কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

০৩) মেঘ অদিতি


একা, অন্ধকারে


নোটপ্যাডটা খুলে আবার বন্ধ করে দিল খেয়া, তারপর ঘর গোছাতে গিয়ে দেখল ভীষণ অস্থির লাগছে মনকী যেন একটা তাকে ঘুণপোকার মতো কাটছে গতরাত থেকে। কী সেটা, মনের আতিপাতি খুঁজে অবশেষে মনে পড়ল,রে ওই তো, গতরাতে মায়ের সাথে একচোট হয়ে যাবার সময় কিচেন থেকে ভেসে আসা একটা কমেন্ট।

মাথাটা দুম করে গরম হয়ে উঠল ওরড্রয়ার খুঁজে খুঁজে বের করল আশিকের ছবি। অনেকক্ষণ সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ধপ করে বসল ফের বিছানায়। তার সামনে আশিক, রাজীব, সৌরভ এবং খণ্ড খণ্ড অজস্র সময় ঘুরে বেড়াতে শুরু  করএকে একে তিনজনই এসে দাঁড়াল তার সামনে, আর কী আশ্চর্য, তিনজনই ওর দিকে আঙুল তুলে গতরাতে কিচেন থেকে ছিটকে আসা ওই শব্দটাই রিপিট  করল। হঠাৎ কেমন ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠল ওফুঁসে ওঠা বিপুল আক্রোশে পুরো ঘর দাপিয়ে বেড়াতে লাগল একটাই শব্দ, ‘পাগল’

আশিক এখন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। খেয়া চোখ বন্ধ করে ফেলে। গ্রহণের আবেশ ফুরোবার আগেই কী ট্র্যাজিক ছিল সেদিনের বর্জনের ভাষা আশিককে হারিয়ে  ফেলার আগে নিজেকে সেবার সে ছিন্নভিন্ন করতে চেয়েছিল

তারও আগে রাজীব হেঁটেছিল তার আরেকটি বাঁকেশৈশবে খেয়ার নানীর একটি  অবাস্তব শখ পূরণ করতে গিয়ে খেয়াকে বসতে হয়েছিল বিয়ের পাটিতেখেয়ার বালিকাসুলভ মন তখন নিতান্তই সাদামাটা। সংসার বিয়ে এসব শব্দের ভার তুলে নিতে প্রস্তুত নয় ফলে সে বিয়ে টেকেনি।

তারপর যত দিন গেছে খেয়া নিজের ভেতর নিজের জগত গড়ে নিয়েছে। একদিন হুট করে বড় দাদার কাছে নিউইয়র্ক থেকে সে পড়তে চাইল। বাবা অমত করেনি। সেখানেই পরিচয় আশিকের সাথে। ধীরে ধীরে বন্ধুত্বে আস্থা এলো, সম্পর্ক গাঢ় হলো।  যৌথ যাপনের কথা যখন তারা ভাবল তখন বাবা মা এসে তাদের মাথায় হাত রেখে দু’জোড়া হাত এক করে দিলেন আশিকের সাথে ঘর বাঁধল খেয়া নিউইয়র্কে।

হঠাৎ খেয়ার হাতে এসেছিল একটা ছবি। আশিকের সংসারে পরবর্তীতে আরও কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা এই ছবির মানুষটার সাথে জুড়ে গেল। সে যখন এক মহাকাশ প্রশ্ন নিয়ে আশিকের সামনে দাঁড়িয়ে, আশিক তখন দুর্ভেদ্য প্রাচীরকক্ষপথ দ্রুতই আলাদা  হলো তাই। একসময় খেয়া নিউইয়র্কের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে এম.বি.এ পড়তে শুরু করল।

সে অর্থে জীবন তাকে কিছুই দেয়নি। অসম্ভব বিপরীত টানের এক গতির সাথে সে তার জীবনকে বাজি রেখে চলেছে আর ভেবেছে কোথাও কেউ আছে যার ডাকে বাতিগুলো জ্বলে উঠবে মনের বাড়িতে। ভাবনাতে ভুল ছিল তার নইলে আলো তার জানালার কাচে পড়তে না পড়তেই অমন উধাও হয়ে যায় কী করে! জীবন তাকে  কাঁটাঝোপে, প্রত্নগন্ধা হাওয়ায়, কাঁকরে, ব্যূহ দিয়ে আটকে রাখতে চায়। তাকে সামনে  এগোতে দেয় না, টেনে ধরে ফসিল করে রাখতে চায়। খেয়ার আক্রোশ তাই নিজের জীবনের সাথেই।

এম.বি.এ কোর্সে রাজীব ছিল তার পড়ার পার্টনার পড়ালেখার মাঝেই আবার কখন যেন নানা রঙের ফিঙে পাখি হঠাৎ আবার গাইতে শুরু করল। রাজীবকে সে নিয়ে  এল তার নিজের বাড়িতেনিজের ঘরে রাজীব আর খেয়া, স্টাডির পুরোটাই প্রথমে  বাবা মা আর নানীর চোখ এড়িয়ে। বনেদি পরিবারে লুকোনোর ফাঁক যেমন থাকে, অলিখিত কঠোর কিছু বিধি নিষেধও তেমনি থাকে, যা পেরিয়ে গেলে বিপদ হয়।  খেয়ারও হয়েছিল হঠাৎ একদিন জানাজানি হলে নানী আর মা ওদের উপর চড়াও হয়ভীষণ অপ্রস্তুত খেয়া ছোট হতে হতে প্রথমে মিশে যাচ্ছিল লজ্জায়তারপর কী যে হলো, হঠাৎ উন্মত্তের মতো নানীর দিকে ছুঁড়ে মারল সে কাচের গ্লাস। বয়স্ক ফর্সা হাত কেটে রক্ত ঝরছে। মা হতভম্ব বাবা আচমকা তার চুলের মুঠি ধরে বেধড়ক পেটাতে শুরু করেছে তার মাথা ঠুকে যাচ্ছে দেয়ালে, বারবার। রক্ত ঝরল খুব।  সংজ্ঞাহীন খেয়া যখন হাসপাতালে লড়ে যাচ্ছে, রাজীবের চোখের সামনে ঘটা ঘটনাগুলো তখন রঙ চড়িয়ে গল্প ছড়াচ্ছে ক্যাম্পাসের বাতাসে বাতাসে।

এরপর সৌরভ এসেছিল হঠাৎ হাওয়ার সৌরভ মাখিয়ে। ব্যাঙ্কের দরজায় দেখা, পরিণতি বিয়েতে। তবে এই খেয়া ততদিনে আরও ক্ষ্যাপাটে। মুখে যা বলে তাই করে ছাড়ে। বাবা মার সাথে মতপার্থক্য হলেই ছুরি নিয়ে তাদের পিছু ধাওয়া করেআর সেভাবেই সে বিয়ে করেছিল সৌরভকে। সৌরভ যখন ছেড়ে গেল তখন খেয়া শুধু পাগল নয়, ড্রাগসেও আক্রান্ত।
****
একটু আগে ঢুলছিল। এখন খেয়া স্থির। গতরাতে কিচেন থেকে লুকিয়ে আনা ধারালো  ছুরির দিকে দৃষ্টি। চোখদুটো ধীরে ধীরে জ্বলজ্বলে হয়ে উঠছে।
****
গাঢ় স্বপ্নরঙ তার চারপাশে টুপটাপ ঝরাচ্ছে মুঠোফোন বার্তা, শুভ্র বকুল, প্রণয় মাখানো হাতচিঠি।
সে হাত বাড়াচ্ছে বকুল ভরানো সেই চিঠিগুলোর দিকে। মুঠো গড়িয়ে পড়ছে ঘুঙুর দানার মতো টুকরো সময়...




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন