আমরা-ওরা
আমাদের ‘সময়’ এমন সৃষ্টিছাড়া ছিল না। ‘আমাদের সময়’ – আহা
আমাদের সোনার সময়! সেইসব দিনের কথা কী ভোলার! আমাদের সময়ে আকাশ কত নির্মল ছিল,
আমাদের সময়ে হাওয়ায় এত কার্বন ছিল না, আমাদের সময়ে জল খেলে মুখ মিষ্টি হয়ে যেত,
আমাদের সময়ে আমরা লোহা চিবিয়ে খেতাম, আমাদের সময়ে খাবারে এত বিষ মেশানো থাকত না,
আমাদের সময়ে সময় এত নির্মম ছিল না, আমাদের সময়ে মানুষ খুব ভালো ছিল, আমরা কত সুখী
ছিলাম আমাদের সময়ে। এখন সময়টা আমাদের নয়, তোমাদের।
তোমাদের
সময়ে আমাদের সব হাহুতাশ, আমাদের যন্ত্রণা, আমাদের না-পাওয়াগুলো গচ্ছিত হয়ে রয়েছে। আমরা কত না সুখেই
‘দিন
কাটাইতাম’, তোমাদের যুগে এসে আমাদের অপ্রাপ্তির শেষ নেই। এই তোমাদের যুগ আমাদের কী দিয়েছে! সাইবার
বশ্যতা ছাড়া আর কী শিখেছো তোমরা? কোথায় গেল মুখোমুখি বসে সেই
প্রাণ খুলে হাসি, আড্ডা;
কোথায় গেল অল্পে সন্তুষ্ট হওয়ার মানসিকতা? তোমাদের চাই,
চাই, আরও চাইয়ের ঠেলায় আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত আজ। জন্ম থেকেই তোমরা ব্র্যান্ডেড পোশাক আর অ্যাকসেসরিতে
অভ্যস্ত হয়ে উঠছ। এখন যদি বল, আমরাই
তো কিনে দিচ্ছি, তাই এই অভ্যেস, এটা একটু
চালাকি হয়ে গেল না তোমাদের! কায়দা করে কীভাবে প্যাঁচ মেরে আদায়
করতে হয়, তোমাদের থেকে আর কে বেশি জানে! না কিনে দিলে রক্ষে থাকবে! বড় হয়ে আমাদের দিকেই আঙুল
তুলে বলবে, তোমরা পারো নি। আর সবাই কিন্তু পেরেছে! আমরা
তো বলির পাঁঠা! মুখ বুজে তোমাদের জন্য করে যাওয়াই আমাদের প্রধান
কর্তব্য। এমনকি আমরা কীভাবে
চলব, কী
খাবো, কী মাখবো, সেটাও তোমরা ঠিক করে দাও। আমরা খেয়ে উঠে সশব্দে ঢেঁকুর তুলতে ভয় পাই, আমরা
খ্যাসখ্যাস করে পিঠ চুলকোতে পারি না, আমরা খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসতে
পারি না, হাউমাউ করে কান্নাও কেড়ে নিয়েছো তোমরা। আমাদের সবই বোগাস তোমাদের কাছে।
দেখ বাপু, তোমাদের কিছু ভালো গুণও আছে,
যা না স্বীকার করলে অন্যায় করা হবে। আমরা এখনও ভুল করলে, ভুলটা
মাথা নিচু করে স্বীকার করতে পারি। তোমাদের মতো, ভুলকে
ঘাড় ত্যাওড়া করে, ঠিক বলে যুক্তির কচকচি আনি না। যাই হোক্, তোমাদের একটাই গুণ আমাদের ভালো লাগে, সেটা হলো তোমাদের
উদারতা। তোমরা কত সহজে বিভিন্ন রকম সম্পর্কের টানাপড়েনকে
মেনে নাও, খুব অবাক হয়ে দেখি। ভুল-ঠিক,
ভালো-খারাপ, পাপ-পূণ্য, বৈধ-অবৈধ, এসবের সীমারেখা কত সহজে অতিক্রম কর তোমরা! আর আমরা তো এখনও ভুল হলো,
না ঠিক হলো, এসব দ্বিধায় ভুগতে ভুগতে অনবরত নিজেকে জিজ্ঞেস করে চলি, অন্যকে জিজ্ঞেস করে চলি, আবার জিজ্ঞেস করতে
গেলেও ইতঃস্তত করি, প্রশ্ন করে ফেললেও ভয়ে
ভয়ে থাকি, ইনি কিছু মনে করলেন না তো! তোমরা কথায় কথায় যে কফিডেন্সের আওয়াজ তোল,
সেই আওয়াজ আমাদের ভেতরে গিয়ে কেমন যেন সুড়সুড়ি দেয়। আমরা না পারি সেই সুড়সুড়ি খেয়ে
হাসতে, না পারি বিদেয় করতে। বুঝতে পারি আমাদের এখনও শেখার আছে। হ্যাঁ, তোমাদের
থেকেই। আর একটা ক্যাসুয়াল ভাব তোমরা বহন কর, সেটাও বেশ লাগে। অনর্থক সিরিয়াস মুখ করে, বিজ্ঞ
সাজার চেষ্টা তোমাদের মধ্যে দেখি না। আর যেটা জানো তোমরা, সেটা
বেশ ভালো করেই জানো, মানতেই হবে।
জানা
ব্যাপারটা অত সোজা নয়, সে তোমরাও জানো, আমরাও। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় আমাদের জানার
মধ্যে যেন অনেকখানি ফাঁকি রয়ে গেছে। আসলে তোমাদের জানার কাছে এলে, এই মনে হওয়া
বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আমাদের জানা
মিথ্যে ছিল না, আমরা আন্তরিক ছিলাম, এখনও আছি। তবে ওই যে বলে না, নতুন আবিষ্কারের
সাথে সাথে পুরনো যন্ত্র বাতিল হয়ে যায়, তেমনি তোমাদের জানার কাছে আমাদের জানা
বাতিল হয়ে যাচ্ছে। আমরা হীনমন্যতায় ভুগি বলেই, তোমাদের জানাকে দম্ভ ভাবি, অহংকার
ভাবি। এই স্বীকারোক্তি আমরা সর্বসমক্ষে কিছুতেই করতে পারব না, এটাও ঘটনা। এসবই
নিজের মনের কাছে সাধু সাজার চেষ্টা মাত্র। সাধু সাজতে গিয়ে এই আমরা যে কত পাপ গোপন
করে চলেছি এখনও, ভাবলে নিজেরাই অবাক হই। ‘পাপ’এর কনসেপ্ট আমাদের মনে গেঁথে আছে,
থাকবেও। আমাদের অবৈধ প্রেম নিয়ে আমরা থরথর কাঁপি, সামলাতে পারিনি, পারেনি কেউই।
তোমরা অনায়াসে সাদাকে সাদা, আর কালোকে কালো বলতে পারো। তোমাদের কোনো ‘অবৈধ’ নেই,
কো্নো ‘পাপ’ নেই। তোমরা যা কর, তার
তীব্রতা দেখি আমরা দূর থেকে আর ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে যাই। পারি না, আমরা পারি না
তোমাদের মতো বাঁচতে। আমরা সেই অসহায়তা থেকে দূরে যেতে গিয়ে তোমাদের ওপর আঙুল তুলি, দোষারোপ করি।
আমাদের সর্বসুখের যুগের ব্যাখ্যানা করি অষ্টপ্রহর। এতে তোমাদের কাছে আমরা আরও খেলো
হয়ে যাচ্ছি, সেটা বুঝতে চাই না।
তবে
সত্যিই কী আমাদের দিন সর্বসুখের ছিল না! ছিল তো! আমাদের সময়ে আমরা মিলেমিশে থাকতে
জানতাম। তোমাদের মতো একা ছিলাম না আমরা। আমাদের
একা হতে খুব ভয়। আর তোমরা একাকীত্ব এনজয় কর। সেটাও অবশ্য সুখের তোমাদের পক্ষে।
আমরা মনেপ্রাণে চাই, আমাদের সুখের সময় চারটে মানুষ থাকুক আমার পাশে, আমাদের সমবেত
হাসিতে পাড়া কেঁপে উঠুক। আমাদের কান্না মুছিয়ে দেওয়ার জন্য বেশ কয়েকটা না হলেও,
অন্তত একটা হাত থাকুক। আর তোমরা হা হা হাসতে শেখো নি। শিখেছো শুধু এনজয় করতে।
তোমাদের কান্না আমরা দেখি কই! তোমাদের কান্নাগুলো ফল্গু নদী হয়ে গেছে। বালিতে মুখ
লুকিয়ে নিঃশব্দে ঝরে যাচ্ছে। আমরা সবই বুঝি, তোমাদের বুঝতে চাই, তোমরাই এড়িয়ে যাও
কায়দা করে। কায়দাটাও বড্ড ভালো জানো তোমরা বাপু। তবে একটা জিনিস তোমরা লুকোতে পারো
না, তোমাদের হতাশা বড় বেশি আওয়াজ তোলে। তোমাদের আকাশ ছোঁওয়া চাহিদার কাছে বাস্তবের
ক্রাইসিস যখন মুখ থুবড়ে পড়ে, তখন আর সামলাতে পার না তোমরা। তোমাদের তখন কী ভয়ানক
চিৎকার! আকাশ কেঁপে ওঠে, হাওয়া মুখ লুকোয় আশংকায়। দু'এক নাম্বারের জন্য তোমরা ঝাঁপ দাও হস্টেলের ছাদ থেকে, বাথরুমে ঝুলে পড়
নির্দ্বিধায়। আর নেশার কাছেও অনেক অনেকবার তোমরা হেরে গেছ অম্লানবদনে। একে অপরের
ওপর তুচ্ছ কারণে হিংস্র হয়ে ওঠো, সেসময় তোমাদের ভেতরের তোমরা সত্যিই হেরে যাও, বোঝ
না সেটা। এই সময়ে আমাদের করুণা হয় তোমাদের প্রতি। আমাদের দিকে না তাকিয়েছো, বেশ
করেছো। কিন্তু তোমাদের টার্গেট, তোমাদের চ্যালেঞ্জের দিকেও তাকালে না! তোমাদের
কেরিয়ার গোল্লায় গেল। আমাদের ইনভেস্টমেন্ট ফেল করল, আমাদের ভাঙা ফিক্সড ডিপোসিট মাঠে মারা
গেল। আমরা শেষ
বয়সে তোমাদের স্মৃতি আগলে খালি পকেটে হরির নাম করতে লাগলাম। তোমরাও গেলে, আমরাও।
এসো না, আমরা বেঁধে বেঁধে থাকি! আমাদের সাথে
তোমাদের, তোমাদের সাথে আমাদের, একটা টাই
আপ হোক! এ খেলায় আমরা দুপক্ষই না হয় জিতি! হয় না, হতে পারে না এমন? এমন আশা করা কি
আমাদের ভুল? আমাদের এখনও আশা বেঁচে আছে, তোমাদেরও আছে। অন্তত এই একটা মিল থেকে
আমরা মিলে যেতে পারি না কি? এক কাজ করা যাক না হয়, তোমাদের
ওপর আমাদের যত অভিযোগ আছে, সব উগড়ে দিই। আর তোমরাও তাই কর। ব্যাস্, শোধবোধ! এরপর থেকে আমাদের সাথে তোমরা থেকো, তোমাদের সাথে আমরা
থাকবো। জীবন কেন এত সহজ হয়
না!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন