কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

০৩) তুষ্টি ভট্টাচার্য

আমার বাড়ির জানালায়

বাড়ি বলতে বুঝি নিজের থাকার জায়গা, শুধু কি এটুকুই? আমার বাড়ির আশেপাশে যারা আছে, তারাও কি আমার বাড়িকে ছুঁয়ে যায় না! আমার বাড়ি বললেই তাই মনে আসে আমার পাশের বাড়ির কথাওভালো-মন্দ মিশিয়ে যে মানুষজনেরা ঘিরে থাকে আমায়, তারাও আমার বাড়ির অংশ
আমার পশ্চিমমুখো বাড়ির জানালা খুললেই রোজ সকালে একটা বাড়ির বাঁ দিক, আর  একটা বাড়ির ডানদিক দেখা যায়। বাঁ দিকের বাড়িটা খুব চুপ থাকেএ বাড়ির দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছেকর্তা-গিন্নীর ইচ্ছে ছিল, ছোট মেয়েকে নিজের কাছে রেখে দেওয়ারকেননা ছোট মেয়ের স্কুল বাপের বাড়ির কাছেই, তাই যাতায়াতের সুবিধের জন্য সে তার বাচ্চা নিয়ে এখানেই থাকতকিন্তু তার কর্তা বেঁকে বসায় সেও চলে গেছে বাবা-মাকে ছেড়ে। এখন ক্ষয়ে যাওয়া হাড় নিয়ে এক বয়স্কা মহিলা মুখ বুজে সংসারের কাজ করে যায় আর বৃদ্ধ মানুষটি বাজার থেকে ফিরে রোজকার গাজরের রস করতে বসেনমিক্সার-গ্রাইন্ডারের শব্দ মিশে যায় ডানদিকের বাড়ির রান্নাঘরের ঝগড়ায়। অসুস্থতা এদের নিত্য সঙ্গী এখন
ওই বাড়ির ছেলেটি ততক্ষণে স্কুল চলে গেছেবাড়ির কর্তা চা করে গিন্নীকে ডাকছেন ঘুম থেকেএ বাড়ির উল্টো পুরাণে কর্তা গিন্নীর ভূমিকায় কাজ করেনগিন্নী কোনো রকমে একটু খুন্তি নেড়ে রওনা দেন তার স্কুলের উদ্দেশ্যেগিন্নীর হুকুমেই চলে সংসারতিনি তাঁর কর্তা ও ছেলেকে পাড়ার কারুর সাথে মিশতে দেন নাতাঁর বাড়িতেও কেউ যাওয়া আসা করুক, চান নারোজকার সকালের রান্নাঘরের ওই ঝগড়াটুকু ছাড়া ওদের অস্তিত্ব জানান দেয় না সেভাবেউচ্চ পদস্থ সরকারী চাকুরে কর্তা কোনো রকমে তাঁর চাকরি বজায় রেখে বাজার দোকান, ছেলে মানুষ থেকে  সংসারের সব ঝক্কি সামলান একা হাতে। তবে এটাও দেখে অবাক লাগে, যথেষ্ট ধনী হয়া সত্ত্বেও খুব সাধারণ ভাবে জীবন কাটান ওঁরা

যেহেতু আমার দক্ষিণ দিকের দরজা খুললে একটি বাড়ির অনেকটাই দেখা যায়, সেই বাড়ির মানুষগুলোর চরিত্রও তাই খুব সহজে ধরা পড়ে। লোয়ার ডিভিশন ক্লার্কের চাকরি করা গৃহকর্তার এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসারগ্রামের জমিবাড়ি ছেড়ে  ছেলেমেয়ের পড়াশোনার সুবিধের জন্য শহরের কাছাকাছি চলে এসেছেন ওঁরা ছেলেমেয়ে মেধাবীও বটেমেয়েটি যথেষ্ট সুন্দরী হওয়ার সাথে সাথে বেশ কিছুটা অহংকারীকর্তা-গিন্নী দুজনেই তাঁদের অল্প আয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে  ছেলেমেয়েকে সব সুবিধে দিয়ে এসেছেনতবুও মেয়েটির চাহিদার আর শেষ নেই যেন! বুদ্ধিমতী হওয়া সত্ত্বেও কলেজে উঠে অনেক স্তাবক জুটে যাওয়ায় সম্ভবত মেয়েটি অনেক কিছু করে ফেলার দিবাস্বপ্নে পড়াশোনায় মনোযোগ হারায়বিয়ের  প্রস্তাব আনলে সে বলে – যে ছেলে আমায় বিয়ে করে সুইটজারল্যান্ডে হানিমুনে নিয়ে যাবে, তাকেই একমাত্র বিয়ে করব, নইলে নয়তোমরা খুঁজে নিয়ে এসো তেমন জামাই! একবার মা চোখের জল ফেলে, একবার বাবা। ভাইয়ের সাথে, মা-বাবার সাথে নিত্য অশান্তি, চেঁচামেচি লেগেই থাকে তাই। এরপরে রূপকথার মতো সত্যিই এক এন আর আই পাত্র এসে মেয়টিকে বিয়ে করে সুইটজারল্যান্ডে নিয়ে গেল হানিমুনেতারপর সুখে শান্তিতে থাকতে লাগল রাজপুত্তুর আর রাজকন্যে। ভাইটি এখনো বেকার, লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে সেওইটুকু অপ্রাপ্তি ছাড়া এই সংসারে এখন স্বস্তির ফুরফুরে হাওয়া বয়
এই বাড়ির পাশে আরও একটি বাড়ি ক্রমশ উঁচু হচ্ছে দৈর্ঘেও বাড়ির তেমন কোনো  গল্প নেই, শুধু পেটে কিল দিয়ে পয়সা জমানো ছাড়ামানুষগুলো ধুঁকছে, জানি না কে ভোগ করবে ওই বিশাল বাড়ি!
আমার উত্তরের জানালা দিয়ে দেখা যায় এক ফালি জমির পড়ে থাকা। মালিক ওইটুকু জমি বেচতে পারেনি বলে, বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে আছে ওই জমি আগাছার ভিড়ে তার পাশের পুরনো বাড়িটাকে কিনে নতুন করে সাজিয়ে চলেছে নতুন মালিককর্তার গলায় বেশ সুর আছে, গানের চর্চাও আছে কিঞ্চিৎ মাঝে মাঝে তার খোলা গলার গান বেশ উদাস করে দেয়গিন্নীর বোধহয় কিছু মানসিক সমস্যা আছে, কর্তাকে আগলে রাখে সব সময়। ছেলে সমেত তারা তিনজনে তিনজনার, এরকমই ভাব দেখায় সব সময়যদিও কর্তার আড়চোখে পাশের বাড়ির মেয়েদের দেখার কার্পণ্য হয়নি কখনো
পূর্ব দিকের জানালা খুললেও দেখি একটি বাড়ির ডান পাশ ও আর একটি বাড়ির বাঁ পাশ। এই দুই বাড়িই পাড়ার সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা, কিছুটা রক্ষণশীলও বটেদুই বাড়িতেই অনেক সদস্যের বাস এবং এখনো তারা এক হাঁড়িতেই খাওয়াদাওয়া করেবাঁ পাশের বাড়ির বৃদ্ধ অ্যালঝাইমারে আক্রান্ত হয়ে সাত আট বছর আগেই নিরুদ্দেশ হয়েছেনবৃদ্ধা সাত বছর ধরে নিয়ম করে শাঁখা সিঁদুর পরেছেনঅবশেষে ধরে নেওয়া হয়েছে বৃদ্ধ আর ইহজগতে নেই, তাই বৃদ্ধার পরনে এখন বৈধব্যের বেশশোনা যায় তিনি নাকি অবস্থার দুর্বিপাকে কোনো এক সময়ে ঝিগিরিও করেছেন ছেলেমেয়ে মানুষ করার জন্যতাঁর সন্তানেরা সুসন্তান, একথা বলতেই হবেতারা  এখন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত, মাকে মাথায় করে রাখেডানদিকের বাড়ি নিয়মিত সাংসারিক বলা চলে
এখানে ওখানে বেশ কিছু পুরনো বাড়ি বিক্রি করে ফ্ল্যাটের সাম্রাজ্য গড়ে উঠছে দেখতে পাই আজকাল। অনেক নতুন মুখ, অনেক দোকানপাট, অনেক সমৃদ্ধি জুড়ে বসছে ধীরে ধীরে এই শহরতলির বুকেভালো আছে কি এখানকার মানুষ আগের থেকে? এই প্রশ্ন শোনার কারুর সময় নেই এখনসবাই যেন কিসের ঘোরে ছুটছে আর ছুটছে। তবুও তো বাড়ছে শহর! আমার জানালা দরজায় খোলা হাওয়া ঢোকার  সুযোগ ক্রমশ কমছে। এভাবেই আমাদের মানিয়ে চলা, এভাবেই টিকে থাকা

3 কমেন্টস্: