কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা




১৯) ভ্যালেন্টাইন্স ডে


ওয়ান্স আপন এ টাইম, মাদারিপুর না মাদাগাস্কার কোথায় যেন একটা নাগা সন্ন্যাসী ছিল। নাগা সন্ন্যাসীরা তো ড্রেস ফ্রেস পরার ঝামেলায় যায় না, অফিস কাছারিও যায় না জেনেরালি, তাই সে ঘুরে ঘুরেই বেড়াত। কথাবার্তা বিশেষ বলত না, খিদে পেলে কারো বাড়িতে ঢুকে পড়ে খ্যানখেনে গলায় বলত, ভিক্‌ষাং দেহিভয়ে হোক, ভক্তিতে হোক, লোকজন কিছু খাবার দিয়ে দিত সেই সন্ন্যাসীকে। তাই খেয়ে বিশাল একটা ঢেকুর তুলে বাড়িয়ালাকে থ্যাঙ্কিউ বলে সে আবার হাঁটা জুড়ত।

মান্না দের প্রপিতামহের প্রপিতামহ সেই সময় সে অঞ্চলের কালেক্টর না ছোটদারোগা,  কী একটা ছিলেন। ওদের তো রক্তে গান। ভোরবেলা থেকেই উনি ছাদে বসে ভৈরব ভৈরবী এই সব বিচিত্র রাগরাগিনীতে বিভিন্ন ধরনের রব তুলতেন হাওয়ায়। তাতে  বাড়ির ত্রিসীমানায় কাগ্‌পক্ষী বসতে পারত না।

তো সেদিন সকালে উনি তাই করছিলেন। ওর ছোট মেয়েটা কাবুলিওয়ালা গল্পের   মিনির বয়েসী, মানে ছোট ভার্সানেরটা, যাকে দেখে কাবুলিওয়ালা বলত, খোঁখি, সসুরবাড়ি যাবে, সেইটা। সে তার ঘরে বসে পুতুল টুতুল নিয়ে খেলছিল আর লুকিয়ে  লুকিয়ে কুলের আচার খাচ্ছিল, এমন সময় সেই নাগা সন্ন্যাসী ঢুকে পড়ল সেই ঘরে, আর ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ভিক্‌ষাং দেহি

বাচ্চাটা তো ভয়েই একশেষ। ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল সে। তাই দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নাগাবাবু কাট মারলেন।

হঠাৎ নিচে কান্নার শব্দ পেয়ে গান থামিয়ে ছুটে এলেন মিস্টার দে। জিগ্যেস করলেন,  কী হয়েছে?
মিনিখোঁখির বিহ্বলতা তখনো যায়নি। তখনো সে কাঁদছে – ভ্যাঁ। সেইভাবেই উত্তর দিল – ভ্যাঁ। ল্যাংটা ইন
পাশের বাড়ির ওর সহপাঠীর কানে গেল সেটা। ব্যাস, ইস্কুলে মিনিখোঁখির নাম হয়ে গেল ভ্যাঁল্যাংটাইন দে। এই বলে ওর বন্ধুরা সবাই ওকে খ্যাপাতে লাগল।

সেসব কত বছর হয়ে গেল, হুজুগে মানুষ সেটা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। এই ক’দিন আগেই তো দেখলাম – কী আদিখ্যেতা, কী আদিখ্যেতা!

* * * * * *





ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে আদিখ্যেতা হবে, অথচ একটু কাব্যি হবে না, তা কি হতে পারে? আর কাব্যিই যদি হয়, মহাকাব্যি নয় কেন? গণেশ-ব্যাসদেব যা সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন, তাতে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদী কী করতেন, আসুন আমরা একটু ওঁদের বেডরুমে উঁকি মেরে দেখি...

যুধিষ্ঠির ঘরের বাইরে যু-লেখা খড়মটা খুলে একটা ভারি পাথর চাপা দিয়ে বেডরুমে ঢুকলেন। এত সাবধানতা, কেননা কিছুদিন আগে এক হতচ্ছাড়া কুকুর খড়মকে খাদ্যবস্তু ভেবে সেটা মুখে নিয়ে পালিয়েছিল, আর ভীম ঘরে কেউ নেই ভেবে ঢুকে পড়েছিলেন প্রায়। যু-টা দ্রৌপদীই লিখে দিয়েছিলেন কাঠে এমব্রয়ডারি টাইপ কিছু  করে। ঘরে ঢুকতেই দ্রৌপদী বললেন, হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, প্রভু!’ 
যুধিষ্ঠির যুদ্ধে স্থির থাকলেও প্রণয়ের ব্যাপারে বেশ নাদান। বললেন, সেটা কী,  যাজ্ঞসেনি? কোনো খাদ্যবস্তু?
দ্রৌপদী বললেন, আজ যে লাভ করার দিন, নাথ
যুধিষ্ঠির বললেন, তাই নাকি?
শকুনিটা ভাবে আমি সবতাতে ধুর 
পিঁপড়েয় মেরে দেয় যে লাভের গুড়
দ্রৌপদী বললেন, সে লাভ নয়, আর্যপুত্র!হলো ভা্লোবাসায় দক্ষতা
যুধিষ্ঠির বললেন, হলো’
সমস্ত খেলাতেই আমি বেশ দক্ষ
বিশ্বাস না হলে, নিয়ে এসো অক্ষ
দ্রৌপদী বুঝলেন, এ ব্যাটা আস্ত গোঁয়ার। একে কিছু বোঝানো মহা মুশকিলের। তবু বললেন, না না সে আমি জানি। আপনি সমস্ত খেলাই বেশ খাসা খেলেন,  হৃদয়বল্লভ
যুধিষ্ঠির বললেন, সে কি আমি জানি না?
শকুনিকে দেখাবোই কত আমি খাসা 
নেক্স্‌ট্‌ যে দিনই হবে সভামাঝে পাশা

এই সব শুনলে কার না রাগ হয়! যে কথাই বলতে যান দ্রৌপদী, ঘুরে ফিরে ঠিক পাশাখেলায় নিয়ে ফেলেন যুধিষ্ঠির। হতোদ্যম হয়ে মুখ বুঁজে বসে আছেন, তাই দেখে যুধু সংশয় প্রকাশ করলেন,
কী হলো তোমার প্রিয়ে, কোনখানে পীড়া?
দেখাবো তোমায় কত ভালো দ্যূতক্রীড়া

আবার পাশা!
যুধিষ্ঠিরের পাশাখেলার নেশা ছাড়ানোর জন্যে দ্রৌপদী কী না করেছেন! কিছুতেই কিছু হয় না। কোনো বিষয়েই জ্ঞানগম্যি নেই। উপায় না পেয়ে তিনি তাঁকে একখানা   জেনারেল নলেজের বই কিনে দিয়েছেন। কিন্তু সে বই উল্টেও দেখে না যুধু।
দ্রৌপদী বললেন, জিকে-র বইটা কি দুপাতা পড়েছেন? আমি পড়া ধরি, নাথ?
যুধিষ্ঠির বললেন,
কী যে করো প্রাণাধিকে, আবার জিকে 
এবার পাশায়
আমি হারাবো শকুনিকে
দ্রৌপদী কপাল চেপে বসে পড়লেন। তাই দেখে যুধু বললেন,
কী হয়েছে, ব্যথা বুঝি তোমার কপালে
পাশা খেলো, হারাবোই তিন চার চালে

দ্রৌপদীর আর সহ্য হলো না। বাইরে থেকেই লোকে ভাবে, কী ভাগ্য মেয়েটার, পাঁচ-  পাঁচটা বর, মানে কত না আদর, কত না আহ্লাদকিন্তু তারা জানে কী, সব এক একটা রত্ন! কাজের কথা বলতে গেলেই সব এক এক ফিকির তোলে। রেগেমেগে শুরু করে দিলেন,
ভ্যালেন্টাইন ডে-তে বেডরুমে পাশা
গোস্পদে ডুবে মরো, বোকাপাঁঠা, চাষা।
মনে হয় কুচিকুচি কাটি, নিয়ে বঁটি
স্বভাবে বাঙাল, আর কাজে ব্যাটা ঘটি।
পাঁচপাঁচখানা ভাই, সবকটা জালি
জানে
না কোথায় সম, কোনখানে খালি।
দুর্যোধনও দেখি এর চেয়ে ভালো
জানে কোনখানা মিঠে, কোনটা যে ঝাল ও।
ভ্যালেন্টাইন নাম শোনেইনি, ঋষি
পেটে ধরেছিল একে কেষ্টার পিসি!
কেষ্ট, সরাও একে, করো উপকার,
ধর্মের ছেলে হোক ধম্মের ষাঁড়!

এই অবধি লেখা হতেই গণেশ চোখ তুলে তাকালেন ব্যাসদেবের দিকে। বললেন, , এতক্ষণে বুঝলাম
ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে জন্মেছে বিদুর!
শুনেই ফেললি তুই, ও বাবা, ইঁদুর!
যা দেখি যুধিষ্ঠিরে
মন্ত্র দিয়ে আয় শিরে
অক্ষয় হোক তাহে দ্রৌপদীর সিঁদুর

* * * * * *




এই হচ্ছে মহাভারতের যুগের ভ্যালেন্টাইন্স ডে। এবার স্টেপ জাম্প করে চলে আসুন আধুনিক ময়দানে। বাংলা আধুনিক কবিতায় জয়ের মতো ভ্যালেন্টাইন গন্ধমাখা  প্রেমের কবিতা আর কে লিখেছে? মেঘবালিকা-টালিকা? তো জয়েরই একটা কাব্যির ভ্যালেন্টাইন সংস্করণ চেখে দেখা যাক –
বেণীমাধব, বেণীমাধব, তোমার বাড়ি যাব
বেণীমাধব, আমায় তুমি করতে একটু লাভ-ও?
বেণীমাধব মোহনবাঁশি তমাল তরুমূলে
বাজিয়ে কেন আমায় তুমি অমন করে ছুঁলে?
ডেস্কে বসে অঙ্ক কষা, ছোট্ট ক্লাসঘর
তোমায় ভেবে আমার কেন হঠাৎ গায়ে জ্বর!
আমি তখন হলুদ শাড়ি, আমার ক্লাশ নাইন,
সুলেখাদের বাড়ির ছাদে হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন!

বেণীমাধব, বেণীমাধব, লেখাপড়ায় ভাল
তোমায় ভেবে অন্ধকারেও আমার জ্বলে আলো
তোমায় দেখে এক দৌড়ে পালিয়ে যাই ঘরে
ভাবতে থাকি, এমন খুশি হৃদয়গহ্বরে!
কুঞ্জে অলি গুঞ্জে তবু ফুটেছে মঞ্জরী
মা বললেন, ঢুলিস কেন? মন দিয়ে দে বড়ি

আমি তখন ষোলো বছর, পেছনে বেশ লাইন
ব্রিজের ধারে, বেণীমাধব, আবার ভ্যালেন্টাইন।

বেণীমাধব, বেণীমাধব, এতদিনের পরে
সেদিনগুলো ভাবতে গেলে মনটা কেমন করে।
সেসব কথা বলেছ তুমি তোমার প্রেমিকাকে?
আমি কেবল মুখ ফসকে একবারটি মা-কে
বলেছিলাম। মা বললেন, কী করলি মুখপুড়ি!
লাটাই হাতে থাকবি বসে, কাটবে যখন ঘুড়ি।
হলুদ ফুলে চোখ জ্বলে যায়, আমি সর্ষের ক্ষেতে
একলা বসে সেসব ভাবি ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে।

রাতে এখন ঘুমোতে যাই একতলার ঘরে
সেদিনগুলো ভাবলে আজও গা পুড়ে যায় জ্বরে।
আমার পরে যে বোন ছিল, চোরাপথের বাঁকে
হারিয়ে গেল, আমি এখন মাছটা লুকাই শাকে।
মাথার ওপর সূয্যি জ্বলে, রাত্রে জ্বলে শশী
শীত-গ্রীষ্ম বারোমাসই আমার একাদশী।
তবু আগুন, বেণীমাধব, আগুন জ্বলে কই?
ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তেও পাতে গুড়বাতাসা-খই!

* * * * * *

পচা টমেটোর ট্রাক এসে দাঁড়ালো মনে হচ্ছে দরজার বাইরে। কাব্যি অনেক হলো দাদুর ভ্যালেন্টাইন-মার্কা প্রেমের গানের বারোটা বাজিয়ে আজকের মতো ছুটি নিই –
আমার ছড়ানো কবিতায়
খুশি নাই, ভূষি নাই গো –
আমার ছড়ানো কবিতায়।
গোমাতারা কাব্যজগতের
বিচালিরে খায়, ছিঁড়ে খায় গো –
আমার ছড়ানো কবিতায়।।

যদি উখো তুমি নাহি পাও
স্যান্ড পেপার দিয়ে ঘষে দাও,
আমি ছন্নছাড়া এ জঘন্য ছড়া
হারগিজ নাহি চাই গো –
আমার ছড়ানো কবিতায়।।

আমি সামারে গরমে রহিব কাহিল
শীতে আটকে যাবে শ্বাস,
দীর্ঘ বরষা, ভীড় গো পথে তাও,
নীড় গলে বেরোবে কী বাঁশ!

যদি বালুচরে বাঁধো বাসা,
যদি হয়ে থাকো খাজা চাষা
তবে তুমি কাটো ঘাস পুরো বারোমাস,
আমি যতনে ছড়াই গো –
আমার ছড়ানো কবিতায়।।





0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন