কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ২৯ জুন, ২০১৪

০১) রমিত দে


আঁখির কোণে পাখির বাসা”
                         
“There is a
Secret
They never tell
you,
a secret
you never
see...
We are all
ALL
waiting               
for something...” – Tyler Knott Gregson-

আমরা বোধহয় বেশি দূর যেতে পারি নাহৃদপিন্ডের পেছনে খুব বেশি হলে খানিকটা দূর অবধি যেতে পারি, তাই হয়তো মেরুদন্ডতে বাস করি, আর তাই মেরুদন্ডকে স্পর্শ করতে পারি নাঅথচ যাওয়া একটা আছে। একটা তুঙ্গতা একটা ব্যাপ্তি – ঠিক যেমন ফিরে আসার দখল দায়িত্ব একটা থাকবেই। মাঝে মাঝে ভাবি  খালি কি সদর দরজাই ঢুড়ে মরব? কেবলমাত্র নিবাতমণ্ডলে ঘুরে মরব? কেউ কি  বলবে না খালি জমি হা হা করছে! কেউ কি বলবে না খালি জমি আমাকেও কিছু  বলছে! ‘ঘর ভরে দাঁড়িয়ে আছে আগন্তুক’- হাত ভরে ভরে আছে চালপানি ধূপধুনা – কেউ যেন সমুদ্রের দিকে জ্যান্ত বেরিয়ে যেতে পারছে না, পাখির মতো পথ খুলে  দিতে পারছে না। কেউ কেন বলছে না – “চক্রের বাইরে চলে এসো/চক্রান্ত থেকে দূরে/গাঁয়ের বাইরে এসে,/প্রান্তে, ঘরখালি জমি  বাঁধো

কোথায় জমি? ‘বাড়ি কই?’ কোনোদিন কি নিজের কাছেই এমন প্রশ্ন করে উঠব?  নিজের দিশা বিদিশা পেরিয়ে! ‘পৃথিবীর সাজানো স্যুটকেসে” ভিক্ষার থালা ঢোকাতে ঢোকাতে কখনও কি টের পাব হাতভর্তি পাতার ভার! পাকদন্ডী লেজ বেয়ে শুধু কি প্রান্তটুকুই পাওয়ার! এই পলকাটুকু! তাই কি দেওয়াল বানানো দরজা খোঁজার অছিলায়? এই অদ্ভুত চলাচলে আমি যেমন আছি সেটা সত্যি তেমনি আমি নেই,  এটাও কি শরীরের ঘাসে মায়াবাঁশি হয়ে বাঁধা নয়! ভীষ অন্ধকারে আমি একবার  নিজের দিকে তাকাই, নিজেকে ডাকি। আমার সেই শৈশব থেকে যতটুকু পরে আছে মীনরাশিতে, পাশ ফিরতে, ততটুকুকে নিয়েই বাঁশবন পার হয়ে নিচুজমি পার হয়ে  বাড়ির দিকে ফিরি। কিন্তু বাড়ি কই? কেবলই তো বোতাম পড়ে আছে! কেউ যেন মুখ ফেরায়নি আর। পাখির ডাকে প্রথম উল্লাসে পালিয়েছে চিরায়ত প্রসন্নে।

বাড়ির কথা মনে হতেই মনে পড়ল সেই ছবি আঁকিয়ের কথা হলুদ ড্যান্ডেলিয়ন সহ যিনি এঁকে চলেছেন এক বাগানের ছবি। স্যাঁ রেমির রিহ্যাব থেকে স্মৃতির তুলিতে একটা প্রযত্ন কবিতাকেই কি আঁকছিলেন না ভিনসেন্ট? শ্যাওলাভর্তি ছাদসহ ভাঙাচোরা আস্তানা, ঝোড়ো কোনো সন্ধ্যেয় বীচগাছের আদিভৌতিক স্তব্ধতা, কিংবা রক্তাভ মেঘের মধ্যে সূর্যের অস্ত যেতে যেতে বরফের মধ্যে মেয়েরা শালগমের ক্ষেতে সবুজ আনাজ  জড়ো করছে – এসব ছবির নাম হয়তো ‘থ্যাচড কটেজেস ইন অ্যাবের’, ‘মার্গেরিত  পাশে ইন আ গার্ডেন বা ‘মেডো ইন দ্য গার্ডেন অ্যাট সেন্ট পলস হসপিটাল নামে  অভিহিত হবে তার কিছুদিন পরেই কিন্তু ক্রিমসন লেক, ক্রোম, ম্যালাকাইট গ্রিন,  এমারাল্ড গ্রিন কিংবা অরেঞ্জ লেডে আঁকা এসমস্ত ছবি কি কেবল একটি আস্তানার  নয়? যার সাথে স্থায়ী বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কোনোদিনও হয়নি। অথচ যার কাছেই পড়ে আছে সত্তার একটি অঞ্চল, সত্তার এক ধরনে নির্ভেজাল সখ্য। এ কি  সেই দৈত্যের বাগান - খালি জমি হা হা করছে বলে বন্ধুত্ব করতে যার ওপর বেশ খানিকটা আকাশ নীল কিংবা হলুদ,  কিংবা কমলা রঙে নিজের আয়ত্বে করতে  চাইছে শিল্পী আসলে আয়ত্বে নয় আকাশের ওই আসঙ্গটাই হয়তো তার কাম্য। ভিনসেন্ট বলতেন - স্টুডিও বলে কিছু হয় না; ক্যানভাস কেমন একটা জ্যাবড়া মতো, সব কিছু ঘুলিয়ে আছে, তাই ওই  পুকেটা থেকে বেরিয়ে এসে প্রকৃতিকে পর্যবেক্ষণ কর। মনকে ঘুরিয়ে দাও অনেক প্রাণী ফুল আর খোলা হাওয়ার দিকে। কাঁটাগাছের মধ্যেই তো তোমরা শস্য রুয়েছ, তাই ক্যানভাসে খোঁজো প্রকৃতির সহজ করমর্দটুকু। ভিনসেন্টের ছবিগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একটা উৎক্রমণের ভাব রয়েছে। পালিয়ে যাবার একটা ভাষা। কত রকমের  আকাশ! কখনও পোড়োজমি শুয়ে রয়েছে আকাশের নিচে, তো কখনও আকাশ নেমে  এসেছে পৃথিবীর শূন্যকে ভরাট করতে। বেশিরভাগ ছবিতেই আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে  একটা নতুন কিছু,  নস্টালজিয়া কিছু; যা তিনি এঁকে দেখাতে পারবেন না, তাই তা নিয়েই ছুটে এসেছেন আকাশের প্রচ্ছন্ন অস্তিত্বে। এই তো, এনক্লোজড ফিল্ড উইথ রিপার ছবিতে ক্যানভাস ভরিয়ে ছড়িয়ে আছে খড় সমেত পড়ে থাকা গমের হলুদ  শিষ, আকাশও হলুদ। যেন আকাশই তার হলুদ ফ্রর্ক ছিঁড়ে দেখতে এসেছে গম ভাঙার শব্দ। ভাই থিওকে লেখা চিঠিতে গখ এ ছবির ব্যাখ্যায় বলেছিলেন- “I see in this  reaper… the image of death, in the sense that humanity might be the wheat he is reaping” অর্থাৎ মৃত্যুর, হেরে যাওয়ার প্রতীক এ ছবি। কিন্তু না,  কোথাও যেন বেঁচে থাকার একটা নিদির্ষ্ট গল্পও বোধহয় আছে। ছবিতে রঙের ব্যাপারে গখ ছিলেন যথেষ্ট সচেতন এবং হলুদ রঙ ছিল তার খুব প্রিয়, যাকে তিনি আনন্দের  সাথে অনবহিত একটা সমর্পণ আর প্রস্তুতির সাথে তুলনা করতেন। অর্থাৎ এই ক্ষেত হয়ে উঠেছে ঈশ্বরের রাজ্য, কেটে নেওয়া শস্য আর ডাঁই করা খড় আসলে ঈশ্বরের শস্য, ঈশ্বরের পরমসুখরূপ জীবন্মুক্তের সম্ভোগ। ওই যে লেমন ইয়োলো স্কাই, সে যেন   একটা হোলি স্পিরিট, দুপুরের রোদ্দুরে যে ভাঁজ করে রাখছে ভিড় উত্তাল একটা থাকা, একটা বিশ্বাসের ভূমি, কিছু ফসল কিছু স্বপ্নসিঞ্চন, মাটি কামড়ে একজন অবজ্ঞাত মানুষের কিছুতেই পিছলে ছলকে না পড়ে যাওয়ার খেলা। এই হলুদ আনন্দের মধ্যেই হয়তো কেউ গড়ে তুলছে একটা বাড়ি, শূন্যতা সংযোজিত একটা বাড়ি, না  বাড়ি না - হয়তো কাঠের ফ্রেম দেওয়া একটা কাচ শুধু। কাচের ভেতর বসে স্মৃতি আর তরল স্বপ্ন দিয়ে তার নিজের ছায়াটাকে বারবার দাঁত বের করা কয়েকটা ইঁটের সাথে কয়েকটা উচ্ছেদের সাথে কুপি জ্বালিয়ে অসহায় দেখার চেষ্টা করছে সে। ছবিটা রেফার করার উদ্দেশ্য যে কোনো দীক্ষিত শিল্পী অথবা নদীর বালির শেষে ঝিমিয়ে পড়া বেঁকে যাওয়া যে কোনো সাধার মানুষের মধ্যেই বোধহয় এই দ্বৈততা তার ইচ্ছা ও অনিচ্ছার বিভাজনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে টের পাচ্ছে, জানালা জোড়া তার  ভোর রং অথচ ঘর জুড়ে গল্প গুজব করছে রাত্রি। ফারাক বলতে কেবল শিল্পীর এচিংগুলোতে জুড়ে জুড়ে ভেসে উঠছে এক ধরনের বিষম পরিপূরকের খেলা, আর  সাধারণের সারা গায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে কেবল এক ইতস্তত সাদা পৃষ্ঠা। কেউ পথ পাচ্ছে না, ফিরতে পাচ্ছে না; সারা প্রান্তে ছুটে বেড়িয়ে যেন ফিরে ফিরে আসছে সত্তার  আস্তানার কাছেই। আসলে মানুষ নিজের ভেতরে যাত্রা করে। ছুটে বেড়ায়। কখনও মাছের আকার নেয়। পাখির আকার নেয়। অথচ বড় রাস্তা পার হলেই ঢুকে পড়ে গলির ভেতর। প্রকৃত প্রস্থানভূমিতে যেন কিছুতেই ফিরে আসতে পারে না।

মাঝে মাঝে ভাবি, কী হয় এই  কবিতা লিখে! পাথর খোদাই করে! ছবি এঁকে!  উত্তর যে খোঁজে, সে তো ঘুমিয়ে থাকে নিজেরই প্রশ্নের গভীরে। শিল্পী কি দীর্ঘক্ষণ  ধরে কিছু চায়? দীর্ঘক্ষণ ধরে কিছু খোঁজে? বিশ্বাস করে, সব খোঁজার দরকার আছে   বলে? ইজেলটাকে ভিজিয়ে রাখে, নাকি ছবিটাই শুকোয়না? মেয়েরা অলিভ কুড়োয়, লাইল্যাক পাহাড়রা মৃত্যুর মতো ঠান্ডা হয়ে ওঠে। মৃত্যু আর জীবনের এই দেহস্থিত  আনন্দকে জটলাকে কমলা সবুজ সূর্যাস্তের আকাশ দিয়ে কি মনোময় আত্মাতে উপসংক্রান্ত হতে চান শিল্পী! একটা বাড়ি চায়? ঠান্ডা বিদঘুটে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতেও যেখানে অপূর্ব থাকে! যেখানে অনির্বচনীয়কে জানতে পারবে সে, অব্যক্ততে আশ্চর্য হতে পারবে সে! কিন্তু কোথায়? কোথায় সেই পাখির বাসা? কোথায় সেই বৃহত্তর  উদ্বাস্তুর আনন্দ! অ্যাসথেটিকস অফ আর্টের মধ্য দিয়ে সে কি নিজের অস্তিত্ব নিজের অনুপস্থিতিটুকুকেই হাতড়ে মরে? জীবন আসলে জড়ো করা - কত রকমের রঙ কত রকমের ফ্রেম- “it is experienced each time as something new. Again and again man correlates himself with the world, racked with longing to acquire, and become one with, the ideal which lies outside him, which he apprehends as some kind of intuitively sensed first principle. The unattainability of that becoming one, the inadequacy of his own I, is the perpetual source of man's dissatisfaction and pain.” অর্থাৎ পরিমাপের বাইরে একটা খাঁটি প্রশ্ন ছাড়া সে আর কিছুই নয়। সে স্বয়ং পলাতক অথচ পাখনাগুলো তার সায় দিচ্ছে না হাওয়ায়। মোটা কাগজে ছাপা রয়্যাল অক্টেভো সাইজের শখানেক পৃষ্ঠা  সম্বলিত একটা বই, যার কিছু পাতায় পৃষ্ঠাসংখ্যা দেওয়া, তো কিছু পাতায় লুকিয়ে  রাখা শুকনো কোনো আল অথবা আলের পাশের রেললাইন কিছু পাতায় চিৎকার  ঢাকতে জোর করে টেনে আনা চৌকির শব্দ অথবা কিছু পাতায় লুকিয়ে রাখা বাড়ি আর আসবাবের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি মেটাতে সেই সব পোকায় কাটা সাক্ষরহীন  চিঠিগুলি। এরই ভেতর ম্যাপ হারিয়ে পড়ে আছে মানুষ, সমুদ্রের এত কাছে এসেও পাইনবনে পথ হারিয়েছে যেন। আসলে ছায়াটাকে রোজ ঝাড়পোছ করছে সে, এই ছায়ার ভেতরেই তো আমরা বসে আছি আরও কাছাকাছি। আরও অস্থায়ী হয়ে।  

১৮৮৮এর আগস্টে ভ্যান গখ Painter on the Rod to Tarascon নামের যে ছবিটা আঁকেন, সেটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। হলুদ গমের খেত,  খয়েরী গাছ কিংবা নীল জামা পরিহিত মানুষটা পুড়ে যায় কালখন্ডের উত্তেজনার আগুনে। কিন্তু ছায়াটি? শূন্যতা আর যন্ত্রণা তাকেও কি জ্বালিয়ে দেওয়া গেছিল? পুড়ে যেতে পেরেছিল ছায়াটি? হয়তো না। হয়্তো শিল্পী তা সমস্ত ছবির শেষে এই একটি মাত্র ছায়ার কাছে এসে কোনোদিনও বলে উঠতে পারেন না– This is the way the world ends/ not with a bang but a whimper” তাই এ ছায়ার মৃত্যুও নেই, ঘুরছে ফিরছে তোমাতে আমাতে, চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে আলোর অজ্ঞতাকে। অথচ এ ছায়াই কিন্তু পারে দেহ উদ্ধার করে চেতনা উদ্ধার করে সাধনা করতে বসতে ভাবের উর্ধেআলোর ভুল ভাঙাতে  দেখাতে কোন্‌টা সত্য, এ ছায়াই তো বাউলের  আউলিয়া হয়ে রয়ে গেল অনন্তের পথে পথে এই ছায়াই তো সেই স্বরূপ প্রাপ্ত আলোঅথচ কি আশ্চর্য, গখের ইমেজটির দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ছায়া তার পায়ের  সাথে এত নিঁখুতভাবে সংযুক্ত, যেন তিনি কিছুতেই ছায়াকে বলছেন না- আমায় বেরিয়ে যেতে দাওঠিক যেভাবে টলস্টয়য়ের ইভান ইলিচ মৃত্যুর কিছু আগে কালো  পাইপের মধ্যে গুঁড়ি মেরে যেতে যেতে কিছুতেই তার শেষটা না খুঁজে পেয়ে বলে উঠেছিলেন, আমায় ছেড়ে দাও। বেরিয়ে যেতে দাওতবে কি পথের সাড়া পায় না শিল্পী? নাকি প্রতীত সময়ের ভেতর দাঁড়িয়ে তিনি কিছুতেই সেই অতীন্দ্রিয় বদ্রিলা  পাখির ডাক শুনতে চাইছেন না!  তিনি কি যন্ত্রণাকে বেঁধে নিয়েছেন শরীরে, অথচ   শরীরটাকে প্রত্যাখান করতে পারেননি, আবার আবিষ্কারও করতে পারেননি! শরীরকে শূন্যতাকে কি প্রতিস্থাপন করেছেন ছায়া দিয়ে? এসব আমরা কিছুই জানি না। কেবল জানি, ছবি পুড়ে গেছে, ছায়া পোড়েনি। রয়ে গেছে কেবল একটি গন্ত্যবের জন্য  আকুতি।
আকুতিই তো! আমাদের এই থাকা আসলে আকুতিই তো! পাতার আড়ালে ঘুমোতে চেয়ে প্রায়ান্ধকারে জেগে থাকা। আছে কিন্তু নেই। শরীরের মধ্যেই রয়েছে শরীরের  ‘প্রত্যাহার’, আর্তের মধ্যেই রয়েছে আর্তির স্থান। ঠিক যেমন বাকের মাঝেই অবাকের বিশ্বাস। ঠিক যেমন চোখ দেখছে সে তো খালি চোখ দেখছে না, পাশাপাশি মনেরও ক্ষরণ জড়িত, জড়িত অব্জেক্ট অফ দ্য ইনারের ভাবনাটি ঠিক তেমনি শব্দের  ব্যাপ্তিচৈতন্য কেবল শব্দের একার নয়, তার  সাথে দোসর হয়ে রয়েছে নৈঃশব্দ্যের নাদ ঝঙ্কার, জড়িয়ে রয়েছে জীবন্ত শূন্যের অনুভাব। পুরো  জিনিসটাই একটা হাওয়ার খেলাঅর্থাৎ ভাসমানতা। প্রাত্যহিক জীবনতরঙ্গে আমরা বসাচ্ছি একটা মানুষের মুখ দুটো মানুষের মুখ তিনটে মানুষের মুখ, বসাচ্ছি বাড়িটির একটি কোণা কিংবা জমিটির একটি ফালা অথবা বসাচ্ছি বুকের ওপর একটি হাত কিংবা হাতের উপর গেঁথে যাওয়া চাবির থোলা। অথচ এর পরেও তো একটা অনুবৃত্তি একটা কনটিন্যুউটি রয়েছে, সেটা একটা অকর্ষিত জগতের, সেখানে দুহাত উপুড় করে ভিক্ষা  চাইছে দূরের ডাক। একটা ঘুমকে ঘুমন্তকে ঘোর থেকে শূন্যের দিকে টেনে ধরতে চাইছে। কী এই ঘুম? কার এই ঘুম? স্বাধিষ্ঠান থেকে মণিপুর, মণিপুর থেকে  অনাহত, অনাহত থেকে বিশুদ্ধ, আর বিশুদ্ধ থেকে আজ্ঞা হয়ে কোন্‌ আলোকায়নের   দিকে মুখ করে ঘুমের কচি পাতা ছিঁড়তে লাগলেন হঠযোগী! সাধন জগতের সাকার সদর দরজাটা পেরোলে এই নিরাকার সহজিয়ার সরলীকৃত রসটি হলো- এ ঘুম দেহের, তাকে গৃহত্যাগ করাতে না পারলে, নিঃসঙ্গ নিরাশ্রয় করাতে না পারলে সে হালকা হবে কী করে! হাওয়ার হবে কী করে! ভাঙা দেওয়াল পেরিয়ে নুয়ে পড়া ডাল পেরিয়ে  রিফিউজি কলোনী পেরিয়ে মেঝে পেরিয়ে উঠবে কী করে সে মাটির ভ্যানরিক্সায়! ওই  যে ছায়াটা, যা ভিনসেন্টের হলুদ জমিতে অভাবের জায়গাটা দখল করেছে, সেই  সত্যের ভেতরেই হয়তো আরও এক প্রতিসত্য রয়েছে। একটা পরিক্রমার প্রতিসত্য,   একটা পেরিয়ে যাওয়ার। আসলে শরীর একটা যোগ, তা থেকে অতিদূর বনপথ অবধি যেতে হলে পাখিদের প্রাত্যহিকীতে জড়াতে গেলে চাই কেবল বিয়োগ। হ্যাঁ, নিরঞ্জনশূন্য  হতে গেলে, নিরাকার হতে গেলে এই বাদলগৃহ থেকে বীজক্ষেত থেকে নিরন্তর বিয়োগ ছাড়া প্রকৃত বিশ্লেষণের আর কিই বা আছে! ছায়া থেকে মুক্তি; পাখির বাসার দিকে গুছিয়ে রাখা আঁখির ব্যস্ততা। তিনটে প্রধান নাড়ী আর সাতটা চক্রের মাধ্যমে কুন্ডলিনীকে জাগ্রত করে দেহকে ছাপিয়ে যাওয়া দেহভর্তি এক নিরীহ ঘুম থেকে। ন্ত্যেবাসী সে তার আধার থেকে অভিযাত্রা থেকে বিচ্যুতি চেয়ে স্বরূপে আস্বাদন  করতে চায় সেই নিত্যঃ নিত্যানাম চেতনঃ চেতনানাম বাড়ি যা অনিত্যের মাঝে  নিত্য হয়ে আছে, সেসব বাড়িতে শব্দ নেই কোনো, সেসব বাড়ির সাদা রং, সেসব বাড়িতে প্রজাতি ফিরে আসে পুরুষের দিকে। তাই তো মেরুদন্ডের উপান্তে ঘুমিয়ে থাকা সেই কুন্ডলীকৃত সাপকে জাগিয়ে তুলতে চায় সে। সে সাপ এঁকেবেঁকে সৃষ্টিশীল শিল্পীকেও নিয়ে চলে ভেতরের ঘরে, পরিব্যাপ্তির ঘরে মুক্তক ঘরে – প্রজ্ঞার ব্যথায় সে সেখানে কেঁদে ওঠে না, ছায়ার সৌগন্ধে পায়ের সরঞ্জাম থেমে থাকে না। সে তখন  কেবল এক শূন্য নিরূপণের সহচারী তার এখন আর ভয় নেই পা হারাবার পথ  হারাবার ছায়া হারাবার- ছায়ার থেকে ফিরে এসে সে এখন আর বলবে না-
...“সারাটা পৃথিবী তুমি রেখে গেছ স্মৃতিচিহ্ন করে;
আমি ভয়ে ভয়ে থাকি, যদি কেউ করে নেয় চুরি
            রাত্রিদিন জেগে থাকি, দিতে যদি একটি অঙ্গুরী
    যে কোনো আঙুলে বেঁধে ঘুমোতাম আমি রাত্রি ভরে”...

চিরন্তনে এই চুরির ভয় নিয়েই তো সারাদিন দেহ টিটকিরি দেয় ওই যে হলুদ পাকা ফসলের ক্ষেতে আলো এসে পড়েছে, সেও তো সাতসকালেই জানিয়ে দেয় তুলতে হবে  সঞ্চয়, তুলতে হবে আনন্দ, তুলতে হবে থাকার এই প্রচুর জটলা আর ওই যে নীল  রঙের জামা পরিহিত মানুষটা, যার পা তার ছায়া থেকে উঠতেই চায় না, সে কি নিজেও জান্‌ আসলে পথ শব্দটাই একটা মিথ্যে? কেবল নিজের ভেতর হাঁটা ছাড়া হাঁটা শব্দটাও! খাদ্য বেশ আচার এই নিয়ে দেহ একটা মিথ্যে কুঁড়েঘর মিথ্যে  কৃষিক্ষেত্রের অবোধ লালন করে চলেছে মিথ্যেই বা বলি কীভাবে! এর মাঝেই তো  হয়ে উঠছে রস, ভরে উঠছে চুরি, রসের চুরি, জেগে উঠছে চিরমুগ্ধ চৈতন্যের চোখ। এর মাঝেই তো যাবতীয় থাকা, যাবতীয় তর্কপ্রস্থান। লালনের সেই ‘ফানার ফিকিরি’  কিংবা সেই ‘আয়নামহল’ এমনই সব উচ্চকোটির আখড়া – মূলাধার থেকে নালশরীর বেয়ে বেয়ে সহস্রারে এসে আত্মপিপাসু, হয়তো স্রেফ একটা খালি খালি শূন্য শূন্য  চিরজাগ্রত স্বরূপ দেখবে বলে এভাবেই ধূলো দিয়ে দেয় চোখে, তার নিজেরই চোখে, আর চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত এক ভাসমানতার পাখি হয়তো একগুচ্ছ চৈতন্য খেয়ে  ফেলে, প্রবেশ করে মহাকালে, মহাশূন্যে, নিরাকার চেতন পুরুষে। ইড়া ও পিঙ্গলা দিয়ে নির্জনসাধক এই যে কুলকুন্ডলনীকে জাগাবার খেলা খেলেন,  শিল্পীও কি আসলে তারই ছায়ার ভেতর দৌড়চ্ছেন স্রেফ সুষুণ্মানাড়ী বেয়ে বেয়ে অন্তেবাসী দেহটিকে ইন্দ্রিয়টিকে অনিশ্চিত অজানাটিকে জগদানন্দের দিকে প্রবেশ করাবার তাগিদ থেকে! স্থূল চিন্তনের  প্রত্যাহার!ডুবতে ডুবতে খাবি খেতে থাকা চৌষট্টি কলার প্রত্যাহার!

কী আশ্চর্য, যে কান দিয়ে আমরা শুন্‌ তার নিজেরই নাকি কোনো রক্তনালী নেই!   আর তার কারণ, সে নাকি এত সূক্ষানুভূতি সম্পন্ন যে, নিজের স্পন্দনেই ছিন্নভিন্ন  হয়ে পড়তে পারে অথচ এই কান দিয়েই কুটিকুটি করছি থাকার অসুখী কান্না, ফেরার  অস্থির ধ্বনি তবে কি যে কোনো থাকাই আসলে একটা সচেতন নির্ভরতা, একটা দুর্বলতম সংস্থান? কেবলমাত্র ভাষায় ঢাকা আলোয় ঢাকা রঙে ঢাকা একটা মিথ্যে? আবার ওই চোখ, শেকড় ছিঁড়ে গেলে কতদূর যেতে পারে! চাপ চাপ  অন্ধকারের মাঝের ওই ফাঁকটুকু কি অতিক্রম করতে পারে? মানুষের মধ্যেই রয়েছে ভ্রম ও ভ্রাম্যমনতাসেদিনও আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে মা এসে বলতেন, আমাদের ভিটেমাটি এই তো সেদিনও বাবা বলতেন, আমাদের দেওয়ালহাইওয়ের সামনে  দাঁড়ালে আমাকে ঘেঁষে বাবা একটা পথ দেখাতেন, ফিরে আসতে বলতেন আমাদের বাড়ি। বাড়ি কই? জানালার সামনে দাঁড়ালে তো শুধু একটা আকাশ। আর কোনো কিছুই স্থির নয়। হুস হুস করে বেড়িয়ে যাচ্ছে। সেই যে কান্ট বলেছিলেন না- “The  starry heavens above me and the moral law within me”...এমনই একটা আকাশকে চষে মরছি যেখানে ঝুঁকি নেই পথ ছোটার, আঁকড়ে ধরার তাড়া নেই বাসি আলোকে বসে রয়েছি মধ্যরাতের কেবল একটি টেলিফোনের দিকে চোখ করে অপেক্ষা করছি? “We are all/all/Waiting for something!” বেজে উঠলেই যেন বৃষ্টি পড়বে! ল্যামিনেটেড ব্যথা খুলে উড়ে যাবে জন্মদিনের বুতরুপাখি!




1 কমেন্টস্:

  1. লেখাটির মাঝপথে এসে গখের ‘Painter on the Rod to Tarascon’ ছবির প্রসঙ্গ হতে লেখার শেষ পর্যন্ত প্রকাশের গতিতে যে মোচড়গুলি স্বচ্ছন্দে এসেছে তা খুব ভালো লাগল। ঘুম থেকে উঠে ছবির বিষয়ে এমন একটি লেখা পড়ে দিনের মেজাজটি পাল্টে গেল। লেখককে অভিনন্দন।

    উত্তরমুছুন