বর্ষণমন্দ্রিত অন্ধকারে
শম্পা ভট্টাচার্য
সে এক মহা সংগীত। হৃদয়ে তার মন্দ্র ধ্বনি। সেই ধ্বনিতে চিত্তের হারিয়ে যাওয়া, মেঘের মাঝখানে। নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে “তিল ঠাঁই”দেখতে না পেয়েই মহাকবি গেয়ে ওঠেন “ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে”। ১৩০৮ বঙ্গাব্দে শ্রাবণ মাসে লেখা “নব বর্ষা” প্রবন্ধটিতে কবি ব্যক্ত করেন, “আষাঢ়ের মেঘ প্রতি বৎসর যখনই আসে তখনই আপন নূতনত্বে রসাক্রান্ত ও পুরাতন তত্ত্বে পুঞ্জীভূত হইয়া আসে”। কবির ভাষায় সে মেঘ পথিক, “আসে যায়, থাকে না”। তাই প্রতিদিনের ব্যবহারে যে চির পরিচিত পৃথিবী -- কখনও যা জীর্ণ, কখনও বা পুলকিত, সেই জীবনের দৃষ্টিতেও যখন একফোঁটা কৃষ্ণবর্ণ মেঘের আগমন ঘটে, তখন ‘শত বরণের ভাব উচ্ছ্বাস’ কলাপের মতো বিকশিত হয়ে ওঠে; কারণ মেঘ প্রতিদিনকার মানুষকে নিয়ে চলে অভ্যস্ত গণ্ডীর বাইরে। এই নব আগত মেঘের সঙ্গে সেই নৈমিত্তিক জীবনের নেই কোনো যোগ; সে মেঘ নবীন, তার বিদ্যুৎ-দীপ্তি, তার গর্জন, বর্ষণ সবই নিত্য নূতন রূপে প্রতিভাত হয় দর্শক চিত্তে। আসলে জানা জগতের মধ্যে থাকে না কোনো রহস্য, কিন্তু -- “পূর্ব দিগন্ত স্নিগ্ধ অন্ধকারে আছন্ন করিয়া কোথা হইতে সেই শত শতাব্দী পূর্বেকার কালিদাসের মেঘ আসিয়া উপস্থিত হয়। সে আমার নহে, আমার পৃথিবীটুকুর নহে; সে আমাকে কোন অলকাপুরীতে, কোন চির যৌবনের রাজ্যে, চির বিচ্ছেদের বেদনায়, চির মিলনের আশ্বাসে, চির সৌন্দর্যের কৈলাসপুরীর পথ চিহ্নহীন তীর্থ অভিমুখে আকর্ষণ করিতে থাকে”। তখন মন ছুটে যায় শূন্যে, অনন্তে। কালিদাসের কাব্যের শিপ্রা, অবন্তী, বিদিশা, উজ্জয়িনী উপস্থিত হয় মানবমনের মানসলোকে, আর হৃদি ভেসে যায় ‘যার পায় নি দেখা তার উদ্দেশে’ । যে দেশ চলে গেছে রাজার পুরে, তেপান্তরের শেষে।
এই বর্ষা পূর্ণতা পায় কেকা ধ্বনিতে, ভেকের মিলিত আনন্দসঙ্গীতে, কখনো বা ঝিল্লির ঝঙ্কারে। কিন্তু এই নব বর্ষায় লুকিয়ে আছে এক অন্তর্বেদনার ভাষ্য। আর সেজন্যেই কি রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ বর্ষণ সঙ্গীতের মধ্যে লুক্কায়িত মনের বেদন? বর্ষার আগমনে কবিচিত্ত মত্ত মদির বাতাসে শতেক যুগের গীতিকা রচনা করেছেন, কিন্তু এই মেঘ ব্যক্তিমনকে নিয়ে যায় সুদূরে, অলকাপুরীর পথে। তাই বৈষ্ণব কবিও রাধিকার বিরহকাল হিসেবে এই বর্ষা কালকেই নির্বাচন করেছেন এবং বিশ্বের বিরহী কণ্ঠের আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছে রাধিকার ক্রন্দনগীতির মধ্যে দিয়ে –- “মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী / ফাটি যাওত ছাতিয়া” কিংবা “এ ভরা বাদর মাহ ভাদর / শূন্য মন্দির মোর”। রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে লিখেছেন -- প্রতিটি মানুষই অনন্ত বিরহী। বিরহী মন তখন মেঘকে সঙ্গী করে পাড়ি দিতে চায় সেই ঊর্ধ্বলোকে, কিংবা নিজের মানস প্রিয় বা প্রিয়ার কাছে, কারণ বর্ষণ মন্দ্রিত অন্ধকারে সব কিছু মিলিয়ে একটা ঘনঘটা উপস্থিত হয়, তখনি মনে হয় ‘সে আসিবে আমার মন বলে’, বেজে ওঠে বেদন বাঁশি, গোপন ব্যথা ছড়িয়ে যায় সকলখানে ‘গানে গানে’, আর মন চায় অশ্রু লবণাক্ত সমুদ্রকে পেরিয়ে বন্ধুর হাত ধরতে ; গেয়ে ওঠে গান --
সে এক মহা সংগীত। হৃদয়ে তার মন্দ্র ধ্বনি। সেই ধ্বনিতে চিত্তের হারিয়ে যাওয়া, মেঘের মাঝখানে। নীল নব ঘনে আষাঢ় গগনে “তিল ঠাঁই”দেখতে না পেয়েই মহাকবি গেয়ে ওঠেন “ওগো আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে”। ১৩০৮ বঙ্গাব্দে শ্রাবণ মাসে লেখা “নব বর্ষা” প্রবন্ধটিতে কবি ব্যক্ত করেন, “আষাঢ়ের মেঘ প্রতি বৎসর যখনই আসে তখনই আপন নূতনত্বে রসাক্রান্ত ও পুরাতন তত্ত্বে পুঞ্জীভূত হইয়া আসে”। কবির ভাষায় সে মেঘ পথিক, “আসে যায়, থাকে না”। তাই প্রতিদিনের ব্যবহারে যে চির পরিচিত পৃথিবী -- কখনও যা জীর্ণ, কখনও বা পুলকিত, সেই জীবনের দৃষ্টিতেও যখন একফোঁটা কৃষ্ণবর্ণ মেঘের আগমন ঘটে, তখন ‘শত বরণের ভাব উচ্ছ্বাস’ কলাপের মতো বিকশিত হয়ে ওঠে; কারণ মেঘ প্রতিদিনকার মানুষকে নিয়ে চলে অভ্যস্ত গণ্ডীর বাইরে। এই নব আগত মেঘের সঙ্গে সেই নৈমিত্তিক জীবনের নেই কোনো যোগ; সে মেঘ নবীন, তার বিদ্যুৎ-দীপ্তি, তার গর্জন, বর্ষণ সবই নিত্য নূতন রূপে প্রতিভাত হয় দর্শক চিত্তে। আসলে জানা জগতের মধ্যে থাকে না কোনো রহস্য, কিন্তু -- “পূর্ব দিগন্ত স্নিগ্ধ অন্ধকারে আছন্ন করিয়া কোথা হইতে সেই শত শতাব্দী পূর্বেকার কালিদাসের মেঘ আসিয়া উপস্থিত হয়। সে আমার নহে, আমার পৃথিবীটুকুর নহে; সে আমাকে কোন অলকাপুরীতে, কোন চির যৌবনের রাজ্যে, চির বিচ্ছেদের বেদনায়, চির মিলনের আশ্বাসে, চির সৌন্দর্যের কৈলাসপুরীর পথ চিহ্নহীন তীর্থ অভিমুখে আকর্ষণ করিতে থাকে”। তখন মন ছুটে যায় শূন্যে, অনন্তে। কালিদাসের কাব্যের শিপ্রা, অবন্তী, বিদিশা, উজ্জয়িনী উপস্থিত হয় মানবমনের মানসলোকে, আর হৃদি ভেসে যায় ‘যার পায় নি দেখা তার উদ্দেশে’ । যে দেশ চলে গেছে রাজার পুরে, তেপান্তরের শেষে।
এই বর্ষা পূর্ণতা পায় কেকা ধ্বনিতে, ভেকের মিলিত আনন্দসঙ্গীতে, কখনো বা ঝিল্লির ঝঙ্কারে। কিন্তু এই নব বর্ষায় লুকিয়ে আছে এক অন্তর্বেদনার ভাষ্য। আর সেজন্যেই কি রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ বর্ষণ সঙ্গীতের মধ্যে লুক্কায়িত মনের বেদন? বর্ষার আগমনে কবিচিত্ত মত্ত মদির বাতাসে শতেক যুগের গীতিকা রচনা করেছেন, কিন্তু এই মেঘ ব্যক্তিমনকে নিয়ে যায় সুদূরে, অলকাপুরীর পথে। তাই বৈষ্ণব কবিও রাধিকার বিরহকাল হিসেবে এই বর্ষা কালকেই নির্বাচন করেছেন এবং বিশ্বের বিরহী কণ্ঠের আর্তনাদ ধ্বনিত হয়েছে রাধিকার ক্রন্দনগীতির মধ্যে দিয়ে –- “মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী / ফাটি যাওত ছাতিয়া” কিংবা “এ ভরা বাদর মাহ ভাদর / শূন্য মন্দির মোর”। রবীন্দ্রনাথ ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধে লিখেছেন -- প্রতিটি মানুষই অনন্ত বিরহী। বিরহী মন তখন মেঘকে সঙ্গী করে পাড়ি দিতে চায় সেই ঊর্ধ্বলোকে, কিংবা নিজের মানস প্রিয় বা প্রিয়ার কাছে, কারণ বর্ষণ মন্দ্রিত অন্ধকারে সব কিছু মিলিয়ে একটা ঘনঘটা উপস্থিত হয়, তখনি মনে হয় ‘সে আসিবে আমার মন বলে’, বেজে ওঠে বেদন বাঁশি, গোপন ব্যথা ছড়িয়ে যায় সকলখানে ‘গানে গানে’, আর মন চায় অশ্রু লবণাক্ত সমুদ্রকে পেরিয়ে বন্ধুর হাত ধরতে ; গেয়ে ওঠে গান --
“বন্ধু, রহো রহো সাথে
আজি এ বাদলে, আকুল হাওয়ায় রে
কথা কও মোর হৃদয়ে, হাত রাখো হাতে”...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন