রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

মেঘ অদিতি

যখন বৃষ্টি...

ঠিক বিকেলেই গাঢ় অন্ধকার নামলমুকুল বলছিল, এইবেলা চলুন নইলে ঝড়জলে আটকে যাবেনসে তখনও লাল-হলুদ রঙ মাখছেশেষে যখন বেরোলো তখন সাঁই  সা্ঁই হাওয়াগাড়ির দরজা অবধি যাওয়া তাতেই মাথা বেয়ে জল গড়াতে লাগল টুপ  টাপ, কুর্তিটা ভিজে সপসপেরঞ্জু বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতেই কিছুক্ষণ মন খারাপ করে  থাকল, তারপর বলল, এই বৃষ্টিটা না সত্যি যাচ্ছে তাই! ওর মানে পৃথার তখন  বোধহয় মন ভারব্যথাচোখ তুলে সে তাকাল রঞ্জুর দিকেরঞ্জু ততক্ষণে চোখ  সরিয়ে রাস্তা। বৃষ্টিতে ধুয়ে যাক চোখের জল আর এই শহরের সমস্ত পাপআহ...   বিষণ্ণতা... আর কতদূর গেলে শেষ তবে এই প্রতীক্ষার কাল!

ঘনঘন বিদ্যুৎ কালো আকাশ চিরে নকশা কাটছে তখন থেকেপৃথা তাতে মুখ ডুবিয়ে আকাশ পাতাল ভাবছেআর চাকার ঘড়াঘড়ানি থামছেই নাউদাস দৃষ্টিতে সে এবার বৃষ্টির অবিরল ধারার দিকে তাকিয়েহেডলাইটের আলোয় বোঝা যাচ্ছে  শহর ভাসছেআবার চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিল ওকরতলে অন্য হাতটা রাখল যেন কারও স্পর্শের উত্তাপ খুঁজলএমন বৃষ্টিতে গাড়ির স্পিড তোলা কঠিন, আর চাকা যদি স্কিড করে...! সীটবেল্ট বাঁধার কথা গাড়ির চালককে আবার বলে  পৃথা অস্থির হয়ে হাতব্যাগ খুলে বের করে আনল তার মুঠোফোনরঞ্জু তখন বাড়িতে  বসে হেমাঞ্জলি স্মৃতিকথা খুলে বসেছে, আর থেকে থেকে ঘড়িতে সময় দেখছেনা,  পৃথাকে সে কোনো মেসেজ পাঠাবে নাকেন সে রঞ্জুকে একলা ফেলে চলে গেল!  আজকাল কী একটা হয়েছে ওর, অকারণ চোখ দিয়ে জল গড়ায়রঞ্জু অবশ্য তাতে অখুশিও নয়না হয় সে এ জীবনে আর স্মার্ট হলোই না, তাতে কী! এত ধুলোবালি  মেখেও তো সে শেষ অবধি শিশুর মতো কাঁদতেও পারেক’জন পারে এমন,  হেমাঞ্জলি স্মৃতিকথা হাতে নিয়ে বানভাসী হতে! ঠোঁটের কোণটা অকারণ কেঁপে যায়।  আকাশ  চিরে ঝলসে ওঠে আবার বিদ্যুৎ... আহ... স্মৃতি, এমন পোড়ায়! এই তো অল্প সময় আগেও পৃথা তার হাত ধরে ছিলএখন নেই... অস্থিরতা কাটছে না।  দমবন্ধ  লাগছেএত বৃষ্টি হলো তবু গুমোট ভাবটা কই কাটল না তো! উঠে গিয়ে ঘরের সব কটা জানালা খুলে দিলে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে ভেজা হাওয়ামুঠোফোনে টুং আওয়াজ, বোধহয় পৃথার মেসেজরঞ্জু তাকাল নাতাকে নিঃস্ব করে দিয়ে যে  চলে গেল তার মেসেজে আর কী বলার থাকতে পারে! সরি রঞ্জু, পারলাম না! বাবু আমি হেরে গেলাম নিজের কাছে! এর চাইতে বেশি আর কী বলবে পৃথা... হু হু করা বুকে আরও বিষাদে ডুবে যেতে যেতে সে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রার্থনা করল, এবার আমায় অন্ধ কর হে ঈশ্বর...

শহরের শেষ সীমানা ছেড়ে যাবার আগে গাড়ি থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার পিছন ফিরে তাকাল পৃথা, যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে ওর প্রতীক্ষায়ফোনের ইনবক্স  নিরুত্তররঞ্জু... রঞ্জু... তুই কেন বুঝবি না পাগল... জানালার কাচ খুলে অদৃশ্য   কোনো ছায়াকে বিদায় জানাতে সে হাত নাড়ল দু' একবারচোখ থেকে নামল জল টুপটাপ

শহরের পাখিরা তখন আশ্রয় নিয়েছে সব নিজস্ব ডানার ওমে

আর রঞ্জু? হঠাৎ সে তখন ক্ষ্যাপাটে, ভয়ঙ্করবেরিয়ে পড়েছে কোনো অজানায়।   আকাশ ভেঙে পড়া বৃষ্টিতে চারপাশ চুপচাপদুরন্ত অভিমানে ক্ষ্যাপা রঞ্জু এলোমেলো  পা ফেলছে ঝড় জলের শহুরে রাস্তায় আর বিড়বিড় করছে, যেতে হবেতাকে চলে যেতে হবে কোথাওএই শহর ছেড়ে অন্য কোনো গ্রহে তাকে আশ্রয় নিতে হবে।  না...  আর কিছু চাইবার নেই, কিছু নেবারও নেইএই শহরের প্রতিটি কোণ যেমন  তার চেনা, সে যাকে নিজের বলে ভেবে এসেছে এতকাল, সেও তার আপন কেউ নয়, যেমন পৃথা... কোথাও সে আর থাকবে না

রঞ্জু হাঁটছেপ্রতিটা পদক্ষেপে ছড়িয়ে যাচ্ছে অভিমান, ক্রোধ আর ছিটকে ওঠা কান্নাঅন্ধকারে ডুবে যাওয়া রাস্তার বাঁক ঘুরে যাচ্ছে অন্য ঠিকানায়রঞ্জুর শরীরে তখন বৃষ্টির অবিরল ধারা

তারপর!

তারপর তো প্রতিদিনের নিয়মে ভোরের আলো ফোটেঅন্ধকার সরিয়ে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে দেখা দেয় সূর্যঅন্য এক দিনের শুরুআর সেই দিনের শুরুতে যখন গাড়ি থেকে পৃথা তার ডান পা' টি বাড়ায় তখন বেড-টির সময় পেরিয়ে ব্রেকফাস্ট  টেবিলে বসার সময়পৃথার হাত থেকে তার রুকস্যাক ওঠে পার্থর কাঁধে

ঝিলপাড়ের লাল হলুদ বেলুনগুলো তখন আকাশমুখি
সুতো কেবল টেনে ধরা বেলুনওয়ালার হাতে

না, এখানে বৃষ্টি নেই...




1 টি মন্তব্য: