কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / নবম সংখ্যা / ১৩৬

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

স্বর্গ এসেছে নেমে

 


(৬)    

এবার খামটি খুললেন অনঙ্গবাবু। কলেজ প্রিন্সিপালের আমন্ত্রণপত্র। কৌতূহল ছিল বৈকি! চিঠিটি খুলতেই দেখলেন  যা ভেবেছিলেন তাই, আগামীকাল রবিবার কলেজ হলে একটি মিটিং ডাকা হয়েছে। বিষয়, অধ্যাপক রণজয়কে কেন্দ্র  করে যে ঘটনাটি ঘটে  গেছে তারই বিষয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্তগ্রহণ। বুঝলেন অনঙ্গবাবু, তার আশ্রিত কোন ছেলের গায়ে হাত পড়লে যে তিনিও হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবেন না সে কথাটি বেশ ভালই বুঝেছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজ পরিচালন কমিটিতে যেমন আছেন অনঙ্গবাবু তেমনি রয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, বলা বাহুল্য তিনি শাসক দলের প্রতিনিধি। ঘটনাটির সংঘটক কলেজ সংসদের প্রেসিডেন্ট, যে কিনা ওই  প্রতিনিধি  দাদারই মদতপুষ্ট, তাকে ডাকা হয়েছে সভাতে। থাকবেন অধ্যাপক রণজয়, যাঁকে নিয়ে ঘটনাটির সূত্রপাত। সেখানে তো  বৈশ্বানরেরও থাকার কথা। ঘটনার কেন্দ্রে অধ্যাপক রনজয় থাকতে পারেন কিন্তু তাঁর পক্ষ নিয়ে কথা বলার কারণে নির্মম অত্যাচারের বলি হতে হল যাকে সভাতে তার  থাকাটাও যে একান্ত প্রয়োজন সে কথা কি খেয়াল রাখেননি কলেজ কর্তৃপক্ষ, নাকি এই বেখেয়াল ইচ্ছাকৃত? বৈশ্বানরকে সাথে নিয়ে  যাওয়াটাই উচিৎ বলে মনে করলেন অনঙ্গবাবু। আমন্ত্রিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কারও সভায় উপস্থিতি নিয়মবহির্ভূত, জানেন অনঙ্গ সান্যাল কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে কন্যাকে সঙ্গে নেওয়াটাও ঠিক বলে মনে হল তাঁর। নির্ধারিত দিনে অসুস্থ বৈশ্বানর ও কন্যা মনস্বিনীকে নিয়ে যথাসময়েই তিনি উপস্থিত হলেন সভাতে। তাঁর প্রতিপত্তি ও ব্যক্তিত্ব  স্বভাবতঃই সকলের  সমীহ আদায় করে থাকে। এখানেও তার অন্যথা হল না। যখন যে দল ক্ষমতায় আসে তার পেছনে তাঁর একটি বিশেষ অবদান থাকে এবং সেটা আর্থিক। তিনি কোন দলেরই কট্টর সমর্থক নন। ব্যবসার ক্ষেত্রেও তিনি যথাসম্ভব স্বচ্ছতা বজায় রাখার চেষ্টা করেন। আর দশজন ব্যবসায়ী যখন ক্ষমতাসীনদের ভয়ে কাঁটা, অনঙ্গ সান্যাল তখন অকুতোভয়। একে একে সকলের সাথেই সৌজন্য বিনিময় হল। কমিটি সদস্য তথা রুদ্রাক্ষ সরকারের পৃষ্ঠপোষক ওই দাদা আবার একটু বেশী মাত্রায় ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করলেন অনঙ্গ সান্যালের। এর দুটি উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে মনে করলেন অনঙ্গবাবু। প্রথমতঃ রুদ্রাক্ষকে যেন বেকসুর খালাস দেওয়া হয় এবং দ্বিতীয়ত আসন্ন নির্বাচনেও যেন তিনি আগের মতই উদার হস্তে পার্টিকে অনুদান প্রদান করেন।

শুরু হল সভা। শুরুতেই প্রিন্সিপ্যাল সকলকে নিরপেক্ষ মতামত দেবার  অনুরোধ জানিয়ে রাখলেন। সভার পক্ষ থেকে অধ্যাপক রণজয়কেই ঘটনাটির সম্যক বিবরণ দিতে বলা হল, কারণ ঘটনা আবর্তিত হয়েছে তাঁকে কেন্দ্র করেই। রণজয় শুরু করলেন পরীক্ষা হলে কতিপয় ছাত্রের দুর্বিনীত আচরণের উল্লেখ করে। কীভাবে তারা উত্তক্ত করছিল বৈশ্বানরকে তাদের উত্তর বলে দেবার জন্য।  বৈশ্বানর ইনভিজিলেটর অধ্যাপক রণজয়কে এ ব্যাপারে রিপোর্ট করলে কী ভাষায় বৈশ্বানর ও রণজয়কে ধমকি দেওয়া হয় ‘দেখে নেবো’ বলে এসব কথা অকপটে বললেন রণজয়। রুদ্রাক্ষ সরকার, কলেজ-সংসদ সভাপতি, মুখ নীচু করে বসেছিল। মাথামোটা হলে কী হবে, এটুকু বোঝার ক্ষমতা তার আছে যে, এমন এক ঘটনা ঘটিয়েছ সে যার সমর্থনে ক্ষমতাবান তার দাদাটিরও একটি কথা বলার যো নেই।  প্রতিপক্ষ যখন অনঙ্গ সান্যালের মত একজন ব্যক্তিত্ব তখন দোষ ঢাকা দেবারও উপায় নেই, বিশেষ করে প্রত্যক্ষদর্শী যখন তারই কন্যা মনস্বিনী। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য সুযোগ দেওয়া হল রুদ্রাক্ষকে। রুদ্রাক্ষ নিরুত্তর। অতঃপর এমন ঘটনা যেন ভবিষ্যতে না ঘটে এমন একটি মুচলেখায় স্বাক্ষর করতে বাধ্য হল রুদ্রাক্ষ। এতক্ষণ সজাগ দৃষ্টি রেখে চলেছিল মনস্বিনী রুদ্রাক্ষর উপর। স্বাক্ষর  শেষে রুদ্রাক্ষের চোখে জ্বলে ওঠা প্রতিশোধের আগুন চোখ এড়ালো না তার। তৎক্ষণাৎ একটি অশুভ আশঙ্কায় আক্রান্ত হয়ে গেল তার মন। যাদের মধ্যে যুক্তিবুদ্ধির লেশ মাত্র নেই, যারা পরিচালিত হয় অন্য কারও অঙ্গুলি নির্দেশে তাদের কাছে মুচলেখা একটি অর্থহীন কাগজমাত্র। ব্যাপারটি সম্ভবতঃ অনঙ্গবাবুর অভিজ্ঞ চোখেও ধরা পড়ে গেছে। এই কারণেই তিনি বলে গেলেন, ‘ভেবেছিলাম এই ঘটনার পর কিছু পরিবর্তন আসবে কলেজ পরিবেশে, আপনাদের এই প্রচেষ্টার মূল্য দেবে অপরাধীরা কিন্তু আমি এক আশঙ্কা নিয়ে ফিরে যাচ্ছি, আর বলে যাচ্ছি, এরপর কিছু ঘটলে কিন্তু আমাকে সেইমত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে’। প্রিন্সিপ্যাল দায়িত্ব নিয়ে আশ্বাস দিলেন অনঙ্গবাবুকে, কোনক্রমেই তিনি এমনতর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে দেবেন না।

ঘরে ফিরছে ওরা তিনজন। প্রসঙ্গবিহীন একটি প্রশ্ন করে বসল বৈশ্বানর অনঙ্গবাবুকে, ‘কাকু, মাকে একবার দেখে এলে হয় না’? অনঙ্গবাবু যেন এমনটিই আশা করছিলেন। যে ধকল গেল ছেলেটার ওপর দিয়ে! মাকে দেখার ইচ্ছা জাগা তো খুব স্বাভাবিক ওর পক্ষে। তিনি আশ্বস্ত করলেন বৈশ্বানরকে, বললেন, তিনিই সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন তাকে, তবে মাকে এই ঘটনার কথা বলা যাবে না একেবারেই। বৈশ্বানর নিজেই জানত, এসব কথা গোপন রাখতে হবে, না হলে মা নিশ্চিত বলে বসবেন, ছেলের লেখাপড়ার দরকার নেই আর, জমিতে লাঙল চালিয়ে চাষবাস করে কোনমতে বেঁচে থাকলেই হবে, মরণের ঝুঁকি তো থাকবে না।

নদীতে মাছ ধরার কথা মনে আসতেই অতীতে হারিয়ে গেল মনটা। বৈশ্বানরের বাবারও তো এভাবে দিন গুজরান হত। কৃষক হলে কী হবে নিজের তো জমি নেই। পরের জমিতে চাষ। কিই বা মজুরি। ওদিয়ে তিনটে মানুষের পেট ভরানো! ঘরে চাল যেটুকু আছে তাতে একবেলা কোনক্রমে চালিয়ে নেওয়া যাবে। পয়সাও নেই যে বাজার থেকে ডাল সব্জি কিনে আনবে। ছেলে বৌ অভুক্ত, অতঃপর কি আর করে বেচারা। বর্ষায় থইথই করছে জলঢাকা। আর কিছু না হোক, কিছু কাজলি, ভ্যাদা আর বৈরালি হলে তো কথাই নেই, ধরা পড়লেও বাজারে বিক্রি করে যে পয়সা আসবে তাতে চাল না হোক মুড়ি বা চিড়ে কিছু একটা হয়ে যাবে তিনজনের। এই ভেবেই ঘোর বর্ষার মধ্যেও চলে গিয়েছিল নদীতে। শোনেনি বিশুর মায়ের বারণও। সময় পেরিয়ে যায়। ফিরছে না কেন মানুষটা? অমঙ্গলের কথা মাথায় আসে আবার এ যুক্তিটাও ফেলে দেবার মত নয়, হয়তো মাছধরা শেষ হয়ে গেলে কোন প্রতিবেশীর ঘরে বসে গল্পগাছা করছে। বৃষ্টি ধরেছে একটু। খবর নিতে বাইরে  যেতেই দেখে সেই বুকফাটা দৃশ্য। দু’তিনজন প্রতিবেশী জেলে যারা কিছু দূরেই মাছ ধরায় ব্যস্ত ছিল, ছুটে গিয়েছিল চীৎকার শুনে। তারাই কোলপাঁজা করে বিশুর বাবাকে নিয়ে বাড়ির দিকে আসছে। এর মধ্যেই নীল হতে লেগেছে শরীর। সন্দেহ নেই, বিষধর সাপ কামড়েছে বিশুর বাপকে। কেউ ছুটল ওঝা ডাকতে, কেউ বলল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা। সময় বয়ে যায়। ফেনা ঊঠছে মুখ দিয়ে। বিশুর মা জনে জনে ভিক্ষে করার মত অনুরোধ করে বিশুর বাপটাকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য। ওঝার খোঁজে  গিয়েছিল যে সে ফিরে এল নিরাশ হয়ে। ওঝা অন্য গ্রামে গেছে কারও ডাকে, কখন ফিরবে তার ঠিকানা নেই। গ্রামগঞ্জে সাপ কামড়ালেই সর্বপ্রথম যার কথা মনে আসে সে হল ওঝা। কে বোঝাবে ওই নিরক্ষর নিঃসম্বল মানুষগুলোকে, ওঝার মন্ত্র আর শিকড়বাকর সব বুজরুকী। কিন্তু যুগ যুগ ধরে সেই একই বিশ্বাসের দাস গ্রামের এই মানুষগুলো। এর মূলে রয়েছে সম্ভবতঃ দুটি কারণ, এক, কুসংস্কার, দুই, আর্থিক অনটন। অনেকটা সময় কেটে গেল ওঝার প্রতীক্ষায়  থেকে। অতঃপর কয়েকজন ধরাধরি করে সেই মাইল দুয়েক দূরে গ্রামের হাসপাতালে গিয়ে হাজির হল বিশুর বাবাকে নিয়ে। জানা গেল, ডাক্তার নেই হাসপাতালে, মজুদ নেই সাপে কামড়ের ওষুধও। হাসপাতাল আছে কিন্তু ডাক্তার বা ওষুধ নেই, এটা কোন বিস্ময়ের ব্যাপার নয় গ্রামের মানুষের কাছে। বছরের বেশীর ভাগ সময় কম্পাউন্ডারই ডাক্তারের  প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে থাকেন। এনিয়ে আলোচনা হয় কিন্তু কোন প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে ওঠেনি কখনো। এক্ষেত্রেও তাই হল। কমপাউন্ডারও ছিলেন না হাসপাতালে। পাশের কোয়ার্টার থেকে ডেকে আনা হল তাকে। নাড়ী পরীক্ষা করে মাথা নেড়ে তিনি জানালেন, বিশুর বাবার মৃত্যু হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। মন উজার করে কেঁদেছিল বিশুর মা। তার বিলাপ শুনে পড়শিরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল, বিষহরিদেবীর পূজায় নির্ঘাত কোন বিঘ্ন ঘটেছিল সেই কারণেই সর্পদংশনে প্রাণ হারাতে হলো বিশুর বাপকে। বিশু দেখল তার চোখের সামনে দিয়ে তার বাবার মৃতদেহ মাচায় বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে শ্মশানের দিকে।

বিশুর বাবা দরিদ্র হলে কী হবে ছেলেকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন দেখতো সে। কারণ তো ছিলই তার পেছনে একটা। বিশুর জন্মের পর প্রথা ভেঙ্গে গ্রামের এক ব্রাহ্মণ জ্যোতিষঠাকুরকে ডেকে এনে ছেলের নামকরণ করালো সে। জ্যোতিষঠাকুর তো ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই বলে উঠলেন, ‘এ তোর ঘরে কে এলো রে বিজয়! এ ছেলে বেঁচে থাকলে তো একটা আগুনের ফুলকি হয়ে উঠবে রে! আমি ওর নাম রাখলাম বৈশ্বানর’। ‘বৈ শা ন র! এ আবার কেমন নাম গো ঠকুরমশায়? বাপের জম্মে শুনি নাই’। জ্যোতিষঠাকুর বুঝিয়ে বললেন ওই নামের অর্থটি এবং বলে গেলেন, আমার আন্দাজ যদি মিথ্যে না হয় তবে দেখবি এই ছেলের জন্য একদিন তোর পরিবার আর সমাজ গৌরববোধ করবে। জ্যোতিষঠাকুরের কথাগুলো পুরোপুরি বুঝল না বিশুর বাবা তবে এটুকু বুঝল যে বিশুকে ইস্কুলে পাঠাতে হবে, পড়ালিখা করাতে হবে। কাজ নেই গ্রামে। বিশুর বাবা কিন্তু বেপরোয়া। ছেলেকে একটু ভাল খাওয়ানো পরানোর জন্য এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে কিছু না কিছু কাজ জোগাড় করে নিতই সে। বিশু ছয় বছরের হতেই গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দিল বিজয়। স্কুল থেকে ফেরার সময় হেডমাস্টারমশায়ের পা জড়িয়ে ধরে বলে এল সে জ্যোতিষঠাকুরের ভবিষ্যদ্বাণীর কথা। হেডমাস্টারমশাই আশ্বাস দিয়ে বললেন, তিনি বিশেষ যত্ন নেবেন বিশুর।

একটি শীর্ণ গাছও ঊপযুক্ত জল হাওয়া রোদ পেলে বেড়ে ওঠে তড়তড় করে। বৈশ্বানরের ক্ষেত্রেও হল তাই। হেডমাস্টার মশায়ের তত্ত্বাবধানে একের পর এক ক্লাস পেরিয়ে সে পৌঁছে গেল প্রাথমিক স্কুলের শেষ ক্লাসটিতে। আশ্চর্য হয়ে দেখল প্রতিবেশীরা কি করে যেন সত্য হয়ে যাচ্ছে জ্যোতিষঠাকুরের কথা। প্রতিটি পরীক্ষায় প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হয়নি বৈশ্বানর। স্কুলের খেলাধুলাতেও সেই একনম্বরেই সে। কি যেন আছে ছেলেটির চোখে। দেখলেই মায়া হয় বড়। হেড মাস্টারমশাই ছুটির পর একদিন বৈশ্বানরকে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। তিনি নিঃসন্তান। তাঁর স্ত্রী তো বৈশ্বানরকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন। দুধমুড়ি খাওয়ালেন তারপর কথা আদায় করে ছাড়লেন, মাঝে মাঝেই সে তার কাছে চলে আসবে ছুটির পর। ছেলের মুখে সব কথা শুনে মা বাবা তো আনন্দে আটখানা। যেদিন হেডমাস্টারমশাই বললেন, তিনিই ম্যাট্রিক পর্যন্ত ওর পড়াশোনার ভার নেবেন সেদিন চোখ থেকে আনন্দাশ্রু যেন বাঁধ মানে না দুজনের চোখে। কিন্তু ঐ যে, ভাগ্যদেবতা! তিনি সম্ভবতঃ অন্যমনস্ক ছিলেন বৈশ্বানরের ভাগ্যকথা লেখার সময়। হয় তো তিনি লিখে ফেলেছিলেন, ওইটুকু বয়সেই পিতৃহারা হতে হবে তাকে। স্বামীকে হারিয়ে দিশাহারা বৈশ্বানরের মা। কানে বাজে জ্যোতিষঠাকুরের কথাগুলো, মানে বিশুর বাবার ইচ্ছার কথা। ভেঙ্গে পড়লে তো চলবে না। পড়াশোনার ভারটা নিয়ে নিয়েছেন হেডমাস্টারমশাই, কিন্ত খাওয়াপরা! শহরে লোকের বাড়ি কাজ খুঁজে বহাল হল দুটি বাড়িতে। সে এক অদম্য লড়াই। বিশুকে প্রতিদিন নিয়ে যান হেডমাস্টারমশাই নিজের ঘরে। সেখানেই টিফিন খেয়ে, পড়ে, ঘরে ফেরে যখন তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। কেরোসিন কেনার পয়সা কোথায়, প্রদীপের টিমটিমে আলোতেই বিশুর পড়া, মায়ের ভাত ফোটানো সব। স্বপ্ন দেখে বিশুর মা, বিশু লেখাপড়া করে একদিন অনেক বড় চাকরী পাবে, তখন আর এ দুঃখ থাকবে না ওদের জীবনে। সে স্বপ্ন বিশুর মায়ের সকল লড়াইকে সহজ করে দেয়।

এমন করেই কেটে যায় কয়েকটি বছর। হেডমাস্টারমশাই মনের মত একটি ছাত্র পেয়ে নিজের মত করে গড়ে তুলেছেন তাকে। তাঁর বিশ্বাস এতদিনে তাঁর স্কুল এই ছাত্রের কৃতিত্বে রাজ্য না হলেও জেলার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি আদায় করে ছাড়বে। মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ। স্কুলের সকলেই আশাবাদী বৈশ্বানরকে নিয়ে। রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল, হেডমাস্টারমশাই এবং শিক্ষকদের আশা অমূলক ছিল না। জেলার মধ্যে প্রথম  স্থানে রয়েছে বৈশ্বানর আর সেই সুবাদে প্রত্যন্ত গ্রামের এই অজানা স্কুলটি রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে গেল। একে তাঁর নিজের গ্রামের স্কুল তায় আবার সে স্কুল যেখানে তিনি  পড়েছিলেন নবম শ্রেণী পর্যন্ত; আনন্দে আত্মহারা অনঙ্গ সান্যাল তড়িঘড়ি পৌঁছে গেলেন তার সাক্ষাৎ  লাভ করতে যে তাঁর গ্রাম, তাঁর গ্রামের স্কুলকে এক অকল্পনীয় মর্যাদায় উন্নীত করে দিয়েছে।

(ক্রমশ)

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন