দেবাঞ্জন ও মার্কোপোলো : ‘কিন্তু’
– ‘কিন্তু’। আমার ভিতরে যেন বা
হাজার হাজার ‘কিন্তু’-র বসবাস ঘন হইতেছে। আলোর সামনে অন্ধকারের সামনে – যেখানেই, যে
ফ্রেম, যে পূর্ব-নির্ধারিত সংজ্ঞাটির সামনেই দাঁড়াই, আমি উহাদের কলোনীর হাজার
হাজার যাপন টের পাই, তাহাকে কী নামে ডাকিব, আমি
জানি না। এ’ যাবৎ কাল তাহাদের কোনও সংজ্ঞা কোনও ধারণা আমার মাতা-পিতা
পরিবার পরিজন বা স্বজন বান্ধব দ্বারা পরিবাহিত হইয়া আমা অবধি পৌঁছায় নাই। আমি
অসহায়, জাঁহাপনা!
– আমাকে জাঁহাপনা বলিবেন না।
– আপনি কে?
– সঠিক সময়ে এর উত্তর হইবে। তৎপূর্বে জানাই, আপনি মানসিক
বিকারগ্রস্ত। আপনাকে সাহায্য করিতে আমি প্রস্তুত।
– দয়া।
– ‘কিন্তু’ নহে, আপনি ‘কত কিন্তু’-র শিকার। অথচ ইহাদের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞান। এ’ আজিকের কাহিনী নয়।
বহু বহুকাল আগের, মানব-সভ্যতা শুরুর দিনের। ‘কিন্তু’ যদি একক হয় তবে সে
স্রষ্টা। যদি সে ‘কত কিন্তু’ হইয়া পড়ে তবে সৃষ্টিশীলতা হারায়, তাহার মধ্যে সাম্রাজ্য
গড়িবার বাসনা আশ্রয় নেয় – সে অশ্বারোহী হইয়া ওঠে। যে কাহিনী আজ আমি আপনাকে ওয়াকিবহাল
করিতে চলিয়াছি তাহা মনোযোগ দিয়া শোনেন, সমঝেন। যে নিঃসংজ্ঞা অপ্রকৃতিস্থ
অফুরান-মাত্রার শূন্যে আপনার বিচরণ, তাহা হইতে মুক্তির চেষ্টাই হোক আপনার ধর্ম।
পৃথিবীতে তখনও মানুষের আবির্ভাব ঘটে
নাই। ‘কিন্তু’-ই প্রথম। মানুষের ঘনত্ব উষ্ণতা ইত্যাদি ধর্ম লইয়া সেই প্রথম
এই পৃথিবীতে প্রথম মানুষ হইয়া আসে। তাহার সঙ্গে ছিল একটি গরু। সে সারাদিন সেই
গরুটিকে সাথে করিয়া এ’ধার ও’ধার ঘুরিয়া বেড়াইত। ফলমূল যাহা পাইত, খাইত। কৃষির স্বপ্ন দেখিত। অন্যদিকে, সেসময় স্বর্গের রাজা
গগুলুর মেয়ে ‘নামবি’। নিজের ভাইদের সহিত মাঝে মধ্যে
খেলিতে আসিত পৃথিবীতে। সেরকমই এক দিন বুগান্ডাতে দেখা হয়
নামবি আর কিন্তুর। কিন্তুর ওই শরীর, মেদহীন পেশী, সমস্ত দিন পরিশ্রমে ঘাম ঝরিতেছে – মুগ্ধ বিহ্বল হইয়া
পড়ে স্বর্গবাসী নামবি। পুরুষের এই রুক্ষতার উৎসব, তাহার শোভা সে আগে দেখে নাই।
ইচ্ছা হয়, কিন্তুর রূঢ় হাতের
তালু দিয়া নিজেকে একবার স্পর্শ করে। নামবি, কিন্তুর সহিত সংসার করিতে চায়। তাহাকে
লইয়া স্বর্গে চলিয়া আসে। গগুলু প্রাথমিকভাবে এই বিবাহে আপত্তি করিলেও, শেষে রাজি
হয়। সে অনেক দীর্ঘ ঘটনা। সবটা এস্থলে প্রাসঙ্গিকও নহে। তবে, ইহার পর সকলের
সম্মতিতে কিন্তু আর নামবি পৃথিবীতে ফিরিয়া আসে সংসার করিতে ও মানব-ধারার জন্ম দেয়। ‘কিন্তু’-ই এ’ মনুষ্য-কূলের প্রথম পিতা, স্রষ্টা সে। আর ‘কত কিন্তু’ কে জানেন?
– কে?
– এক প্রবল
অশ্বারোহী। হন্তা। ক্ষমতার প্রকাশ্য ঔদ্ধত্যে শেষাবধি শাসক। চোদ্দশ শতাব্দীর শুরুর
দিক। বুগান্ডায় তখন নানারকম আদিবাসী প্রজাতি গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করে। প্রত্যেক
গোষ্ঠীরই নিজস্ব দলপতি। সে দলপতিদের মধ্যে যে সর্বাধিক ক্ষমতাশালী, সেই আধিপত্য
বিস্তার করে। ‘কত কিন্তু’ সেখানে আক্রমণ চালাইলেন। সেখানকার সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর
থেকেও ক্ষমতাশালী তাহার বাহিনী। সে এক তুমুল আক্রমণ। ভয়ে লোভে আদিবাসী দলপতিদেরও
কেউ কেউ যোগ দিলেন তাঁহার সাথে। জিতিয়া গেলেন এবং ওই বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীগুলোকে
সঙ্ঘবদ্ধ করিয়া সেই প্রদেশের প্রথম রাজা। যাহার সাথে তাঁহার মূল লড়াই হইল, মানে
সেই সময়কার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দলপতি – তাহার নাম ছিল, বেম্বা। তাহারই
বাড়িটির নাম বুগান্ডা। বাড়ির পাশে ছোট্ট পুকুর। ‘কত কিন্তু’ জয়ের উল্লাস
উদযাপনের জন্য সেই বাড়িটিতেই রাত কাটাইলেন। সেই পুকুরে স্নান সারিলেন। তাহারই থেকে
ওই প্রদেশের নাম বুগান্ডা। আজও সে’ বাড়িতে রাত কাটাইয়া অভিষেক উদযাপিত হয়। ভাবুন, একটি লোক
হত্যা করেও তৃপ্ত হইল না। তাহার
পরও তাহার চাই ধর্ষণ, বাড়ি বিছানা
খাট আসবাব পুকুর... সবেতে নিজের দম্ভ গেঁথে দেওয়া।
আলো পরিষ্কার হইতেছে। এমতাবস্থায়, উপরোক্ত আওয়াজের উৎসটি বেশ কিছুক্ষণ শান্ত থাকেন। তারপর বলেন,
– বড্ডো মজার বিষয় কী জানেন? কত কিন্তুর পুরো নাম ছিলো ‘কত কিন্তু কাকুলুকুকু’ আর তার সহধর্মিণী ‘নামবি নানতুত্তুলুলু’। স্রষ্টা ‘কিন্তু’ আর রাজা ‘কত কিন্তু’ দুয়েরই সহধর্মিণী শেষ অবধি ‘নামবি’। কি মজা, না?
– বড্ডো মজার বিষয় কী জানেন? কত কিন্তুর পুরো নাম ছিলো ‘কত কিন্তু কাকুলুকুকু’ আর তার সহধর্মিণী ‘নামবি নানতুত্তুলুলু’। স্রষ্টা ‘কিন্তু’ আর রাজা ‘কত কিন্তু’ দুয়েরই সহধর্মিণী শেষ অবধি ‘নামবি’। কি মজা, না?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন