যখন বৃষ্টি...
ঠিক বিকেলেই গাঢ় অন্ধকার নামল। মুকুল বলছিল,
এইবেলা চলুন নইলে ঝড়জলে আটকে যাবেন। সে তখনও লাল-হলুদ রঙ মাখছে। শেষে যখন বেরোলো তখন সাঁই সা্ঁই হাওয়া। গাড়ির দরজা অবধি
যাওয়া তাতেই মাথা বেয়ে জল গড়াতে লাগল টুপ টাপ, কুর্তিটা ভিজে সপসপে।
রঞ্জু বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই কিছুক্ষণ মন খারাপ করে থাকল, তারপর বলল, এই বৃষ্টিটা না সত্যি যাচ্ছে
তাই! ওর মানে পৃথার তখন বোধহয় মন ভার। ব্যথাচোখ তুলে সে তাকাল রঞ্জুর দিকে। রঞ্জু
ততক্ষণে চোখ সরিয়ে রাস্তা।। বৃষ্টিতে ধুয়ে যাক চোখের জল আর এই শহরের সমস্ত পাপ। আহ... বিষণ্ণতা... আর কতদূর গেলে শেষ তবে এই প্রতীক্ষার
কাল!
ঘনঘন বিদ্যুৎ কালো আকাশ চিরে নকশা কাটছে তখন থেকে। পৃথা তাতে মুখ ডুবিয়ে আকাশ পাতাল ভাবছে। আর
চাকার ঘড়াঘড়ানি থামছেই না। উদাস দৃষ্টিতে সে এবার বৃষ্টির অবিরল
ধারার দিকে তাকিয়ে। হেডলাইটের আলোয় বোঝা যাচ্ছে শহর ভাসছে। আবার চোখ বন্ধ করে
সিটে হেলান দিল ও। করতলে অন্য হাতটা রাখল যেন কারও স্পর্শের উত্তাপ
খুঁজল। এমন বৃষ্টিতে গাড়ির স্পিড তোলা কঠিন, আর চাকা যদি স্কিড
করে...! সীটবেল্ট বাঁধার কথা গাড়ির চালককে আবার বলে পৃথা অস্থির হয়ে হাতব্যাগ খুলে
বের করে আনল তার মুঠোফোন। রঞ্জু তখন বাড়িতে বসে হেমাঞ্জলি স্মৃতিকথা খুলে বসেছে, আর থেকে
থেকে ঘড়িতে সময় দেখছে। না, পৃথাকে সে কোনো মেসেজ পাঠাবে না। কেন সে রঞ্জুকে একলা ফেলে চলে গেল! আজকাল কী একটা হয়েছে ওর, অকারণ চোখ দিয়ে জল
গড়ায়। রঞ্জু অবশ্য তাতে অখুশিও নয়। না হয়
সে এ জীবনে আর স্মার্ট হলোই না, তাতে কী! এত ধুলোবালি মেখেও তো সে শেষ অবধি শিশুর মতো কাঁদতেও পারে। ক’জন পারে এমন, হেমাঞ্জলি স্মৃতিকথা হাতে নিয়ে বানভাসী হতে!
ঠোঁটের কোণটা অকারণ কেঁপে যায়। আকাশ চিরে ঝলসে ওঠে আবার বিদ্যুৎ... আহ... স্মৃতি, এমন
পোড়ায়! এই তো অল্প সময় আগেও পৃথা তার হাত ধরে ছিল। এখন নেই...
অস্থিরতা কাটছে না। দমবন্ধ
লাগছে। এত বৃষ্টি হলো
তবু গুমোট ভাবটা কই কাটল না তো! উঠে গিয়ে ঘরের সব কটা জানালা খুলে দিলে ঘরের ভেতর ঢুকে
পড়ে ভেজা হাওয়া। মুঠোফোনে টুং আওয়াজ, বোধহয় পৃথার মেসেজ। রঞ্জু তাকাল না। তাকে নিঃস্ব করে দিয়ে যে চলে গেল তার মেসেজে আর কী বলার
থাকতে পারে! সরি রঞ্জু, পারলাম না! বাবু আমি হেরে গেলাম নিজের কাছে! এর চাইতে বেশি
আর কী বলবে পৃথা... হু হু করা বুকে আরও বিষাদে ডুবে যেতে যেতে সে অন্ধকার
আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করল, এবার আমায় অন্ধ কর হে ঈশ্বর...
শহরের শেষ সীমানা ছেড়ে যাবার আগে গাড়ি থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার
পিছন ফিরে তাকাল পৃথা, যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে ওর প্রতীক্ষায়। ফোনের
ইনবক্স নিরুত্তর। রঞ্জু...
রঞ্জু... তুই কেন বুঝবি না পাগল... জানালার কাচ খুলে অদৃশ্য কোনো ছায়াকে বিদায় জানাতে সে হাত নাড়ল দু'
একবার। চোখ থেকে নামল জল টুপটাপ।
শহরের পাখিরা তখন আশ্রয় নিয়েছে সব নিজস্ব ডানার ওমে।
আর রঞ্জু? হঠাৎ সে তখন ক্ষ্যাপাটে, ভয়ঙ্কর। বেরিয়ে
পড়েছে কোনো অজানায়। আকাশ ভেঙে পড়া বৃষ্টিতে চারপাশ চুপচাপ। দুরন্ত অভিমানে ক্ষ্যাপা রঞ্জু এলোমেলো পা ফেলছে ঝড় জলের শহুরে রাস্তায় আর বিড়বিড়
করছে, যেতে হবে। তাকে চলে যেতে হবে কোথাও। এই
শহর ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে তাকে আশ্রয় নিতে হবে। না... আর কিছু চাইবার নেই, কিছু নেবারও নেই। এই শহরের প্রতিটি কোণ যেমন তার চেনা, সে যাকে নিজের বলে ভেবে এসেছে এতকাল,
সেও তার আপন কেউ নয়, যেমন পৃথা... কোথাও সে আর থাকবে না।
রঞ্জু হাঁটছে। প্রতিটা পদক্ষেপে ছড়িয়ে
যাচ্ছে অভিমান, ক্রোধ আর ছিটকে ওঠা কান্না। অন্ধকারে ডুবে যাওয়া রাস্তার বাঁক ঘুরে যাচ্ছে
অন্য ঠিকানায়। রঞ্জুর শরীরে তখন বৃষ্টির অবিরল ধারা।
তারপর!
তারপর তো প্রতিদিনের নিয়মে ভোরের আলো ফোটে। অন্ধকার
সরিয়ে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা দেয় সূর্য। অন্য এক দিনের শুরু। আর সেই দিনের শুরুতে যখন গাড়ি থেকে পৃথা তার ডান পা' টি বাড়ায় তখন বেড-টির সময় পেরিয়ে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসার সময়। পৃথার
হাত থেকে তার রুকস্যাক ওঠে পার্থর কাঁধে।
ঝিলপাড়ের লাল হলুদ বেলুনগুলো তখন আকাশমুখি।
সুতো কেবল টেনে ধরা বেলুনওয়ালার হাতে।
না, এখানে
বৃষ্টি নেই...
sundor...
উত্তরমুছুন