আমার স্বপ্ন
স্বপ্ন নিয়ে একটা দীর্ঘ কথনের অবকাশ কম। আমার স্বপ্ন
কখনোই দীর্ঘ হয় না। কাটা কাটা স্বপ্ন দেখি। দেখি খণ্ড খণ্ড সংলাপ। আমার সমস্ত
অপ্রাপ্তিগুলো যেন স্বপ্নের মধ্যেই সার্থকতা খুঁজে পায়। কত বিখ্যাত মানুষকে
স্বপ্নে দেখি, গল্প করি। রাজনৈতিক নেতা খেলোয়াড় ইত্যাদি।
আমার একটা গল্পে স্বপ্ন এই রকম।
গল্পটির নাম ‘হিরণ্ময়ী কৃষ্ণকলি’।
‘সেদিন
রাতে বেশ দেরী করে ঘুম এলো। অনেক কাটা কাটা স্বপ্ন দেখলাম। আমি আর হিরণ্ময়ী জগার
লম্বা কালো গাড়ি চেপে অনেক দূরে কোথাও চলে গেছি। বেশ খিদে পেল। ঝিং চ্যাক ঝিং
চ্যাক বাজনা বাজছে,
ডিস্কো লাইট জ্বলছে। সামনে একটা রেস্তোরাঁ। সেখানে কাচের জানালা। এসিটা এত জোরে
চালানো যে বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। পর পর প্লেটে প্লেটে খাবার আসছে। কী খাবার বুঝতে
পারছি না। আবার চিনা মাটির বিভিন্ন
পাত্রতেও খাবার রাখা আছে। ঢাকনা দেওয়া। কোথা থেকে হঠাৎ কৃষ্ণকলি আমাকে ফোন করল।
বলল তোমার মা কথা বলবে। মা খিল খিল করে হেসে বলল,
ঢাকনা সরিয়ে দেখলেই হয় দামি দামি খাবারের রকম সকম। সরিয়ে দেখলাম।
প্রথম বাটিতে তেলে ভাজা।
দ্বিতীয় বাটিতে তেলে ভাজা।
তৃতীয় বাটিতে তেলে ভাজা।
হিরণ্ময়ী বলল, আজকাল তেলেভাজাও
জাতে উঠে গেছে। বিল আসবে হাজার টাকার। ঘুম
ভেঙ্গে গেল। গল গল করে ঘামছি। একটা ট্যারছা মতো রোদের ফলা মাথায় এমনভাবে পড়েছে ঠিক
যেন মাথায় ড্রিল করে চাঁদি ফুটো করছে।
ভোরের স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সারাটা দিন
কেটে গেল।’
বাস্তব আমাকে বড় সীমাবদ্ধ করে দেয়। বাস্তবে আমাকে চালায়
আবেগ, বিশ্বাস আর যা কিছু প্রচলন, সেসব। জনমত আমাকে চালিত করে। অধিকাংশের মতো আমাকে চালিত করে। আমার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি অনেক সময়েই ঢাকা পড়ে
যায় অন্যের বিচারে আর নির্দেশিকায়। আমি এমন অনেক কাজ করি যা অর্থহীন এবং
অপ্রয়োজনীয়। অনেকটা শিশুরা যেমন করে। রাস্তার ধারে লটকে থাকা কোনো সাবধানবাণীকে লক্ষ্য করে ইটপাথর ছোঁড়ে। হয়তো সেখানে পথ শেষ, বা কো্নো ব্রিজ ভেঙে গেছে। অবোধের মতো সেই
সাবধানবানীকে নিশ্চিহ্ন করে দিলাম ঝোঁকের মাথায়। কিন্তু পরবর্তীতে আশ্রয় খুঁজছি আবার স্বপ্নে। এ
এক অদ্ভুত পরাবাস্তবতা।
“স্বপ্নের ভেলা / অনেকের সাথে আমিও সাবধানবাণী
লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়লাম; / দিক নির্দেশ বেঁকে গেল ক্রমান্বয়ে আঘাতে / সব কিছু থাকল
অস্তিত্ববিহীনতার আমন্ত্রণে।
চড়াই উৎরাই খাড়া পাহাড় / একটু অসাবধানে কারও
যাত্রার অকাল সমাপ্তি হতে
পারে / ওদিকে পথ শেষ
ধ্বস নেমে তলিয়ে গেছে।
এদিকে যানবাহন আসে না বড় / তবুও কেউ আসতে পারে! / কী করব আমাদের লক্ষ্যভেদ
কি এতটাই জরুরী ছিল চিহ্নগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে দিলাম কেন?
অনেক জাগরণের পরে / কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে
সুদিনের / দেখে এক ভেজা
নৌকো ছুটেছে জলে / জল থেকে নেমে যাচ্ছে অন্তঃসলিলার গহ্বরে / প্রবল ছুটেছে
নৌকো যাতে কষ্টে সৃষ্টে একজন বসতে পারে, /নৌকো ছুটেছে গহ্বরে, / তুষার যুগের
শেষে আন্তর্মহাদেশীয় হিমবাহ / সৃষ্টি করেছে গহ্বর, / স্বপ্নের ভেলা
ছুটেছে সেদিকে।”
নিজের লেখা নিয়েই বলে চলেছি। গদ্যরচনায় অন্য কিছু নিয়েও বলা
যেত। কিন্তু স্বপ্ন এতটাই ব্যক্তিগত বিষয় যে, রিপোর্টিংএর ভিত্তিতে
কিছু লেখা যায় না। স্বপ্নের সেকেন্ডারি ডেটা
পাওয়া মুস্কিল। তাই আমার দৃষ্টিতে স্বপ্ন নিয়েই লিখে চলেছি।
স্বপ্ন নামের একটা গল্পও লিখেছিলাম। দ্রুত প্রেক্ষাপট
পালটায় স্বপ্নে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম পালটে যায়, শরীর পালটে যায়, এমনকি লিঙ্গও
পরিবর্তিত হতে পারে। প্রেক্ষাপট পাল্টে যায় গাণিতিক দ্রুততায়।
স্বপ্ন
"আমার কিছু করার
নেই। অনেক চেষ্টা করেও
শেষ ট্রেনটা ধরতে পারলাম না। ষ্টেশনে পৌঁছেই ট্রেনটাকে দেখে ছিলাম। চুলোয় যাক
টিকিট। ওভারব্রিজ ডিঙ্গিয়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে কেবল ট্রেনের পেছনের লালবাতিটা
দেখতে পেলাম। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।
প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। দোকানগুলোর ডালা বন্ধ।
আপাদমস্তক চাদর ঢাকা ইতঃস্তত কিছু
মানুষজন মৃতদেহের মতো শুয়ে আছে।
কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা খুলে জলের বোতলটায় ভালো করে জল ভরে নিলাম। কোথাও রাতটা কাটাতে হবে। ঘুমে দু’চোখ জড়িয়ে আসছে। ওভারব্রিজের
সিঁড়ি দিয়ে আবার উঠতে লাগলাম।
সিঁড়ির মাথায় দরজা।
আলো এসে পড়েছে সিঁড়িতে। ভোরের আলো। ঝকঝক করছে শহরটা। বড় বড় দোকান। বিশাল বিশাল কাচের জানালা। সাজানো সব হোটেল রেস্তোরাঁ। দু’দিকে চওড়া চওড়া রাস্তা। মাঝখান
দিয়ে শব্দ করে ট্রাম যাচ্ছে। এক কামরার ট্রাম। দু’রকম রঙ। লাল আর কালচে সবুজ। আমি প্রথমে লাল ট্রামে উঠব। সেন্ট চার্লস
অ্যাভেন্যুতে যাব। সেখানে ট্রাম পালটে সবুজ ট্রামে উঠব। ওডুবর্ন পার্কে নামতে হবে। ঢং ঢং করতে করতে প্রথম ট্রামটা এলো। আমি ট্রামে উঠে বসার জায়গা খুঁজতে লাগলাম। একদম পেছনে একটা
ফাঁকা বেঞ্চি।
বসলাম।
দু’একটা গাছের পাতা টুপটাপ খসে পড়ছে। লাল লাল ম্যাপল পাতা। দু’এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে।
দুপুরের আকাশটা হঠাৎ অন্ধকার করে আসছে। ব্যাগ খুলে ছাতাটা বের করলাম। আরও একটু
বৃষ্টি বাড়লে ছাতাটা মেলতে হবে। অন্ধকারের মাত্রাটা আরও বাড়ছে। পাখিগুলো তো সন্ধ্যে হয়ে গেছে ভেবে প্রচণ্ড চীৎকার চেঁচামেচি করতে করতে ঘরে ফিরে আসছে। নাহ, আবার উঠতেই হচ্ছে। বিশাল গাছটা একটু দূরে। তার তলাতে
দাঁড়াবার জায়গা খুঁজছি। দেখলাম অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে
লাগছে। শেডের ভেতর যাবার চেষ্টা করছি। ভীষণ হুড়োহুড়ি। একটু নিরাপদ জায়গা পেয়ে
সেখানেই দাঁড়ালাম।
‘বৃষ্টিটা কখন থামবে বলুন তো!'
চেয়ে দেখলাম তপতী। তপতীই তো, না তাপসী? নাম মনে আসছে না। গোল ফরসা মুখখানা। চুলগুলো কোঁকড়ানো। কোথাযও দেখেছি।
ওপরে একটা রেস্তোরাঁ আছে। চা খেলে মন্দ হতো না। তপতীর সঙ্গে আবার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে
লাগলাম। সিঁড়ির মুখে
দরজায় গেট কিপার। দু’জনে টিকিট পাঞ্চ করে ভেতরে ঢুকলাম। তখনো সিনেমা শুরু হয়নি। ট্রেলার
দেখাচ্ছে। রেজাউল আমাকে বলল, সিনেমা শেষ হলে পরোটা কাবাব
খাব। একটা ভালো দোকান আছে নিউ
মার্কেটের পাশে।
আমার পকেটে খুচরো পয়সা ঝন ঝন করছে। পকেটে হাত দিতেই রেজা বলল, তোকে পয়সা দিতে হবে না। তারপর আরও
কি ভেবে বলল, না রে তোকে বিফ খাওয়াব না।
সিনেমা শেষ করে আমরা রেস্তোরাঁতে ঢুকলাম। পয়সা দিতে হবে না, তাও পকেট হাতড়ে বেড়িয়ে এলো
ঠিক আড়াই ডলার।
ধড়ে প্রাণ এলো। এতক্ষণ ধরে প্রবল তেষ্টা পাচ্ছিল, অথচ জল খেতে ইচ্ছে করছে না।
একটা বড় ঝাঁঝালো কোকের গ্লাস নিয়ে বসে গেলাম। ঢাকা গ্লাস, যাতে কাত হয়ে চলকে না পড়ে। টুকটাক ছোটখাট তফাৎ আমাদের ব্যবস্থার
সঙ্গে। আর তোমার প্রাইভেসি আর স্বাতন্ত্র্যকে এত মর্যাদা দেয় এরা। সব কিছুই ভালো, তবু—!
তবুও অনেক কথাই থেকে যায়।
এতটা সময় ভালোই কেটে যায়।
খিদে পেলে খাওয়া। সঙ্গী চাইলে সঙ্গী। তেষ্টা পেলে পানীয়। সবই জুটে
যায় তবু কেন চোখ ফেটে কান্না আসে! প্রেক্ষাপটগুলো
ধরতে পারছি না। কুশীলবদেরও নয়। দ্রুত পালটে যাচ্ছে সব কিছু।
কাঁধের ঝোলাটা শক্ত করে ধরে রেস্তোরাঁর দরজা খুলে বাসে উঠলাম। দেখি, অসংখ্য মানুষ টার্মিনালে। এত রাতেও দিনের আলোর মতো ঝকঝক করছে। ভেতরে বিশাল বিশাল সোনালি খেজুর গাছ। ডিউটি ফ্রি শপ। সোনার দোকানে বেশ ভিড়। দু’হাতে পাঁজাকোলা করে সওদা সম্ভার নিয়ে যাচ্ছে অজস্র অচেনা মুখ। ট্রলি উপচে পড়ছে
মদ সিগারেট আর পারফিউমের প্যাকেট।
একজনের সঙ্গে আলাপ হলো। দোকান কর্মচারী। চেহারাতেই মালুম বাঙালি। রাজশাহী বাড়ি। আশ্বস্ত করলেন, কোনো কিছু কিনে ঠকব না। আরও দু’চার কথা হলো।
কিছুক্ষণ মনে হলো দু’টুকরো বাংলা যেন জুড়ে গেল। ছল
ছল চোখে এগোলাম এরোব্রিজের দিকে।
ওভারব্রিজ থেকে নামছি। সিঁড়ি বেয়ে আবার নামতে থাকি। এত খাড়া সিঁড়ি!
এতগুলো ধাপ!
তবু ধীরে ধীরে নামি। শেষের ধাপগুলো বেড়ে যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ
প্ল্যাটফর্মে। অজস্র অচেনা মুখ। সকালের লোকাল ট্রেন ধরবে বলে দাঁড়িয়ে আছে।
আমিও চোখ কচলাতে কচলাতে একটা জায়গা খুঁজি যেখানে একটু ভিড় কম। ট্রেন এলে
অনায়াসেই বসার জায়গা পাব।”
সবচেয়ে আশ্চর্য আমার স্বপ্নে প্রচুর শিশুর কোলাহল শুনি।
হ্যারি পটারের গল্পের মতো হেঁটে যাই দেওয়ালের ভেতরে। কেউ জানে না এভাবে যাওয়া
যায়। তবু যাই।
কার্পেট পাতা আমন্ত্রণে আলাদা এক পৃথিবী ডাকে। জানি না এ পৃথিবী কোথায়
লুকিয়ে ছিল। চল্লিশ চোরের গুহাময় সম্পদ। পাথরে ঢাকা। কম্পাস
জিপিএস লাগে না। খুঁজে নিতে হয়। অতল ঘুমের মধ্যে
জেগে থাকে দেখবার চোখ।
এদিকে আদিম গ্রন্থাগারে একে একে জ্বলে ওঠে নিবু সাঁঝবাতি। লাইব্রেরিয়ান ভৌতিক। পাঠকেরাও প্রেততাড়িত। দেওয়াল বেয়ে আকাশে উঠে গেছে
সারি সারি পুস্তক। বৈদূর্য্যমণি ক্যাটস আই ও নানা সম্পদ, কোথাো কোনো গোপন চেম্বারে
হীরক খণ্ডও লুকনো আছে।
লাইব্রেরিয়ান
নিজেই এক গবলিন। তার নাক কান চোখা চোখা। চশমার স্প্রিং পেঁচানো
কানে। সে সব বলে দেবে।
আমি
হ্যারি পটার হয়ে খুঁজি কোথা দিয়ে পৌঁছে যাব নাইন থ্রি ফোরথ প্ল্যাটফর্মে। হাওড়া শেয়ালদা স্টেশন
চত্বরে নাইন থ্রি ফোরথ প্ল্যাটফর্ম খুঁজে চলি। আমি একটা ঝকঝকে টুকটুকে লাল ট্রেন খুঁজি যার
কামরাগুলোর কোণায় কোণায় সোনালি গিল্টি করা। এখনও রঙের গন্ধ যায় নি। ট্রেন ভর্তি
একদল শিশু কিশোর। কুচকুচে কালো লোহার স্টিম ইঞ্জিন সাদা ধোঁয়া ছাড়ে। কু করে সিটি বাজিয়ে সে ট্রেন ছুটবে যাদুপুরীর উদ্দেশ্যে। আকাশে উঠবে। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে পৌঁছে
যাবে প্রকৃতি ঘেরা রহস্য গন্তব্য
হগওয়ার্টসের ইন্দ্রজাল
শেখার ইস্কুলে।
এই সব শিশুদের তাড়া করবে না কোনো ভয়। এদের শৈশব কেড়ে
নেবে না কো্নো শয়তান। এদের মাথায় রাইফেল ঠেকাবে না কোনো মানুষ। ছুটে আসা
কামানের গোলায় ভেঙে যাবে না কো্নো বিদ্যালয়ের দেওয়াল। এদের পিঠে কেউ ঝুলিয়ে দেবে না বন্দুক। শরীরে বেঁধে দেবে না বিস্ফোরক। এদের কেউ পণবন্দী
করবে না।
পৃথিবী জয় করবে এরা। পৃথিবীর পথে হেঁটে যাবে হাত ধরাধরি
করে। নানা রঙ নানা বিশ্বাসের বিশ্ব, শিশুরা নিয়ে আসবে উজ্জ্বল দিন আগামীতে। এই স্বপ্নটা
সত্যি হবে। আমি আশাবাদী। এটা সত্যি হওয়াই লাভজনক। আতঙ্ক নয়,
বিশ্ব ব্যবসা করুক সহমর্মিতা নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, গান নিয়ে, কবিতা
নিয়ে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন