কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৮

সুনীতি দেবনাথ




কতিপয় চিল শুধু বলেছিল শুভ জন্মদিন



কবি বিনয় মজুমদার মায়ানমারের মিকটিলা জেলার টোডো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা বিপিনবিহারী মজুমদার, মা বিনোদিনী। তাঁরা ছিলেন ছয় ভাই-বোন এবং তিনি ছিলেন সবার ছোট। ১৯৩৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম হয়েছিল। পঞ্চাশের দশকের কিংবদন্তি কবি তিনি মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে  (বর্তমান) চলে এসে এখানেই বাল্যশিক্ষা কৃতিত্বের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। দেশবিভাগের জন্য ১৯৪৮ সালে সপরিবারে তাঁরা কলকাতা চলে আসেন। অসাধারণ মেধাসম্পন্ন বিনয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতে রেকর্ড নম্বর পান কিন্তু  পেশায় ইঞ্জিনিয়ার হয়েও সারাজীবন কাটিয়েছেন কবিতার সাধনায়

অকৃতদার এই কবির শেষ জীবন বড় দুঃখের, অসুখে-নিঃসঙ্গতায় মৃত্যুর বছর খানেক আগে তাঁকে দুটি বড় পুরস্কার রবীন্দ্র পুরস্কার এবং একাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয়। ষাটের দশকের পরে অসুস্হতার জন্য কবিতা লেখা কমে গিয়েছিল মোট কাব্যগ্রন্থ কুড়ির কাছাকাছি, যার মধ্যে 'ফিরে এসো চাকা' তাঁকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছে জ্যোতির্ময় দত্ত একে 'গুপ্ত ক্লাসিক' বলেছেন এর নামহীন  কবিতাগুলি সংখ্যাক্রমে চিহ্নিত, নিচে তারিখ দেওয়া 'মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত  সারস উড়ে যায়', প্রবাদসম এই পংক্তি সেই বইয়েরই মৌলিক প্রতিমা নির্মাণ,  বিশিষ্ট অন্বয় এবং ভাবের ও আবেগের তীব্রতা ও নিবিড়তা তাঁর কবিতাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে অল্পস্বল্প প্রবন্ধও লিখেছেন, পাশাপাশি কিছু অনুবাদগ্রন্থও রুশ ভাষা শিখেছিলেন যা অনুবাদের কাজে লেগেছিল। জীবনানন্দের কবিতার কথা  যেমন তরুণ কবিদের শিক্ষা ও প্রেরণা দেয়, বিনয়ের নির্বাচিত প্রবন্ধও তেমনি হয়ে উঠতে পারত, যদি আরও একটু যত্নের সঙ্গে সংকলিত হতইঞ্জিনিয়ারিং পেশা ত্যাগ করলেও, বিজ্ঞানের শিক্ষাকে ভোলেননি তিনি। তাঁর চোখে, 'গণিত ও কবিতা একই জিনিস' আমৃত্যু গণিত ও কবিতার দ্বারা তাড়িত'ফিরে এসো চাকা' ছিল তাঁর অতি জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ।

বৌলতলি হাই-ইংলিশ স্কুলের ম্যাগাজিনে তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট কলেজে অল্প কিছুদিন শিক্ষকতা করার পর স্থির করেন শুধুই কবিতা লিখবেন। লেখা শুরু করেন 'ফিরে এসো চাকা' এই সময় তিনি দুর্গাপুর স্টিল প্লান্টেও কিছুদিন কাজ করেন। তখন থেকেই মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা যায়। ১৯৬৬ সালে লিখতে শুরু করেন 'আঘ্রাণের অনুভূতিমালা' 'ঈশ্বরীর  স্বরচিত নিবন্ধ'বিশটির কাছাকাছি কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন। যার মধ্যে ‘ফিরে এসো চাকা’ তাঁকে সবচেয়ে বেশি খ্যাতি দিয়েছে। এছাড়াও নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, আমাদের বাগানে, আমি এই সভায়, এক পংক্তির কবিতা, আমাকেও মনে রেখো - ইত্যাদি রচনা করেছিলেন। ১৯৬২-৬৩ সালে বিনয় মজুমদার হাংরি আন্দোলন-এ যোগ দেন এবং তাঁর কয়েকটি কবিতা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিলপরবর্তীকালে, অর্থাৎ ১৯৬৩ সালের শেষ দিকে তিনি শক্তি  চট্টোপাধ্যায়  এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়-এর কার্যকলাপে বিরক্ত হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে একটি হাংরি বুলেটিন প্রকাশ করে কলকাতা কফিহাউসে বিলি করার পর হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন নিঃসঙ্গ জীবনে শারীরিক ও মানসিক চরম ভোগান্তির পর তিনি ২০০৬ সালে পরলোক গমন করেন।



এখানে বিনয় মজুমদারের দুটি কবিতা তুলে দেওয়া হলো-


আর যদি নাই আসো

আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচারী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো না-ই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি; কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো; আশ্চর্য দর্শন। বহু আছে
নিজের চুলের মৃদু ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনা আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফুট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে


ফিরে এসো চাকা  

ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ'রে যায়
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।
এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়
কখনো ওড়ে না; তবু ভালোবাসা দিতে পারি আমি।
শাশ্বত সহজতম এই দান - শুধু অঙ্কুরের
উদ্গমে বাধা না দেয়া, নিষ্পেষিত অন্যলোকে রেখে
ফ্যাকাশে হলুদবর্ণ না-ক'রে শ্যামল হতে দেয়া।
এতই সহজ, তবু বেদনায় নিজ হাতে রাখি
মৃত্যুর প্রস্তর, যাতে কাউকে না ভালবেসে ফেলি।
গ্রহণে সক্ষম নও। পারাবত, বৃক্ষচূড়া থেকে 
পতন হলেও তুমি আঘাত পাও না, উড়ে যাবে।
প্রাচীন চিত্রর মতো চিরস্থায়ী হাসি নিয়ে তুমি 
'লে যাবে, ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি।




                                 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন