রাস্ক্যাল
কী দরকার! মুখে সে কথা উচ্চারণ করতে পারছে না সাহানা, সেটাই তো ভালো। দ্বিধা সংকোচ একবার কোনোভাবে কেটে গেলে বাকি দিনগুলোতে যে সে গালাগাল বৃষ্টির মতো ঝরবে - এই কথাটুকু বুঝতে পারছে না ছেলেটা ! সে তো আর এমনি বৃষ্টি নয়, শিলাবৃষ্টি,
একমুখি গতি তার, শিলাগুলো সব পডবে হরিপদবাবুর মাথার ওপরেই। কথা তো একটা তিনি খারাপ বলে ফেলেছেনই। কী ভেবে বলেছেন, কেন বলেছেন, সে সব কথা অর্থহীন। খারাপ কথায় খারাপ রুচির পরিচয়, এর ওপর তো আর কোনো কথা হয় না! ঐ শোনো ছেলেটা নিজেই সেই খারাপ কথাটা উচ্চারণ করল। জিজ্ঞেস করল, তাহলে কি
'রাস্ক্যাল' গালাগালিটা?
-- হ্যাঁ তো, তা ছাড়া আর বলছি কী?
-- ওটা তোমাকে বলে নাকি? ওটা তো আপন মনে বলে বাবা। দাড়ি কামাতে কামাতেও বলে দেখেছি, আয়নার দিকে তাকিয়ে। নিজের ঘরে একা একা বসে থাকা অবস্থাতেও হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, রাস্ক্যাল! কাকে দেয় সেই গালাগালি? তোমাকে?
-- হ্যাঁ, আমাকেই দেয়। ও তুই বুঝবি না।
-- হ্যাঁ তো, তা ছাড়া আর বলছি কী?
-- ওটা তোমাকে বলে নাকি? ওটা তো আপন মনে বলে বাবা। দাড়ি কামাতে কামাতেও বলে দেখেছি, আয়নার দিকে তাকিয়ে। নিজের ঘরে একা একা বসে থাকা অবস্থাতেও হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, রাস্ক্যাল! কাকে দেয় সেই গালাগালি? তোমাকে?
-- হ্যাঁ, আমাকেই দেয়। ও তুই বুঝবি না।
হরিপদবাবুর ইচ্ছে করছে চিৎকার করে থামতে বলে সমীরকে। চিৎকার করা তাঁর স্বভাব নয়, কোনোদিন গলা উঁচিয়ে কথা বলেন না কারো সাথে, এমন কি ছেলেমেয়েদের সাথেও নয়। কিন্তু এখন আর পারছেন না। তর্কটা একটু বন্ধ রাখতে পারে না ছেলেটা! কতবার তিনি বুঝিয়েছেন ছেলেমেয়েদের, নির্মোহ বিশ্লেষণটাই শেষ কথা নয়, বুঝলি! বাঁচতে হবে, বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নির্মোহ বিশ্লেষণ মনে মনে করিস, ওটার প্রয়োজন নিজের জন্যে, প্রয়োগে এতটুকু অসাবধানী হলে ওটা মানুষকে একা করে দেয়। যেখানে দায় আছে, যেখানে তোর মুখের দিকে চেয়ে আছে কেউ। সেখানে ওটার প্রয়োগ অচল, সেখানে ওটা নিষ্ঠুরতা। এতবার বুঝিয়েও বোঝাতে পারেন নি হরিপদবাবু যে, সংসার হচ্ছে আট/দশ মাসের বাচ্চার মতোন। তাকে যে আদর করি, তাকে যে ভালোবাসি, তা করি তার আবোল তাবোল কথায় হেসে আর তার সাথে আবোল তাবোল কথা বলে। ভিতরের আদরটা সত্যি হলে বাইরের আবোল তাবোলকে মানতে হয়। মেয়েটা তবু বোঝে, কিন্তু বয়সে বড় হয়েও ছেলেটা রয়ে গেল নাদান বাচ্চা, বিজ্ঞান পড়ে সে এখন এক বোধশূন্য বুদ্ধিমান।
না পেরে শেষে আবার ফিরে গেলেন অগ্নিকুণ্ডে। গিয়ে বসতেই চোখ কটমট চরে তাকালেন সাহানা দিদিমণি। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝটকায় আবার ফিরিয়ে নিলেন মুখ। হরিপদবাবু মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী রে মনীষা, তুই কিছু বলছিস না যে?
-- বলব কী, আমায় কেউ কিছু বলতে দিচ্ছে? নিজেরাই শুধু বলে যাচ্ছে।
হরিপদবাবু বললেন, না না, তুই বল। মনীষা বলল, আমি আর কী বলব, আমি শুধু বলব, দোহাই তোমরা এবার একটু চুপ করো, রাত অনেক হলো। তবে আমি কিন্তু একথা বলব, বাবা, এটা তোমার দোষ, তুমি কেন কথায় কথায় ঐ খারাপ কথাটা বল? হলের মধ্যে ঐ খারাপ কথাটা কেন বললে?
-- হ্যাঁ মা, ঠিক বলেছিস, বলে সামনের টেবিলের ওপর থেকে জলের বোতলটা নিয়ে ঢক ঢক করে জল খেয়ে নিলেন খানিকটা ।মনীষা ভ্রূ কুঁচকে বলল, জল খেলে কেন এতটা, এরপর খেতে বসে বলবে খিদে নেই। হরিপদবাবু বললেন, সত্যিই তুই মা হোস আমার। তবে হ্যাঁ, দুটো কথা আছে। একটু থেমে তারপর আবার বললেন, এখন এই মুহূর্তে তৃষ্ণাটাই সত্যি, আপাতত ওটার নিবারণ হলেই শান্তি। দ্বিতীয়ত, খিদে তো একটা অশান্তি, খিদে তো একটা আগুন, জল ঢেলে নিভিয়ে দিতে পারলেই তো ভালো। যে খিদেটা সত্যিকারের খিদে, সে ঠিক আড়াল থেকে খবর পাঠাবে। আমাদের খিদে, তৃষ্ণা, মনে হওয়া, কথাবার্তা, যুক্তি, যাই বল না কেন, বেশির ভাগই বানানো, সত্যি নয়।
তা যে সত্যি নয়, তা আমরা জানতেও পারি না, কারণ আমাদের অনুভব এখন আমরা যুক্তির কাছে গচ্ছিত রেখেছি। না রেখেই বা উপায় কী? সূর্যের আলোয় আলোকিত হওয়ার ঝোঁকে কেউ যদি সূর্যের দিকে তাকায়, চোখ তার অন্ধ হবেই। আমাদেরও হয়েছে তাই, যুক্তির আলোর ঝলকানিতে ঝলসে গেছে অনুভবের চোখ। অন্ধ অনুভব তাই এখন যুক্তির কাছে বেগার খাটছে।
এই যে এখন কথা বলতে বলতে যে প্রসঙ্গে এলাম, এটা নিয়ে একটু বেশি ভাবলেই আপনা থেকে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে 'রাস্ক্যাল'। এটা নিঃসন্দেহে একটা গালাগালি, তোমার মা ঠিকই বলেছে, এবং সে গালাগালিটা যে সত্যিই কারো উদ্দেশে, সে কথাও সত্যি। কিন্তু কাকে যে গালাগাল করি, তা আমি নিজেও জানি না। আজও খুঁজে পাইনি তাকে। আশ্চর্য, কখনো কখনো আমার মধ্যে এসেও উঁকি মারতে দেখি তাকে। দেখতে পেলেই রাস্ক্যাল বলে চিৎকার করে উঠি। তখনকার মতো পালায় সে। কিন্তু বুঝতে পারি, নিস্তার নেই, অন্তরালে সক্রিয় সে, তারই অঙ্গুলি হেলনে সব চলছে। যজ্ঞের আগুনে শুয়োরের মাংস ফেলে দিয়ে সর্বত্র আয়োজন পণ্ড করে চলেছে সে।
সাহানা দিদিমণি এতক্ষণে নরম হয়েছেন একটু। যে মানুষটার প্রেমে পড়েছিলেন প্রথম, আবার যেন দেখতে পেলেন তাকে। সেও এইরকম অনর্গল বকবক করত। তার মানে বোঝা যেত না, কিন্তু অচেনা জলপ্রপাতে ভিজে এক সা হয়ে যেত সাহানা রায়। তাই তার সাহানা সরকার হয়ে যাওয়া। মাঝখানের দীর্ঘ দহনের বেলা যেন নিমেষে উধাও হয়ে গিয়ে সেই দিনগুলো ফিরে এলো ক্ষণিকের জন্য। সাহানা দিদিমণি বেশ নরম গলায় বলল, তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু হলের মধ্যে আবার তোমার কী হলো যে অমন চেঁচিয়ে উঠলে?
চোখমুখ দেখে মনে হলো যেন রেগে গেলেন হরিপদবাবু, অথচ কখনো তিনি রাগেন না। খুব লম্বা শ্বাস নিলেন বার দুই। তারপর বললেন, রবি ঠাকুরের ক্ষুধিত পাষাণ পডেছ তো! পাগলা মেহেরের যেমন হতো, আমারও তেমন হয়। অন্যরা যখন অন্য রকম কিছু দেখতে পেত, সে তখন চিৎকার করে বলত, তফাৎ যাও, সব ঝুট হ্যায়। আমারও তেমনি, যেই বুঝতে পারি চোখের সামনের দৃশ্যের আড়ালে রাস্ক্যাল তার শয়তানি খেলা খেলে যাচ্ছে, অমনি ভিতর থেকে চিৎকার উঠে আসে, 'রাস্ক্যাল'! নাটকে আমি দেখলাম ছেলে তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইছে মায়ের কাছে। কোনো মহত্ত্ব নেই এর মধ্যে। simply need based action। প্রয়োজন আছে, তাই। মা ছেলেকে ক্ষমা করে দিচ্ছে। উপায় নেই, তাই। ওটাও need based। তার মানে rascal is playing behind the scene। অথচ সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখছে। তার মানে সবাই রাস্ক্যালের দ্বারা বশীভূত। পাগলা মেহেরের মতোন আমারও মনে হলো, জাগিয়ে দেওয়া দরকার সবাইকে। তারপর আর কিছু জানি না, কখন আপনা থেকে একটা চিৎকার উঠে এলো, 'রাস্ক্যাল'! এ রকম ঘরেও দেখতে পাই, নিজের আচরণেও দেখতে পাই। তাই তখনও চিৎকার...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন