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন, কোনো কিছু দমন করবেন, মানুষ তখন অন্যতর পথ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা চালাবে। কোনো শিশুকে আপনি যদি কোনো জিনিস ধরতে বারণ করে দেন বারকয়েক, দেখবেন, স্রেফ সেই বারণ অমান্য করার জন্যই শিশুটি জিনিসটিকে ধরার অন্য কোনো উপায় বের করে নেবে। জগতের সব ধরনের মিথ্যাচার আর পাপাচারের দেখা আপনি ইরানি সমাজে পাবেন; আর আপনি যদি বিবাহিতা নারীদের ওপর গবেষণা করেন তাহলে দেখবেন, তাদের অনেকেই আপনাকে জানাবে, পাপাচারের নিয়ম ভেঙেই তারা প্রচুর আনন্দ পেয়েছে; কেননা তারা নিয়ম ভেঙেছে স্রেফ সিস্টেমের বিরোধিতা করতেই
তার প্রথম ফিচার ফিল্মএ টাইম ফর ড্রাংকেন হর্সেস’ (২০০০) ইরানে তৈরি করা প্রথম কুর্দি চলচ্চিত্রচলচ্চিত্রটি কান ফিল্ম ফেস্টিভালে ক্যামেরা ডি'অর পুরস্কারটি জিতে নেয় এ ছবিটিতে আমরা দেখি , একটি ছেলে বাধ্য হয় আর্থিকক পরিস্থিতি ও পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী  চোরাচালান ব্যবসার সাথে  নিজেকে জড়াতে যে ব্যবসা করতে গিয়ে একদিন তার বাবাও হত্যা হয়েছিলো। এদিকে তার বোন তার চাচা দ্বারা নির্বাচিত একজন পুরুষকে এমন প্রতিশ্রুতি  দিয়ে বিয়ে করে যে, সে তার বরের পরিবার অন্য একজন ভাইয়ের অপারেশনের জন্য অর্থ দিয়ে সাহায্য করবে। মারুন্ড ইন ইরাকছবিটিতে আমরা দেখি  মির্জার প্রাক্তন স্ত্রী হানরেহকে তার পরিবার এবং তার কাজের মধ্যে যে কোন একটি বিষয়কে নির্বাচন করতে বাধ্য করা হয়েছেআবার ‘টারটেলস ক্যান  ফ্লাই’ ছবিটিতে মূল চরিত্র হিসেবে নানাভাবে বিপর্যস্ত অর্গিণকেই দেখতে পাই 
তার দ্বিতীয় ফিচার ফিল্মের নাম ছিল মারুনড ইন ইরাক’ ( ২০০২ ) যা তাকে শিকাগো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে গোল্ড প্লাংক পুরষ্কারটি এনে দেয়। এরপর তিনি ২০০৪ সালে টারটেলস ক্যান ফ্লাই ছবিটি তিনি তৈরি করেন যা তার সাফল্যের ঝুড়িতে সব মিলে  ১২টি  পুরষ্কার এনে দিয়েছিলো   এরপর ২০০৬ সালে, ঘোবাদির হাফ মুন ছবিটি সান সেবাস্টিয়ান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গোল্ডেন শেল জিতে নেয় ইরানের গুলশিফ্তাহ ফারহানি, হাসান পোরশিরাজি এবং হাদীহ তেহরানির মতো বিখ্যাত অভিনেতারা এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেনইরানের সংগীতশিল্পী  হোসেন আলিজাদেহ এই চলচ্চিত্রটির সঙ্গীতটি সৃষ্টি করেছিলেনইরান, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও ইরাকের সহযোগিতায় প্রযোজিত হাফ মুনফিল্মটি ইরানী কুর্দিস্তানেই সম্পূর্ণভাবে শুটিং করা হয় যাহোক, ছবিটিতে ইরানি কুর্দি সঙ্গীতশিল্পীদের একটি গ্রুপের বিবরণ বর্ণনা করা হয় , যারা ইরাকি কুর্দিস্তানে ভ্রমণ করতে এবং সেখানে একটি কনসার্ট পরিবেশন করতে ইচ্ছুক। ২০০৬ সালে, সেন্সরশীপের সূচী ঘোবাদিকে তার ফিল্ম  ‘টার্টলস ক্যান ফ্লাইয়ের মাধ্যমে মত প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার  জন্য ইনডেক্স ফিল্ম এওয়ার্ড প্রদান করে
২০০৯ সালের মে মাসে, তার চলচ্চিত্রনো ওয়ান নোজস এবাউট পার্সিয়ান ক্যাটসকান ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রিমিয়ারে একটি আন সার্টেন রেগার্ড স্পেশাল  জুরি এওয়ার্ড জিতে নেয়এই মুভিটিতে ঘোবাদি নিজেই বাস্তব মিউজিশিয়ান ও ব্যান্ডের সঙ্গে কাজ করেছেন। এখানে চরিত্রগুলোর  ভিসা পাওয়ার প্রচেষ্টা এবং নিজ দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ খোঁজার আইডিয়াটির বিস্তার ঘটাতে পুরো সময়টি জুড়ে তাদেরকে ঘোবাদি  ক্যামেরা দিয়ে অনুসরণ করেছেন । চলচ্চিত্রটির কাহিনী মূলত দুজন অল্প বয়সী সঙ্গীতশিল্পী আশকান ও নেগারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে , তারা একটি ব্যান্ড গঠন করে এবং কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেই ইরান ত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত হয়। এই শিল্পী জুটি নাদের (হামিদ বিনদাদ) নামক একজনের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। নাদের ছিলেন একজন গুপ্ত সংগীতপ্রেমী এবং প্রযোজক। যিনি তাদেরকে তেহরান এবং  এবং তার   পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ভ্রমণ করতে সাহায্য করে যাতে তারা অন্যান্য আন্ডার গ্রাউন্ড  সঙ্গীতশিল্পীদের পরিচিত হতে পারে এবং ইরান ত্যাগ করার পর সকলে মিলে একটি মিউসিক্যাল ব্যান্ড তৈরি করতে পারে। এই চলচ্চিত্রটিতে ইরানী সঙ্গীত শিল্পীদের কঠোর শাস্তিগুলির মুখোমুখি হওয়ার যে ধারাবিবরণী  বর্ণনা করা হয় সেখানে দেখানো হয় কি উপায়ে তারা সেন্সরশিপ এড়াতে চায়
‘নো ওয়ান নোজস এবাউট পার্সিয়ান ক্যাটস’ মুক্তি পাওয়ার পরেই তাঁকে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, -  জোরের সঙ্গে জানাতে চাই, ইরানে আর ফিরতে না পারার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম; আর ফিল্মটি বানানোর ঝুঁকি নিয়েছি সব জেনে-বুঝেই। তবে এ কথাও বলতে চাই, দেশ ছেড়ে চলে আসার উদ্দেশ্যে আমি ফিল্মটি বানাইনি। আমি এবং আর যত মিউজিশিয়ান ও আর্টিস্ট এ মুহূর্তে দেশের বাইরে আছেন, তার নেপথ্য কারণ, তারা নির্বাসনে আসতে বাধ্য হয়েছেন। দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে আমাদের। আমি বাধ্য হয়েছি, কেননা আমি আর মিথ্যাচার করতে চাইনি। আপনি যদি সৎ এবং সত্যবান থাকতে চান, তাহলে সেই (ইরানি) সমাজে ও সেই সিস্টেমে টিকে থাকার কোনো উপায় পাবেন না। আমি জানতাম, দেশত্যাগ না করলে আমাকে বরণ করতে হতো জাফর পানাহির (ইরানি ফিল্মমেকার) ভাগ্য। আমি বলতে চাই, স্রষ্টা সবাইকে স্বাধীনতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আমরা সবাই জন্মগতভাবেই স্বাধীন; আর আমরা এমন একটা বাজে পরিস্থিতিতে রয়েছি, যেখানে মানুষকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, যা নিশ্চয়ই স্বয়ং স্রষ্টাও চান না। মানুষ নিয়ন্ত্রিত হয় তার নিজস্ব নিয়মে। কিন্তু এখন আমরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি অন্য মানুষদের হাতে, যারা কিনা আমাদের তা হতে বাধ্য করছে।
প্রকৃতপক্ষে ঘোবাদির প্রত্যেকটি সিনামাই এক একটি অনবদ্য সিনামাতবু ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে। এটি আমার দেখা সিনামাগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রিয় ছবি।  নাটক বা সিনামার মর্মস্পর্শী দৃশ্য দেখে কাঁদা আমার পুরাতন অভ্যাসতবে কিছু কিছু সিনামা আছে যেগুলো প্রত্যেক দর্শককেই কাঁদায়। বাহমান ঘোবাদির ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ ছবিটি সেরকমই একটি ছবি২০০৪ সালে কুর্দি যুদ্ধের সময় ইরাক আর টার্কি বর্ডারের একটি ছোট্ট গ্রামের  রিফিউজি ক্যাম্প নিয়ে তৈরি করা টারটেলস ক্যান ফ্লাই ফিল্মটি বাহমন ঘোবাদির লেখা ও পরিচালনা করা একটি ড্রামা ফিল্মসাদ্দাম হোসেনের পতনের পর এটি ইরাকের প্রথম ছবি ছিলো। এটি ইরাকের এমনই একটি মোহিত করা চলচ্চিত্র যা শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত শিশুদের নৃশংসভাবে ভঙ্গুর জীবন নিয়ে  তৈরি করা হয়েছিলো। ফিল্মটি স্বৈরাচারী ও মুক্তিযোদ্ধাদের উভয়ের পতনের সাথে সম্পর্কিত একটি ফিল্ম। যুদ্ধ ব্যাপারটা এমনই যা নারী ও শিশুর জীবনকে একেবারে তছনছ করে দেয়। যুদ্ধ জীবনকে একেবারেই বিপন্ন, বিপর্যস্ত ও অসহায় করে তোলেশান্তিপ্রিয় মানুষ মাত্রই যুদ্ধকে ঘৃণা করতে বাধ্য কিন্তু পৃথিবীর যে সমস্ত যুদ্ধবাজ মোড়লরা ক্ষমতার দম্ভে শোষণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তারাই পৃথিবীজুড়ে  কোথাও না কোথাও যুদ্ধের দামামা বাজিয়েই চলেছেআর এইসব যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় একের পর মর্মস্পর্শী সিনামাতেমনই  একটি মর্মবেদনার ছবি এই ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ যুদ্ধের যে কোন ছবি দেখাই মানেই আসলে মনকষ্টের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া আর বিশেষ করে ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ ছবিটি যারা দেখেছেন তারাই শুধু জানেন এটি দর্শককে কি নিদারুণ মনঃযন্ত্রণার মধ্যে  ফেলে দেয়   ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই  ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে ইরাকি-তুর্কি সীমান্তে কুর্দি শরণার্থী ক্যাম্পে শিশুদের উপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার ঘটনা আর  বুঝতে পারি যুদ্ধ সাধারণ মানুষের জীবনকে কিরকম বিপর্যস্ত করে তোলে বিশেষ করে শিশু-কিশোরদের জীবনকে । এটি ইরাক-তুর্কি সীমান্তের এমনই একটি  হতদরিদ্র গ্রাম যেখানে বিদ্যুৎ বা পানি সরবারহের কোন ব্যবস্থা নেই এমনই একটি গ্রামের শিশুদের যুদ্ধ পরবর্তী জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ফিল্মটির পটভূমি । তের বছর বয়সী স্যাটেলাইট (সোরান ইব্রাহিম) গ্রামের একটি বাড়ির ছাঁদে ডিশ অ্যান্টেনা প্রতিস্থাপন করে । কুর্দির রিফিউজি ক্যাম্পের সাধারণ জনগণ যারা সাদ্দাম হোসেনের খবর জানতে চায় এবং জানতে আগ্রহী কখন আমেরিকা ইরাককে আক্রমণ করবে? তাদের সমস্ত কৌতূহল মিটাতে সক্ষম শুধুমাত্র স্যাটেলাইট। ফলে সে তাদের কাছে একজন ভীষণ জনপ্রিয় মানুষ স্থানীয় লোকের কাছে তার জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ হচ্ছে সে অল্পবিস্তর ইংরেজিও জানতো। স্যাটেলাইট ছিল অত্যন্ত চটপটে প্রগ্রতিশীল এবং বুদ্ধিমান একটি বালক সে স্থানীয় শিশুদের নিয়ে খুব বিপদজনক কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ মাইনফিল্ডের মাইন অপসারণের কাজ শুরু করে । এই শিশুদের মধ্যে বেশিরভাগ শিশুই কোন না কোনভাবে শারীরিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত । স্যাটেলাইট স্থানীয় বাজারে অবিস্ফোরিত মাইন বিক্রয়ের ব্যবসা শুরু করে  সে অন্যান্য বাচ্চাদের উপর নানাভাবে ওস্তাদি করতো এবং তাদেরকে নিজের সুবিধামতো ব্যবহারও করতো। যদিও এই বাচ্চাদের মধ্যে অনেকেই যুদ্ধের সময় ল্যান্ডমাইন ব্লাস্টের ফলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ  হারিয়েছিল তবু তারা প্রতিনিয়ত স্যাটেলাইটকে খুশী  করার চেষ্টা  করতো এবং যখনই সুযোগ পেতো স্যাটেলাইটের নানা কাজে নিজেদেরকে উৎসর্গ  করতে পিছুপা হতো না। গ্রামের লোকজন যারা ইংরেজি বুঝতো না অথচ ভীষণ কৌতূহলী ছিল জানার জন্য যে কখন অ্যামেরিকা ইরাকের উপর হামলা করে তাদেরকে উদ্ধার করবে তারাই সবচেয়ে বেশী স্যাটেলাইটের উপর নির্ভর করতোএদিকে এক পা ওয়ালা সাদ্দাম হোসেন ফেইসাল এবং দুঃখী  শির্কো (আজিল জিবারি) এই দুই বন্ধু সবসময় স্যাটেলাইটের সহযোগী হিসেবে তার আসেপাশে ঘুরঘুর করতো । তারাই আবার রিফুইজি বাচ্চাদের কাজ পেতে এবং কাজের মজুরী আদায় করতে সাহায্য করতোবহুদিন থেকে  একাই রাজত্ব করা রিফিউজি বাচ্চাদের সর্দার  স্যাটেলাইট হঠাৎ একদিন  খেয়াল  করে যে একটি অপরূপা সুন্দরী কিশোরী মেয়ে অর্গিণ অন্ধ শিশু বাচ্চা রেগা (আব্দুল রহমান কারিম) কে কোলে নিয়ে এবং যুদ্ধে বোম ব্লাস্টে দুহাত হারানো ছোট ভাই হ্যাঙ্গাও ( হিরেস ফেইসাল রাহমান) কে নিয়ে রিফিউজি ক্যাম্পে এসে হাজির হয়েছে। স্যাটেলাইট যখন দেখে হাতহীন হ্যাঙ্গাও  মুখ দিয়ে পিন বের করে ল্যান্ডমাইনগুলোকে অকার্যকর করে চলেছে তখন সে খুশী না হয়ে বরং হ্যাঙ্গাওকে শুত্রু ভেবে তাঁকে হিংসা করতে থাকে। হাতহীন ছেলেটির  আরেকটি গুণ ছিল আর সেটা হচ্ছে সে ভবিষ্যৎবানী করতে পারত। হ্যাঙ্গাও স্যাটেলাইটকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিল যে, সে যেন   যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই পুরো এলাকাটা বিস্ফোরিত হওয়ার আগেই বাচ্চাগুলোকে ট্রাকে লোড করে  নিয়ে অন্য কোন এলাকায় চলে যায়। যেহেতু সবাই বুঝতে পারছে যে এই সমগ্র এলাকাটা ভীষণ  বিপদজনক তাই যে আবারও মনে করিয়ে দেয় যে কুর্দিরা তাদের কাছে কিছুদিন আগে কেমিক্যাল এটাক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য গ্যাস মাস্ক বিলি করেছে ফলে তার বোঝা উচিত যে এই এলাকাটি খুবই বিপদজনক


মাস্ক হাতে পেয়ে প্রথমেই স্যাটেলাইট সুন্দরী কিশোরী অগ্রিনকে একটি মাস্ক উপহার দেয় এবং প্রমিস করে তার অন্ধ বাচ্চার জন্যও একটি গ্যাস মাস্ক  জোগাড় করে আনবে এরিমাঝে একদিন দেখা যায় যে অ্যামেরিকান হেলিকপ্টার রিফিউজি ক্যাম্পের উপর দিয়ে চক্কর দিচ্ছে এবং তারা হেলিকপ্টার থেকে লিফলেট ফেলছে যেটিতে লেখা আছে “ আমরা তোমাদের সব সমস্যার সমাধান করে তোমাদের দেশকে প্যারাডাইস বা স্বর্গে পরিণত করবো । আমরা পৃথিবীর সেরা জাতি।” অ্যামেরিকান সৈন্যদের এসব কথা কিশোর স্যাটেলাইট ও তার সাগরেদের কাছে সত্যি বলে মনে হতে থাকে ।   
ছবিটি মূল চরিত্র ১০ বছর বয়সের শিশুকন্যা অগরিন , যে যুদ্ধের সময় ইরাকী মিলিটারি দ্বারা তাঁর চোখের সামনে বাবা- মাকে হত্যা হতে দেখে এবং সে  নিজেও গ্যাং রেপ্টড হয় সেই গণধর্ষণের ফলেই অন্ধ শিশু রিগার জন্ম হয়। অগরিন  রিগাকে তার ছোট ভাই হিসেবে সাবার কাছে পরিচয় দেয়  কিন্তু মনে মনে সবসময় সত্য ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকে। সে মনে করে তার সব দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী রিগা আর গ্রামবাসী যদি  রিগার জন্মবৃত্তান্ত ও আসল পরিচয় জেনে যায় তাহলে তাঁকে তারা ভীষণ ঘৃণা করবে এবং সবকিছুর জন্য তাকেই দোষী সাব্যস্ত করবে । ফলে সে রিগাকে মনে মনে খুব  অপছন্দ করতো এবং নানাভাবে চেষ্টা করতো রিগার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ারএদিকে হ্যাঙ্গাও বোনের মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে সবসময়  রিগাকে পাহারা দিতে থাকে এবং বোন যেন কোন অঘটন করতে না পারে সেদিকেও নজর রাখে। তাই বোনকেও চোখের আড়াল হতে  দেয়না। কিন্তু যেহেতু তার নিজের দুটি হাত নেই ফলে সে সবসময় তাঁর বোন ও বোনের ছেলেকে সাহায্য করতে পারেনা বলে হীনমন্যতায় ভুগতে থাকে। এদিকে অগরিন অন্ধ শিশু রিগাকে কিকরে তার জীবন থেকে সরিয়ে ফেলবে সারাক্ষণ সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়ে এভাবে বহুবার চেস্তায় ব্যর্থ হওয়ার পরও সে হাল ছাড়ে না। আর এভাবেই একদিন সুযোগ বুঝে সে রিগাকে তুর্কীর বর্ডারের একদম কাছে যেখানে অসংখ্য মাইন পুঁতা আছে  সেখানে ফেলে আসেসে ভেবেছিল মাইন ব্লাস্ট হয়ে রিগা মারা যাবে আর তার রিগাকে নিয়ে ভোগ করা সমস্ত যন্ত্রণার পরিসমাপ্তি ঘটবেকিন্তু সৌভাগ্যবশত এ যাত্রায়  রিগা বেঁচে যায় এবং একজন তুর্কী গার্ড তাকে উদ্ধার করে  স্যাটেলাইটের কাছে হস্তান্তর করে। স্যাটেলাইট রিগাকে অগরিন  কাছে ফিরিয়ে দেয় এবং নানাভাবে তাঁকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। এমনি করে একদিন দেখা যায় যে সে  অগরিন তার প্রতি আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করার জন্য একটি গভীর পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে লাল মাছ ধরে এনে  অগরিন উপহার  দিতে চায় কিন্তু দুঃখী ও নিরাশ অর্গিণ স্যাটেলাইটের আসার আগেই দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। সে কিছুতেই তার চোখের সামনে তার বাবা-মার হত্যা হতে দেখা এবং ইরাকী সৈন্য দ্বারা গণভাবে ধর্ষিত হওয়ার কথা ভুলতে পারেনা। অগরিন মধ্যে আমরা একটি  আশাহত দরিদ্র ও অসহায় হতবিহবল কিশোরীকে দেখতে পাই যা আমাদেরকে শিশুদের অসহায়ত্ব নিয়ে  ভাবিত করে  

অগরিন নানা উপায়ে রিগাকে তার জীবন থেকে সরাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত তাকে একটি বড় পাথরের সাথে বেঁধে লেকের গভির জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়  এবং নিজে পাহাড়ের উঁচু চূড়া থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে।  এদিকে হ্যাঙ্গাও স্বপ্নে তার প্রিয় মানুষকে ডুবে যেতে দেখে ঘুম থেকে চমকে ওঠে।  তৎক্ষণাৎ সে তাঁবু থেকে বেড়িয়ে অর্গিণ ও রিগাকে খুঁজতে থাকে। হ্যাঙ্গাও রিগার বিপদ বুঝতে পেরে লেকের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং রিগাকে পাথরের সাথে বাঁধা অবস্থায় জলের নিচে খুঁজে পায় কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তার দুটি হাত না থাকায় অনেক চেষ্টা করেও পাথরের সাথে শক্ত করে বাঁধা রিগার বাঁধন আলগা করতে পারেনা এবং তাকে বাঁচাতেও পারেনা। এরপর সে অগরিনকে খুঁজতে খুঁজে পাহাড়ের চূড়ার কাছে এসে দেখে অগরিন সেখান থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। এসব ঘটনার মধ্যেই দেখা যায় অ্যামেরিকার সৈন্যরা গ্রামে ঢুঁকে গেছে । অথচ এতদিন থেকে প্রতীক্ষারত হতবিহবল স্যাটেলাইট এতসব ঘটনা চোখের সামনে দেখার পর জীবনের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে বসে এই হচ্ছে মূলত বাহমান ঘোবাদির পরিচালিত বার্লিন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্তিভ্যাল ২০০৫ এর পিস ফিল্ম এওয়ার্ড সহ ১২ টি এওয়ার্ড পাওয়া ‘টারটেলস ক্যান ফ্লাই’ ছবিটির মূল কাহিনী।  বাহমান ঘোবাদি 'টারটেলস ক্যান ফ্লাই' ছবিটিতে পানির নীচের একটি সংক্ষিপ্ত পরিণতির বর্ণনা দিয়েছেন যেখানে একটি কচ্ছপ তার নিজের পরিসীমায় ধীরে ধীরে হেঁটে যায় এবং এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পদক্ষেপ অনায়াসেই তার ভয়ানক ওজনের খোলসকেও বহন করতে পারে।  তিনি কুর্দিদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে ছিলেন কিভাবে অভিবাসন ও গণহত্যা প্রজন্মের পর প্রজন্মের উপর ক্যারাটিনের বর্মের মত জড়িয়ে থাকে কিন্তু কচ্ছপের মতো তারাও কীভাবে এই বোঝার দায়  থেকে নিজেদেরকে উত্তরণ  করেছিলো সেটাই ছবিতে দেখানো তাঁর মূল উদ্দেশ্য ছিলো। 


টারটেলস ক্যান ফ্লাইকোন রাজনৈতিক ছবি নয় , আবার এটি কোন কিশোরকিশোরীর মধ্যেকার প্রেমের ছবিও নয়। বরং এটি হ্যালাবচেহ গ্রামে বেঁচে  থাকা ও যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কিছু শিশু- কিশোরের জীবনের বাস্তবতা নিয়ে তৈরি একটি মর্মস্পর্শী ছবি।  এটি একটি অত্যাচারের  ও স্বৈরশাসনের গল্প। যখন রাষ্ট্র নিজেই তার পৃষ্ঠপোষকদের উপর নিপীড়ন চালায় এবং কুর্দিস্তানের উদ্বাস্তুরা এক নিদারুণ অসহায়ত্বের মুখে পড়ে তাদের জীবন অতিবাহিত করে। এসব বিষয়ই তখন ঘোবদির চলচ্চিত্রগুলির অতি সাবধানে তৈরি করা প্লটগুলোতে আরও নিষ্ঠুর শক্তির আবির্ভাব হতে সাহায্য করে যা মূলত একসময় তাঁর ফিল্মগুলোর অনুপ্রেরণারই বিষয় হয়ে ওঠে 

বাহমান ঘোবাদির মুভি দেখা মানেই জীবনের নিদারুণ বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়া। নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি করা তাঁর একেকটি ছবি দেখা মানেই একটি নতুন মাত্রার সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার অনুভুতি। মুভি দেখার ভক্ত দর্শকদের নিঃসন্দেহে তাঁর পরিচালনা করা প্রত্যেকটি ফিল্মিই যে ভালো লাগবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।












0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন