হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল।
আমাদের ড্রয়িংরুম কাম ডাইনিং রুমের পিয়ানোটা অচেনা এক সুরে বাজছে। আমার ফ্ল্যাটের
অন্য বাসিন্দা সন্দীপ পিয়ানোতে হাত বোলালেই ব্যাং-ব্যাং আওয়াজ হয়। তাই এমন
পিড়িং-টিড়িং সুরেলা বাজনায় আশ্চর্য হয়ে বিছানা ছেড়ে ড্রয়িংরুমে এলাম।
ড্রয়িংরুমে অল্প আলো।
রাতের খাবার শেষ করে ঘুমোতে যাওয়ার আগে এককোণে একটা বাল্ব জ্বালিয়ে রেখে
গিয়েছিলাম। তার মৃদু আলোতে দেখলাম পিয়ানোর সামনে বসে আছে বছর আটেকের একটা মেয়ে।
বয়সটা আন্দাজে লিখলাম। দু’তিন
বছর এদিক-ওদিক হওয়া আশ্চর্য নয়। একনজর দেখলাম। রোগাপ্যাটকা
একটা মেয়ে লাল বুটিদার ফ্রক পরে বসেছে পিয়ানোর সামনে রাখা টুলটাতে। দু’ চোখ বন্ধ
করে পিয়ানোর কীবোর্ডে আঙুল বুলিয়ে চলেছে সে। আর সেই সাথেই অল্প অল্প নড়ছে তার ঠোঁট
দুটো।
এই রাতদুপুরে এই মেয়ে
আমাদের ফ্ল্যাটে কোত্থেকে এলো?
অবাক
গলায় আমি প্রশ্ন করলাম –
“কে তুমি?” আমার
মৃদুস্বরের প্রশ্ন পিয়ানোর পর্দা ভেদ করতে পারল না। তাই গলার স্বর ওঠালাম –
“Who are you?” অকস্মাৎ বেসুরো হয়ে থেমে গেল বাজনা। মেয়েটা
চোখ খুলে তাকালো আমার দিকে। সে চোখের কোনও তুলনা হয় না। মাঝরাত্তিরে আমি রবি ঠাকুর
বা জয় গোস্বামী হতে চাই না। কিন্তু সে তাকানো মায়াবী সুন্দর। পৃথিবীর যাবতীয় বেদনা
নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে মেয়ে। তার সুরেলা সময়টা থামিয়ে দিয়েছি আমি এক
সুন্দররাক্ষস।
সে চোখের দিকে তাকিয়ে
সম্মোহিতের মতো
আমি ফিসফিস করে আমার ভাঙা ভাঙা চেক ভাষায় ক্ষমা চাইলাম
– “Je mi líto.” ড্রয়িংরুম থেকে ধীর
পায়ে ফিরে এলাম বিছানায়। মেয়েটা কে – এই
প্রশ্নের থেকেও এখন আমায় বেশি করে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে অপরাধবোধ। একটা ছোট্ট মেয়ের
পিয়ানোর সুর আমি থামিয়ে দিয়েছি। বিছানায় চুপ করে শুয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন
আবার বাজনা শুরু হবে।
হঠাৎ কোথা থেকে একটা
মেয়েলি কন্ঠ ভেসে এল – “Dorothy!” গলার
স্বরে মনে হলো
মধ্যবয়সী এক মহিলা। ডরোথি নামের কাকে যেন ডাকছেন। তিন চার সেকেন্ড পর আবার ডাক এলো –
“Dorothy!” এবার আমার ড্রয়িংরুম থেকে অস্পষ্ট
একটা আওয়াজ এলো। মনে
হলো কে
যেন একটা চেয়ার সরিয়ে দিল আলগোছে। বুঝলাম পিয়ানোর
সামনে থেকে টুল সরিয়ে মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়েছে। তার আবছা পায়ের আওয়াজ ড্রয়িংরুম থেকে
বাইরের হলঘর বেয়ে দরজা পর্যন্ত গেল। একটা ক্যাঁচ শব্দের পর আবার সবকিছু নিঝুম হয়ে
গেল।
বুঝলাম ডরোথি নামের
ছোট্ট মেয়েটা কারোর ডাকে সাড়া দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেছে পিয়ানো ছেড়ে। আমি বিছানায়
শুয়ে রইলাম চুপ করে। বাইরের ফুটপাতে কারা যেন নিঃশব্দে হেঁটে বাড়ি ফিরছে। পাশের
ঘাসবনে শিশিরের জলে স্ট্রীটলাইটের চকমকি দেখতে চেষ্টা করছে সেই পথিকদের কনিষ্ঠতম
সদস্য। আমি তার নাম রাখলাম ডোরা – ডরোথির
ডাকনাম।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন