![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
প্রান্তিক
দেহটা বিরাট, পাখাদুটো শরীর থেকে বেশিটাই বিচ্ছিন্ন, শুধু মুন্ডুর কাছ থেকে আটকানো। কালচে খয়েরি। বিকট। জানলা খোল। ভাঙা কাঁচের পাল্লা অল্প দুলছে হাওয়ায়। মথটা ওখানেই সমানে উড়ছে। একবার বাইরে বেরিয়ে ফের ঢুকে আসছে। অস্বস্তি হচ্ছে দেখে। ভয়। ছোটোবেলা থেকে একটা আতঙ্ক মথে। অথচ বাগানে প্রজাপতি ওড়ে রং বেরঙের কত! ভয় করে না। ফুলের ওপর ওড়াউড়ি করে। চলে যায় ফুল থেকে মধু শুষে নিয়ে। কিন্তু মথ তা নয়। কত আর, এই আট কি ছয় বয়স। বাইরে শুনশান ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝি পোকার ডাক আর পাশের পুকুর থেকে ঘাই মারার শব্দ ছাপিয়ে মাঝে মাঝে একটা তক্ষক ডেকে উঠছে তারস্বরে অর্কেষ্ট্রার মতো, কান পাতলে একসঙ্গে কতো আওয়াজ! বারান্দায় মাদুর পেতে বসে সহজ পাঠ পড়ছি। সামনে লন্ঠন।
মা রান্নাঘরে। গন্ধরাজ ফুলের গাছ
সাদা হয়ে আছে। ঘন ঘোর রাত পথ হঠাৎ সরব হলো। বল হরি হরি বোল, বলো হরি হরিবোল চাপা গলার
দল মিলে শিউরে উঠে দেখি ঝপ করে উড়ে এসে আগুন ঘিরে ঘিরে ফরফর করছে একটা বড় কালো মথ। ঘরে আলোর নিচ বরাবর
গোলাপি দেওয়ালে। কী কুৎসিত। দুই কালচে ডানার মাঝে বিকট দেহটা লম্বাটে। সারা গায়ে
লোম। চোখ দুটো যেন থ্রী ডি।
আতঙ্কে মায়ের পেছনে লুকোই। বাবাকে
বলি, মারো! ওকে মেরে ফ্যালো! সারা ঘরে উড়ছে ঢুকছে মথ। যেন রাতে নিশিথিনী প্রেতযোনি।
যেন ডাকিনী। মা ভয় ভাঙার জন্য বোঝাতো, কুৎসিত হলেও ভয় পাস না মনি। ওরাও প্রকৃতির
সৃষ্টি।
পড়ন্ত আলো এখন ফাঁকা ক্লাসরুমে।
হাল্কা মেঘের ম্লান আলোয় বিশ্রী অশুভ আত্মার মতো ঢুকছে আর বেরিয়ে যাচ্ছে। সে বাড়িতে
কখনও বর্ষার সময় দুটো তিনটেও চলে আসতো ঘরে। গ্রামের ভেতর আমাদের শহর থেকে আসা একতলা
ঘরে ঘরে মৃত্যুর দূত মনে হতো। এখন এই দিকেই দেখছে মথটা। কালো ডানা ঝাপটে কখনও আরো সরে
আসছে কাছে। আলোর থেকে দূরে দেয়ালে আরো একটা কালচে মথ। বিকট ছায়া। গা শিরশির করছে।
স্ক্রীনে শাহরুখ দূর থেকে দুরান্তে
পাহাড়ের সারি পাইন আর বার্চ, গান, হলুদ জামা আর লাল স্কার্ট কাজল। অন্ধকারে শিরশির
করে উঠেছিল গা যখন খরখরে লোমশ হাত সালোয়ারের ভেতর। চমকে উঠে দেখি চোখ দুটো জ্বলছে,
নিকষ। সিনেমা হল পূর্ণ হয়ে আছে মৃত জনতার ভিড়ে। ফরফর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে
ফাঁকা পলিথিন। আর স্ক্রীনের ওপর একটা কালো পতঙ্গ ডানা খোলা উড়ছে।
তার অনেকবছর পরে প্রতি রাতে আলো নিভে গেলে বিছানা ঘিরে ঘিরে মথ আসতো। রোজ রাতে মথটা খরখরে গায়ে…। জলজ পোকার মতো গুটিয়ে গর্তে সেই সময়টুকু। জলঢোড়া সাপের মতো নির্বিষ ফোঁস করতে আর আতঙ্কে নীল হতে হতে বয়সকালে জবুথবু। এখন আলো পড়ে আসছে। নীরবতা ভালো লাগে। ফরফর শব্দটা বন্ধ। ডানা ভাঙা পড়ে আছে খাটের নিচে। ভালো হয়েছে। গিলে নিয়েছে টিকটিকি। দেয়ালের ছবির পেছনে বাসা এখন। স্বপ্নেরা ফিরে আসছে। ধূসর। ময়লা দিনের আগের সব বৃষ্টির দিন। বাবার সঙ্গে কাগজের নৌকো। রঙ্গন ফুল থেকে শুষে নিচ্ছি মধু। প্রজাপতি, আমি, ফড়িং সবাই। যেন পথের পাঁচালির ক্যালিডোস্কোপ। কাটাকুটির জীবনটা বাস্তব, নাকি এই যে ঘরের ভেতর অঙ্কর খাতায় আছড়ে পড়ছে মথ। আর আলো কমে আসা সমানুপাতিক। এখন সারাদিন বিছানায় ঘুম আর ঘুমের দিন।
কালচে বড়ো মথটা এই ঘরে। কাজের বৌ ডাকছে। মথটা খাটের ওপর জবুথবু। ঠেলে দিলে নড়ছে উড়ছে আবার এসে বসছে। দেওয়ালে ঠোকর খেয়ে জানলা দিয়ে বাইরে গিয়ে তারপর ফের ঢুকে আসছে ওই বদ্ধ ঘরের ভেতর।
দরজা খোলার আওয়াজ হচ্ছে। ওরা ফিরল।
অভ্যস্ত হাত সুইচ জ্বেলে দিচ্ছে একের পর এক। আলো জ্বলে উঠছে হলদে ওঘর এবং এঘরের নিয়ন।
আর ম্লান বারান্দার আলো ঘিরে শ্যামা পোকারা ফিরে এসেছে।
মল্লিকা চিৎকার করে উঠছে। রান্নাঘরময়
এঁটো থালা। বাসি গন্ধ। এই সংসারে চল্লিশ বছর ফরফর ফরফর এই দেওয়াল থেকে ওই দেওয়ালে
সংঘাত।
আজ সন্ধ্যেটা অন্য রকম এই বাড়িতে। দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে মঞ্চ পাল্টে যাচ্ছে। মল্লিকা খোকাকে বলছে দ্যাখো দ্যাখো, মা মথ হয়ে গেছে। দ্যাখো বিরাট বড়ো একটা মথ হয়ে গেছে মা। আমি ডানাটা ঝাপটে একবার ওড়ার চেষ্টা করছি। মুখটা মুছে নিচ্ছি শুঁড় দিয়ে। আবার মুখ থুবড়ে এখানে ওখানে। বিছানা থেকে নিচে, আবার জানলার গ্রীল।
খাটে বসে আছে যেন কম্বল মুড়ি দেয়া
বুড়ি। উল্টো দিকের আয়নায় দেখা যাচ্ছে মথটার বিরাট অবয়ব।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন