‘ডুমুরের
আয়ু’র সঙ্গে পাঠবাস
বেদনারা এখানে আরও একাগ্র আরও নিবিষ্ট। এ
ঈশ্বরের পরম দান। ক’জনারই বা সৌভাগ্য হয় এতটা বেদনার রক্ত
পিছল পথে ঢেলে দিতে পারা হৃদয়ের সবটুকু উষ্ণতা? বেদনার সবটুকু মন্থন কিংবা কীর্তি দিয়ে
গৌরবোজ্জ্বল করে তোলা যায় কত আর যাপনের ইতিহাস? তবু ইতিহাস লেখা হয়। পার্থিব জীবনের
যাবতীয় দ্রোহ ক্ষয় কিংবা লয় প্রেম কিংবা পরাজয় কি নয়? কি নেই? সবই তার ইতিহাস। যদি লিখে দিতে পারা যায়
সবটুকু সত্যাসত্য। আমি তাকেই বলি কবিতা। সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। অক্ষরে অক্ষরে বুনে
রাখা। একা একা হিসেব করা। ছন্দে ছন্দে দোলা দেয়া। উপমায় উৎপ্রেক্ষায় শব্দ আর
অর্থের অলংকারে নববধূর মতো করে তোলা, আহা বেদনা আমার। সেই তো ইতিহাস— সেই কবিতা। কখনো দিয়ে যাওয়া পায়ে পায়ে চলার পথেরও দিশা। কখনো খরগ হাতে দাঁড়ানো
যাবতীয় অত্যাচার কিংবা অন্যায় হত্যার যজ্ঞে। কখনো কখনো যাতনায় বিষণ্ন গোলাপ
ফোটানো। আবার সেই গোলাপের কাঁটায় রক্তপ্লাবন বয়ে দিয়ে তাতেই স্নান করে শুদ্ধ হয়ে
ওঠা সেই কবিতা। তাই যা যা পড়বার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাই এইসব এত এত তাতে আমার সংলগ্ন
হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে নেশাসক্তের মতো এগুতে হয় আমাকে
অক্ষরে অক্ষরে...
পায়ে পায়ে মধু
লেগে থাকে
রূপপুরের ঘাটে।
এ গ্রামে রমণীরা
বাঁশফুল খোঁপায়
গোঁজে আর
মাটি দিয়ে চুল
ধুয়ে রাখে!
(মধুগ্রাম/ডুমুরের আয়ু)
অসাধারণ উপমা আর
চিত্রকল্প এখানে চিরায়তের বিপরীতে। চিরকাল মুখে মধু—বুকে মধু কী অবলীলায় এসে জায়গা করে
নিয়েছে একেবারে পায়ে— রূপপুরের রমণীর পায়ে। খোঁপায় বাঁশফুল
গুঁজে একইভাবে রূপের বিপরীতে গিয়ে মাটি দিয়ে চুল ধুয়ে রূপপুরের রমণী ভেসে ওঠে এক
অপরূপ বেদনার ছবি হয়ে। ধীরে ধীরে তার গভীরে কান্নার জল ছলছল শব্দ শুনতে পাই এখানে
এসে—
সেই এক প্রাচীন মহুয়াবাগানে
অন্নদাসুন্দরী
একা একা হাঁটে...
আর তারপর বাকি যা সব যাতনার বিষণ্ন
দিনযাপন উঠে আসে শেষ লাইনটিতে—
এ গ্রামে মধু, ঠোঁটে নয়—
পায়ে লেগে থাকে।
প্রতিটি কবিতাই
জীবনের এক একটি অংশবিশেষ। হয়তো কবিরই। হয়তো আমি পাঠক আমারই। কিংবা অন্য কারো এবং
তারই দিকে আমার বরাবর ঝোঁক থাকে বেশি যে কোনো পাঠেই। আমি তারপর কবিতার নাম দেখেই
আগাই গল্পাংশের দিকে—
তোমার কোনো
গল্পে যিশু হাঁটেন না।
আমি হাঁটি।
গভীর এখানে
প্রেমিকের আত্মবিশ্বাস। মনে পড়ে যায় নজরুলের বিখ্যাত সেই গান— ‘তুলসীতলায় যবে সন্ধ্যা বেলায়/তব দেবতার নাম নিতে ভুলিয়া বারেক/নিও মোর নাম’।
নিঝুম নীরবে
প্রিয়তমের বাস। ঈশ্বরের পুত্রের পাশে কিংবা তারও খানিক উপরে প্রিয়ার মনে তার
নিজস্ব অবস্থান। নিদারুণ দুঃসহ যাতনায় অক্লান্ত প্রাণ। প্রেমিক এখানে নিশ্চিত
গল্পে প্রিয়তমা ঈশ্বরের পুত্রের নামের বাতাবরণে লিখেছেন তারই নাম। নিঝুম নীরবতায়
কোনো এক গভীর মৌন অবসরে আমি যেমন তপস্যা করি পরমাত্মার। জীবের শরীরে যার আধাআধি
বাস। সম্পূর্ণ হবার জন্য যার চিরকালের বাসনা। আমিও যাপিত জীবনের কোনো এক গভীরতায়
বুঝি পরমাত্মাতেই সমর্পন করে বসি নিজেরই সব-বর-মালা-প্রেম-আর আমার যত বর-মালা-জপ-পূজা-অর্ঘ্য। তারই যেন এক সুকঠিন ছায়া দেখতে পাই। খুব নীরবে কোনো এক
ধ্যানভঙ্গের অসাবধানতায় টের পেয়ে যান সব— সেই পরমাত্মা যিনি পরম পূজায় ব্যপ্ত এই
ছোট্ট মানব শরীরে। আর সঙ্গে গভীরে টের পাই মাটির শরীরে শূন্যের আরাধনা—
আমার কৃষিগন্ধা
হাত—
ছুঁয়ে আসে— তোমার মাটিমগ্ন মৌনতা
মাটির শরীর বেয়ে
কৃষকের হাত। চাষে উন্মুত মাটির খামার। যেন ইড়া পিঙ্গলা আর সুষুম্নার ক্রিবেণী
সঙ্গমে নির্বাণ লাভের মোহে মুগ্ধ এক জটিল তন্ত্রসাধক। সহজিয়ার এক অনন্য আধুনিক
রূপায়ণ—
চোখের কোণে এক ফোঁটা জল
তাপ ও হাওয়ায়
রেখা হয়ে
ফুটে থাকে লতা ও
পাতায়!
অনেকটা পথ হেঁটে
এসে আমরা—
বসি। যিশু বসেন।
মৃদু হাসেন।
তোমার ধ্যান ও ধারণায় আমি
নতুন কোনো গল্প
হয়ে যাই...
(গল্পাংশ / ডুমুরের আয়ু)
প্রবহমান জীবন
এমনিতেই এক নিরন্তর গল্প। তারই মাঝে প্রেম বিরহ আর যাতনার গল্পাংশগুলো খণ্ড খণ্ড
এক একটি জীবন। জীবনের গল্প কিংবা মৃত্যুর — ছোট্ট অসাধারণ এক ভালোবাসার ছবি দেখি
কবিতাটিতে। তার ঠিক পরেই বিপরীত প্রবাহ দেখি জীবনের। গল্পাংশের বিপরীত/বিপ্রতীপ গল্প। এখানে জীবনের গভীরে নারী বিচরণ করে নীরবে। কোথাও তার নাম নেই।
সে প্রজাপতি, সে মেঘ, সে ফুল, সে জলভরা কান্নার বিষাদঘন এক মেঘের
দুপুর। প্রিয়তমা হেঁটে চলে গোপনে শব্দে শব্দে নীরবে। কখনো সে মোহময় এক শ্রদ্ধায়
আসীন। ভালোবাসায় সুকোমল। কখনো প্রতারক আর কখনো বিনাশ কিংবা বিলাসে বিন্যস্ত এক
জীবন্ত নারী। লিখে চলেছে যে গল্পের পর গল্প অন্য আর এক জীবনে। ব্যতিক্রম এক ইমেজ
ভিজ্যুয়ালাইজ করি এ কবিতার দুটো লাইনে—
হাওয়ার সান্ধ্য-বিকেলে—নদীতীরে
সূর্যকে ধরে
ঢুকিয়েছে ব্যাগের ভেতর
(বসন্তসূত্রে)
আর তার ঠিক পর পরই তার বিষণ্ন জীবন
যাপনের যাতনা কিংবা মিলিয়ে নেবার কিংবা মেনে নেবার কষ্টগুলো খুব বিষাদে ভরেছে—
আর নদীচিত্রে এঁকেছে ঢেউয়ের হাসি—
রঙে রঙে
রাঙিয়েছে তার আকাশপথ;
মেয়েটি হেসেছে
আর চোখ ভরেছে জলে।
(বসন্তসূত্রে)
কবিতাটিতে
প্রজাপতি, দেয়াল, মেঘ, পাখি, ফুল, শীতের বাগান, নদী, সূর্য, ঢেউ, আকাশ, কুয়াশা, বাগান, রাত— সব সুন্দর সুখকর মায়াময় আনন্দের উপকরণ
দিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিষাদঘন বেদনার গান। তাই এটি আমার কাছে অর্থ আর শব্দের বিপরীত
সহাবস্থানে অদ্ভুত ভালোলাগার একটি কবিতা হয়ে রইল।
নিরস পাহাড়ে দেখ
পুড়ে যায় জুম
কার বিরহে
দিনমান বৃথা চলে যায়
ক্ষয় ও ক্ষরণের
আগে ভাবমিলনের ছায়া
উড়িয়ে নেয়
গতজন্মের পাতার জীবনী।
(ভাবমিলনের ছায়া)
এই কবিতাটি পড়তে
থাকি আর মনে হয় আমি কোথায় দেখেছি এ জীবন। দেখেছি এর ক্ষয় আর লয়। একি আমারই জীবন
নাকি আমার কোনো প্রিয়তম সখীর কিংবা ভাইয়ের বোনের অথবা আরও কার! আর সত্যিই বয়ে চলেছি এ জীবন আর এক জীবনের সঙ্গে। এখানে পুড়েছে স্বপ্ন, স্বপ্ন দেখার সাধ আর অধিকার। যেন বনে ক্ষুধার্ত বাঘের আক্রমণের মুখে ভয়ে ভীত
দৌড়াতে থাকা হরিণীর মতো কম্পমান। ভালোবাসা বহমান—নিরন্তর—তবু কোন বিরহ কার বিরহ বৃথা করে দেয় সব
প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা। বয়ে নিয়ে চলে অর্থহীন দিন আমার! অবিরাম চলে কেবল ক্ষয় আর ক্ষরণ জীবনের পাতায় পাতায়...
আজকাল কবিতায়
দারুণ সব এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে ক্লান্তি আসে। আমি জোৎস্নায়
দেখতে পাই চাঁদের কিরণ যেমন, দেখতে পাই না অন্ধকারে পাখির পালক। ঝকঝকে
দিনে আমি ভাবতে পারি না চাঁদের মায়া। তাই যতই এক্সপেরিমেন্ট হোক হতে হবে বাস্তব, চেতন আর অবচেতনের মাঝে খুব ক্ষীণ কিন্তু গভীর এক মিল। থাকতে হবে ভাববার বা
কল্পনা করবার মতো কিছু সহজ ঐক্য। তবেই উপমা কিংবা রূপক কিংবা চিত্রকল্পের
সার্থকতা। নইলে সব এক্সপেরিমেন্টই অন্তত আমার মতো পাঠকের কাছে বিফল। এখানে আরও
ব্যতিক্রমী কিন্তু অসাধারণ একটি চিত্রকল্প আঁকা রয়েছে—
রেলপথ বুকের
ভেতর ঢুকে পড়ে
খুঁজে আনে
রূপগন্ধ হারানো সন্ধ্যা!
(রূপগন্ধ)
আমার ভাঙা হৃদয়
ক্লান্ত বিষাদ মন খুব গভীরভাবে ইমাজিন করতে পারে বুকের ভেতর ঢুকে পড়া রেলপথ। যে
রেলপথ কেটে গেছে জীবনের দিশা— সেখানে তো কেবলই নাটক। অভিনয়ে বেঁচে
থাকার পর পর চারটি কবিতায় গল্পের সুনম্র ভঙ্গিতে জীবনের গান গাইবার পর পাঁচ নম্বর
কবিতা রূপগন্ধে এসে দেখতে পাই খুব নম্রস্বরে সুতীব্র করুণ চিৎকার—
মায়া ও মাধবীতে
যতটা নৈঃশব্দ্যের ঋণ
কেবলই আগুন হয়ে
জ্বলে উঠছে এখন...
(রূপগন্ধ)
‘অন্ধত্ব’ কবিতার প্রথম লাইনটি আমাকে ভীষণ এক ধন্ধে
ফেলে দেয়—
অন্ধকার
প্রতিমার সামনে দাঁড়াই
(অন্ধত্ব)
প্রতিমাটি কি
অন্ধকারে রাখা আছে? নাকি তার মুখটি অন্ধকারে জমাট? দু’সেকেন্ডের দ্বন্দ্ব— আমি তীব্রভাবে বিভাজিত হয়ে পড়ি। পাঠকের জন্য আপাত বিরোধী এই দারুণ ইমেজ আমাকে
একই সাথে মুগ্ধ করে। অজস্র শুকনো পাতার ওপর রেখে দেয়া একটি চশমার ফ্রেম যখন আমি
ভিজ্যুয়ালাইজ করার চেষ্টা করছি তখনো বুঝিনি এই চশমার আড়ালে চোখ নেই। যুগযন্ত্রণা? যাপিত জীবনের প্রাত্যহিক ক্ষরণ? নাকি সময় সমাজ দেশ এবং ব্যক্তিগত
প্রাপ্তি আর প্রত্যাশার দুঃসহ সংঘর্ষে উপড়ে ফেলা সুকুমার বোধ আর বুদ্ধির নৃশংসতা, কি বুঝি আমি? রিসেপশন থিওরি আর কাজে লাগে না এখানে।
বিভ্রান্তিতে হারিয়ে যায় বোধের আড়ালে কোথাও—
অন্ধকার
প্রতিমার সামনে দাঁড়াই
চশমার ফ্রেম
মুছে রাখি পাতার ওপর—
অনেক শুকনো পাতা; যায় বসন্ত দিন।
সামনে
আঁধারপ্রতিমা—
আলোর বিপরীতে
আত্মহননের পথ...
উপড়ানো চোখ হাতে
নিয়ে—
কার সামনে
দাঁড়াবো এখন!
(অন্ধত্ব)
আরও এক জটিল যুগ
যন্ত্রণার সামনে এসে দাঁড়াই ‘ক্ষমা করো বাংলা বিভাগ’ কবিতাটি পড়তে এসে। একই সাথে ব্যাকরণগত এক ক্লাইমেক্সে পড়ে যাই। সাথে হারাতে
শুরু করি এক জটিল আত্মবিশ্বাসের তীব্র তীক্ষè শেকড়ের অস্তিত্ব। এ যাতনা আমি মনে করি
বাঙালি মাত্রই রয়েছে। যে বাঙালি আমি বাংলা ভালোবাসি, যে আমি ভাষা শহীদের কাছে আমার ঋণ স্বীকার
করি, যে আমি মনের আনন্দে মাকে মা বলে ডাকতে পারি আবার সন্তানের মুখে মা ডাকে আনন্দে
উদ্বেলিত হই— সব প্রবঞ্চণার কষ্ট ভুলে যাই। সেই আমি যদি দেখি আমার সন্তান বাঙালির
সন্তান নিজের ভাষাটা ঠিক মতো বলতে পারছে না। কিংবা বলবার আনন্দ পাচ্ছে না। কিংবা
বিদেশি ভাষার আড়ালে লুকিয়ে চুরিয়ে হারিয়ে ফেলছে আমার ভাষার আভিজাত্য— তা আমাদের জন্য যাতনার। যত্রতত্র বাংলা ভাষা ব্যবহারের যে মারাত্মক প্রয়াস— তার প্রতি ক্ষোভ উদ্ভাসিত রয়েছে ছোট মাত্র কবিতায়—
কার জন্য খুলে
রাখো ভাষার দরজা
মূর্খের চাদরে
ফোটাও ফুলের ফোয়ারা
দেখো জোনাকিরা
পড়তে আসে বনে
ছড়িয়ে যায় অমিত
আলোর বর্ণমালা...
দেখো যে শিশু
পড়তে শেখেনি আজো
মা ছাড়া
শুদ্ধভাবে কিছুই ডাকে না আর
কীভাবে শেখাবে
তাকে এইসব শাস্ত্র—
ভাষাজ্ঞান, উপমা-ছন্দ-অলঙ্কার...
চালাকের চরকিতে
নাচে তুরুপের তাস
মাটির গভীরে
লুকায় ভাষার বেদনা—
তুমিই মহৎ হও আর
খ্যাতিতে মহান
শেকড়ের কাছে
গিয়ে আমি হবো দাস!
(ক্ষমা করো বাংলা বিভাগ)
আত্মবিশ্বাস
হারাতে শুরু করি— এতকাল বাংলা সাহিত্য নিয়ে পড়েছি বলে। এত
এত ছন্দ নিয়ে কাজ কারবার। অথচ এখানে শুধু বিভ্রান্তি। ক্রমেই হারাই আর খুঁজে খুঁজে
সারা হই। আবার পড়ি আবার পড়ি এবং আবার। এ ছন্দ সে ছন্দ—পর্ব—মাত্রা— তবু কিছুতে কিছুই মেলাতে পারি না। সবশেষে
দারস্থ হই অক্ষরবৃত্ত সনেটের। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে যা খুব কঠিন লাগে। ভাবি এ
সনেট হবেই। আবার শুরু করি বদ্ধাক্ষর মুক্তাক্ষর গোনা। পর্ব ভাগ করা। ১৪ কিংবা ১৮
মাত্রার অন্তমিল খোঁজা। না কিছুতেই কিছু মিল পড়ে না। আত্মবিশ্বাস হারাতে হারাতে
এসে ঠেকে এখানে। কবির কারিশমার কাছে ঠেকে যায় সব। খুব সযত্নে এখানে কবি ভেঙেছেন
চিরায়ত ছন্দের মূল। গড়েছেন কিংবা লিখেছেন এক নতুন কবিতা। আপাতদৃষ্টিতে পড়লে মনে হয়
ছন্দে লেখা! কিন্তু এখানে ছন্দ নেই। আছে খুব শিল্পিত
প্রকরণে ছন্দ ভাঙা। এই হলো কবি শামীম হোসেনের কাব্যভাবনা কিংবা লেখনীর মুন্সিয়ানা।
এরকম বেশ কিছু কবিতা ডুমুরের আয়ুতে চোখে পড়ে।
চিরকালের মানবের
যাতনার অনুষঙ্গ কী কবির হৃদয়ে কী সাধারণ মানুষের হৃদয়ে সবারই কথা বলে গেছেন চিরকাল
এক-ই একজন, তিনি কবি। তাইতো সাধারণে তার এত আদর এত
ভালোবাসা আর এত বিনম্র শ্রদ্ধা। আমি লেখক থেকে এক সাধারণ পাঠক হয়ে যাই। প্রত্যন্ত
অঞ্চলের কিংবা দেশ বিদেশের কোনো পাঠকের ভালোবাসা যখন এক হয়ে মিশে যায়, কোনো কবির লেখায় জ্বলে ওঠে আমার ক্ষরণ কিংবা আমার লেখায় অন্যের ক্ষত তখনই তা
হয়ে ওঠে অসাধারণ। সাবলিমিশনে নিয়ে চলে আমি নামের পাঠককে কিংবা অন্য আরো কোনো
পাঠককে। তখন লেখক আর পাঠক একপ্রাণ-একমন শুধু দেহ দুই। অভিন্ন তার যাতনার বোধ। ক্রমাগত উর্ধ্বতর সত্তায় অবগাহন
ছাড়া আর কোনো গতি তখন নেই। প্রত্নবেদনা তেমনই এক কবিতা। মানুষের জীবনে বেদনা এক
অনস্বীকার্য আর তুমুল ঝড়বাদলের নাম। এত এত ক্ষরণে প্লাবনে যাপিত জীবনে এক চরম
ঋদ্ধি ছাড়া এ আর কিছু নয়। দেখা যায় কষ্টের আপাত প্রবাহে যে কেউ মুক্তির পথ খুঁজি।
সরিয়ে দিতে চাই জীবন থেকে দুঃখ যাতনার দাহ—
কেন যে মানুষের
ভেতরে আসো?
আর হৃদপিণ্ডে
বাসা বেঁধে ছড়িয়ে থাকো রক্তের ভেতর
কচুপাতার জলের
মতো টলমলে জীবনে সাজাও কেন—
রাত্রিদিন
বেদনাবাহিত বালুর সংসার!
(প্রত্নবেদনা)
মানুষের দেহ এক
জীবন্ত পুতুল। যখন অসহ্য ঠেকে তার আক্রোশ তখন বুঝি এক চেতন পুতুল থেকে তাকে আরেক
অবচেতনে কিংবা চেতনাহীনে পাঠিয়ে দিতে পারলে বাঁচে। আর এই বেদনার আস্ফালনে কেবল
বিধ্বস্ত আর ক্লান্ত হতে হতে নিদারুণ দ্বিধা আর দ্বন্দ্বে যাপিত কাল। তাই প্রশ্ন—
মিহি বাতাসে
ছড়িয়ে দিয়ে প্রত্নবেদনা
হৃদয়ে হৃদয়ে
জাগিয়ে যাও বিরহের বিষণ্ন সম্ভাবনা—
আর চোখের নীচে
নিকষ রাত্রির মতো কেন বসে থাকো!
এই প্রশ্নে
ক্ষতবিক্ষত প্রতিটি মানবমন। অথচ তাকেও আসলে চাই না দূরে রেখে দিতে। চাই পরম আদরে
নিজেরই বুকের নিভৃতে। দুঃখকে সব দোষ দেয়া শেষে আবার চাই যেন সে চলে না যায় আমারই
এই শরীর ছেড়ে। এই মনেই করুক নিত্য বাস—
বেদনা হে, সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নামো—
নেমে আর কোথাও
যেও না।
(প্রত্নবেদনা)
একেই বলি কবিতা।
আমার কাছে এক চিরায়ত শিল্পের নাম। এক ক্ল্যাসিক অনুভবের প্রকাশ। যা কবির নশ্বর এক
মানবদেহের বাতাবরণে দিয়ে গেছে চির অনশ্বর প্রাণ।
কিছুকাল শামীম
হোসেনের ‘ডুমুরের আয়ু’র সঙ্গে পাঠবাসের পর আমার সমগ্র পাঠকসত্তার সুগভীর নির্যাস থেকে একটা কথাই বলি— স্যালুট কবি। প্রণাম আপনাকে। আরো আরো বেদনার আশীর্বাদে আপনি পুষ্ট হয়ে উঠুন
অবিরত। আর লিখতে থাকুন অমর কাব্য আপন সাধনতত্ত্বে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন