প্রবাহ
‘মাই নেম ইজ ম্যাক, জেমস ম্যাক’, এভাবেই নিজের
পরিচয় দিত বছর বাইশের সদ্য তরতাজা যুবকটি। হাতে চেন বাঁধা, গলায় ভারী চেন, এক কানে
দুল, জেভিয়ার্স স্টুডেন্ট। সুমেধা, সুদেহী, মাঝে মধ্যেই গীটার হাতে নিজেই
গান কম্পোজ করে, গায়। স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েদের সমস্ত প্রেম উথলে উঠত
এই ম্যাককে দেখলেই। বাঙালি নারীর আকর্ষণ
ঠিক কোথায়, তার জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই ম্যাক। নিজেদের বয়ফ্রেন্ড অগ্রাহ্য করে মধুমাছির মতো ভিনভিন করত ম্যাকের
চারপাশে। কিন্তু ম্যাক? তার বক্তব্য, পুরুষ কখনো প্রেমে
পরে না। অধিকার করা আর রক্ষা
করাই শুধু জানে পুরুষ। ম্যাক কাউকে ব্যথা দেয়নি। অসংখ্য প্রেমিকা
প্রেম নিবেদন করেছ, কামনা করেছে, ভালোবাসা চেয়েছে। সকলকে স্নেহের সঙ্গে
পাশে রেখেছে। কারো অনুভূতিতে কোনো আঘাত না করেই সযত্নে ফিরিয়েছে তাদের। সব মেয়েদের পরম বন্ধু
থেকেছে, আর অবশ্যই সব ছেলেদের পরম শত্রু।
ম্যাকের পিতৃমাতৃ প্রদত্ত নামটিও যুতসই,
শ্রীপরমেশ্বর গাঙ্গুলী। এ নামে ম্যাকের কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু এত বড় নাম
বলতে শোনাতে শুনতে যতটা সময় অপচয় হয় ততটা অপচয় করার মতো সময় ওর নেই। তাই সাহেবি চালের ডাক নামেই পরিচিত হতে ভালোবাসে সে।
কলেজ পেরিয়ে ইউনিভার্সিটি। পড়ার সঙ্গে নেশা হয়ে দাঁড়ালো ফিল্ম তৈরি -- শর্ট, ডকু, স্বল্পদীর্ঘ। এ নিয়ে বিস্তর
পড়াশোনা করতে থাকে সে। সুন্দরী তন্বী। তন্বী মেয়েটির নাম। যাকে আর ফেরাতে
পারেনি ম্যাক। ইউনিভার্সিটিতে এসে আলাপ। তন্বী ওকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। অদ্ভুত আবেশ। যা থেকে ম্যাক আর বেরোতে চায়নি। একে প্রেম বলে? অনেকেই সাহস করে
বলার চেষ্টা করেছে, ‘ম্যাক সেই প্রেমে পড়লে তো?’ জবাব দেয়নি ম্যাক, শ্রীপরমেশ্বর গাঙ্গুলি।
তন্বীর আবেশ থেকে বেরোতে চায়নি। তন্বী উচ্ছল, চঞ্চল, ঝকঝকে আধুনিকা। ম্যাকের সঙ্গে
এতটাই মানানসই যে দুজনকে আলাদা দেখতে ইচ্ছে করত না ওদের বন্ধু বান্ধবদেরও। সুখ
বেশিদিন স্থায়ী নয় বুঝি, দুঃখ আচমকা নেমে আসে নিয়তির অমোঘ বিধানের মতো মানুষের
জীবনে। ইউনিভার্সিটি শেষ করে হঠাৎ কী কারণে পরমেশ্বর আর
তন্বীর সম্পর্কে চিড় ধরল, তা আজও সকলের
অজানা। তন্বী এখন স্থায়ী ভাবে বিদেশে। পরমেশ্বর বছর চল্লিশ বয়েসের তরুণ
যুবা। একই রকম রমণীমনোহর। ব্যস্ত নানা ধরনের ডকুমেন্টারি তৈরিতে। বেশ কিছু ডকুমেন্টারির জন্য নানা ধরনের পুরষ্কারও হাতে
এসেছে। একা মানুষ।
বছরখানেক আগে বাসস্ট্যান্ডে একা দাঁড়িয়ে। একটু
আনমনা। হঠাৎ একটি কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘আপনিই পরমেশ্বর গাঙ্গুলী?’ ঘুরে তাকালো পরমেশ্বর। হালকা গোলাপী পাড় সাদা ঢাকাই পরা একটি মেয়ে। বিস্মিত ও কৌতূহলী
চোখে তাকিয়ে। ‘তুমি চেনো আমায়? মাফ করো, তুমিই বলে ফেললাম’, পরমেশ্বর বলে। হাসে মেয়েটি,
‘শবরদের নিয়ে ডকুমেন্টারটা দারুণ লাগল!' ‘দেখেছো তুমি?’ হাসে গোলাপি পাড়ের সাদা
ঢাকাই। এতদিন পর পরমেশ্বরের কোথায় যেন একটা ভাঙ্গন শুরু হচ্ছে বলে বোধ হলো। এ তো সেই তন্বীকে নিয়ে যে আবেশ ছিল ঘোর ছিল, সেরকম কিছু নয়। এ যেন ঘোর কেটে যাওয়া
আবেশ ভেঙ্গে যাওয়া এক অন্য অনুভূতি। একে কী নাম দেবে সে? পড়ন্ত বিকেলে আলোয় ঝলোমলো
মুখ মেয়েটির। শহরের রাস্তার বিপুল কোলাহল কোথায় যেন আবছা হয়ে গেল। ‘আমার বাস এসে গেছে, আমি
চল্লাম’, বলে সাদা ঢাকাই বাসের দিকে এগোয়। পরমেশ্বর তাড়াতাড়ি নিজের কার্ড দিয়ে বলে ‘যোগাযোগ করবে আশা রাখি,
ওতে মেইল আইডি আছে; তোমার নাম?’ বাসটিতে অল্প ভিড়। পাদানিতে পা রেখে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে সাদা ঢাকাই বলে, ‘চূর্ণি’।
চূর্ণি! চূর্ণি নামটা ঘুরতে থাকে পরমেশ্বরের
মাথায়। বাড়িতে ফিরে মেইল
খুলে বসে থাকর। অসংখ্য মেইল উপচে পরছে। রীড করে ন। অপেক্ষা করেক। কোনো সাড়া শব্দ
নেই। সারাদিন নানা কাজের ফাঁকেও মেইল চেক করতে থাকে। নাহ! ফেসবুক অন করে চূর্ণি নামের প্রোফাইল খোঁজে। অসংখ্য
চূর্ণির ভিড়ে হারিয়ে যায় পরমেশ্বরের বুকে ঢেউ তোলা চূর্ণি নদীটি।
তিন চারদিন পর, রাত দশটা নাগাদ একটা মেইল ঢোকে
‘ভালো আছেন তো?’ চূর্ণি। বাইশ বছরের ম্যাক যেন মাথার মধ্যে তীব্র জেগে উঠল। জবাব দিল পরমেশ্বর ‘হ্যাঁ, তুমি?’ ‘ভালো, রিভিউটা একটু পড়ে দেখবেন’।
একটা স্বল্প প্রচারিত দৈনিকের লিঙ্ক দেয়
চূর্ণি। শবরদের নিয়ে পরমেশ্বরের ডকুমেন্টারিটার একটা নাতিদীর্ঘ রিভিউ। চনমনে হয়ে ওঠে ম্যাক আর পরমেশ্বর দুজনেই একসঙ্গে। ‘ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি
লেখো?’ ওপাশ থেকে জবাব আসে, ‘নাহ, ঐ আর কী, অল্প স্বল্প, আজ আসি?’ সঙ্গে একটা স্মাইলি ইমোটিকম। আর কিছু বলার আগেই
সবুজ আলো নিভে গেল। এরপর থেকে মাঝে মাঝে টুকটাক মেইল। আর তার জন্য পরমেশ্বর আর ম্যাক দুজনেরই চরম অপেক্ষা। নির্দিষ্ট বাসস্ট্যান্ডে
গিয়ে মাঝে মধ্যেই পড়ন্ত বিকেলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকা। যদি সেই চূর্ণি নদীটি
একবার বয়ে যায়! অপেক্ষার ফল মেলে বই কী! কমলা পাড় সাদা ঢাকাই চূর্ণি। উচ্ছ্বল চোখে
মুখে কোথাও একটু বিষণ্নত। দু'হাতের মধ্যে চূর্ণির মুখটা নিয়ে নিতে ইচ্ছে
করে পরমেশ্বরের। কী এমন ব্যথা পেল মেয়েটি? ম্লান হাসে চূর্ণি, ‘ভালো থাকবেন, বাস
এসে গেছে, চলি’। বাসে উঠে যায়
চূর্ণি। পরমেশ্বর রাতে মেইল খোলে, আজ ওর অনেক কথা বলার আছে চূর্ণিকে।
শোনারও আছে। কিন্তু কোথায় কী! ও
ব্লকড। কী এমন হলো? কী করে যোগাযোগ করবে?
কিছুই তো জানে না চূর্ণি সম্পর্কে। কিছুই জিজ্ঞাসা করে উঠতে পারেনি। এমন সব অপ্রয়োজনীয় কথায় হারিয়ে যেত ওরা যে,
চূর্ণি সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো জেনে ওঠা হয়নি। চূর্ণির সামনে
দাঁড়িয়ে পুরনো স্টাইলে বলে ওঠা হয়নি ‘মাই
নেম ইজ ম্যাক, জেমস ম্যাক’। নিশ্চয়ই খিলখিল করে হেসে উঠত চূর্ণি নামের নদীটি। অপেক্ষা। অনন্তকালের অপেক্ষা নিয়ে পরমেশ্বর
বসে থাকে ডেস্কটপের সামনে। ও
নিশ্চিত, ও নির্ভুল, চূর্ণি একদিন ফিরবেই!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন