বাবা ও আমরা
সতেরোর নামতাটা কিছুতেই
মুখস্থ হয় না। সাত-সতেরোং এলেই আটকে যাই। কিন্তু আমি ইস্কুলে ফাস্ট হই।
হেডমাস্টারের ছেলে বলে কথা। তাই একটু লিখতে পারি, বাকি আটজন আরও অগা-বগা। স্মৃতিলেখা
নিম্ন বুনিয়াদী (গরমেন্ট এইডেড) – সাইনবোর্ডে লেখা। দেওয়ালগুলো পাকা, চালাটা টিনের। এরপর পড়তে গেলে অনেক দূরে
ইস্কুল।
বাবা একটু একটু ইংরিজিতে কথা বলতে পারে বলে, ইংরিজি পড়ায় আমার ক্লাসে। খুব দাপট। আমি ভূগোল পড়তে ভালোবাসি। এই জেলাতে রামকৃষ্ণ মিশনের ইস্কুল
আছে। নেড়া-মাথা সাধুদের দেখলে আমার মন ভালো হয়ে যায়। ওনারা মাঝে মাঝে আমাদের
ইস্কুলে আসে। বাবার সঙ্গে কথা বলে। কাউকে বলি নি যে, মনে মনে আমার সাধু হতে ইচ্ছে
করে। দিদিকেও না। দিদি আমার চেয়ে দু’তিন বছরের বড়। দিদির রক্ত হওয়ার পর থেকে বাবা ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এখন
আমার বইগুলো মাঝে মাঝে দেখে। আমাদের মা মরে গেছে কবে, আমার মনে নেই।
বাবার দাঁতগুলো কালো,
পোকায় কাটা। অনেক দাঁত পড়ে গেছে। মুখটা রান্নাঘরের উনুনের মতো বেঁকাটেরা। বিড়ি
খায়, দোক্তা খায়। এদিকে আমি কখনো একটু পান মশলা খেলে এইসা বকে! বাবা চায়ে মুড়ি
ভিজিয়ে খায়। মিশনে মাঝে মাঝে সাহেব আসে। আমি দূর থেকে দেখি। কী সাদা, আর কটরমটর
করে ইংরিজি বলে! কোথায় শিখল? বাবা ওরকম পারবে
না। সাহেব কি মুড়ি খায়?
আমি ছুটে এসে দিদিকে
বললাম, “দিদি চা বানা শিগগীর। বাবার
সঙ্গে সাহেব!” দিদি হকচকিয়ে বলল, “চা? চিনি এট্টুখানি আছে”। বাবা সাহেবকে নিয়ে এলো ভেতরে। ইস কী বিচ্ছিরি আমাদের ঘরদুটো।
দিদিটা একটু গুছিয়ে রাখতে পারে না?
বাবা বলছিল, “হ্যাভ টী? হ্যাভ টী? মাই ডটার মেকিং টী ইন কিচেন”। দিদি ডাকল, “সন্তু, শোন্ এদিকে –
আমি বাবার কানে ফিসফিস
করলাম। বাবা ঝাঁঝিয়ে বলল, “দুলালের
দোকান থেকে বাকিতে আন্ না!”
সাহেব আমাকে দেখিয়ে কি
বলল। বাবা বলল, “ইয়েস মাই সন সনৎ। ভেরি গুড
স্টাডিং। ফারসট – অল একজামস্”।
বাবা চা-য়ে ভিজিয়ে চুষে
চুষে বিসকুট খাচ্ছে। সাহেব গোল গোল চোখে বাবাকে দেখছে। সাহেবের ডিশে দুটো দিয়েছে
দিদি। তারপর একটা বিসকুট ডুবোল। টুপ করে ভেঙে পড়ল ভেতরে। আমি তাকিয়ে দেখছি। আর একটা
বিসকুট আছে। আমি আর দিদি আধখানা করে পাব। দিদি আমাকে না দিয়ে খায় না। দিদি আড়াল
থেকে দেখছিল। বাবা ডাকেনি বলে যায়নি। তাড়াতাড়ি একটা চামচ নিয়ে এলো। বাবা বলল, “মাই ডটার শান্তা। ভেরি গুড গার্ল – কুকিং,
হ্যাণ্ডোয়ার্ক”। আবার
সাহেব কি বলল। বাবা বলল, “নো
নো। গ্রোন আপ। নাউ ম্যারেজ আফটার সাম টাইম”। সাহেব মাথা নাড়ছিল, ‘ইণ্ডিয়ানস।’ একথাটা
আমি বুঝে ফেললাম।
মানকচুর ঝাল তরকারি আর
রুটি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। বাবার পাশে আমি, ওধারে দিদি একটা দড়ির খাটিয়াতে। বাবা
বলছিল, “জানিস, সাহেব কি বলল?
খুব পছন্দ হয়েছে আমাকে, আমাদের ইস্কুল, বাড়ি - সবই। আমাকে ইনভাইট করল ওর দেশে যেতে
– মানে নেমন্তন্ন। ওখানের বাচ্চারা কেমন পড়ে – তারপর, ওদের ইস্কুল দেখব”।
বললাম, “কবে যাবে বাবা?”
“এই - দেখি!”
“কি করে জানবে সেটা?”
“ওই - মিশনে খবর পাঠাবে”।
বাবা চুপ করে আছে।
আমিও। দিদি কি ঘুমোচ্ছে? বাবা বলল, “তারপর একদিন তোকেও ওরা ডেকে পাঠাবে। ওখানে কতো নামী ইস্কুল কলেজ আছে জানিস? কোট-প্যাণ্ট
ওসব... পরে পড়বি”।
“তুমি যে বললে, আমি সতেরোর নামতা পারলে আর একটু ইংরিজি শিখলে মিশনের
সাধুরা ভর্তি করে?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ তার পরে। তাড়াহুড়িতে হয় নাকি সে সব?”
দিদি এতক্ষণে বলল, “তোমরা দুজনেই খালি যাবে! আমি? বাবা আমি?”
বাবা আর কথা বলছে না।
আমি চোখ বুজে বুজে অনেক ঘুড়ির ভোকাট্টা দেখছি। নালার জলে রঙিন কাগজের নৌকো দেখছি।
অনেকদিন আগে মাঠের পেছনে দেখা রামধনু দেখছি। বাবা কি দেখছে? আর দিদি?
khub bhalo laglo... bisheshoto sheshta! :)
উত্তরমুছুনdhonyobad janai...
উত্তরমুছুনSrabani Dasgupta