কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

তুষ্টি ভট্টাচার্য

পাহাড় দেবতা 




                                                         
পাহাড়ে কাছে যাওয়া হয় না আর। পাহাড়ের কাছে আসলে যেতে হয় না। পাহাড়  আমার কাছেই থাকে। বরং বলা ভালো, পাহাড়ের মধ্যে আমি থাকি। আর দিনরাত যখনই ইচ্ছে হয় পাহাড়ের গা বেয়ে চড়তে থাকি। এই চড়ার ব্যাপারটা এত সহজ না অবশ্য। অনেক গাঁইতির কোপ পড়ে পাহাড়ের বুকে, অনেক দড়ি আর মইয়ের কেরামতি থাকে সাথে। আর থাকে সেই অশেষ ভরসা, গাইড আর লিডার। যার কথা শুনতে হয়, শুনতেই হয়। শুনতে কি মন চায় সব সময়ে? শুনি না মাঝেমাঝে। আর তাই আমি প্রায়ই ছন্দা গায়েন হয়ে যাই। আবার যদিও বেঁচে উঠি, আবার নিষেধ শুনব না, জানিছন্দা গায়েনও মরে না। থেকে যায় আমার বুকের খাঁচা ধরে ঝুলে। খাঁচার ভেতরে ঢুকে মাঝেমাঝে ও খোঁড়াখুঁড়ি করে। আমি নিষেধ করি ওকে, বলি খাঁচা তোমার জন্য নয়। তুমি তো আকাশের বুকে ভেসে যাওয়া পাহাড়ি পাখি এক। ভুল করে জন্মেছিলে এই বাংলার বুকে। যেমন আবার ভুল করে ঢুকে পড়েছ আমার বুকের খাঁচায়।

বেশির ভাগ সময়েই ছন্দার সাথে আমার কথাবার্তা হয় না। আমি শুধু কান পেতে শুনে যাই ওর গাইঁতি চালানোর শব্দ। ওর হেঁটে যাওয়া জুতোর শব্দ। মাঝে মাঝে ভাবি, আলাপ করি ওর সাথে। কিন্তু সংকোচে মুখ ফুটে কিছু বলা হয় না। তাছাড়া ওর মগ্নতা ভাঙাতেও ইচ্ছে করে না। ওর দিকে তাকালেই বুঝি, মাথা উঁচু করে পাহাড়ের চূড়ার দিকে ও তাকিয়ে আছে, কখনও বা খুব সন্তর্পণে পা মেপে মেপে  এগোচ্ছে ক্রিভাস বাঁচিয়ে। একটু এদিক ওদিক পা ফেললেই... ওকে কখনও বিরক্ত করতে আছে! তাই আমি কথা বলি না ওর সাথে। ওর এগিয়ে চলা দেখতে দেখতে ভাবি, ওর জীবনে কি শুধু এগোনই আছে? পিছিয়ে যেতে কি শেখে নি? জানি না আমার এমন অলুক্ষণে ভাবনার জন্যই কিনা, কদিন পরেই দেখি, ওর মুখে মেঘ।  ওর চোখে জল। চরম হতাশায় ও চিৎকার করছে। গাইড ওকে এগিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় নি। চূড়ায় ওঠা হয় নি ছন্দার। সেদিনই প্রথম ও আমার সাথে নিজে থেকে কথা বলল। আর মনে হলো, আমাদের যেন অনেকদিনের চেনাজানাএই  কথার  শুরুও অনেক আগেই হয়ে গেছে। শুধু শব্দ আর ধ্বনি বেজে ওঠে নি একসাথে এই যা। আমার বুকের ভেতরে ফিসিফিস করে ও বলল, ‘দেখ, আমি আবার আসব এখানে। আর তখন পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে আসব, তোমায় কথা দিলাম ছন্দা!’ হ্যাঁ, আমার নামও ছন্দা। আমাদের দুই ছন্দার হাতে হাত মিলে শপথ করার  সময়ে আরও একজন সাক্ষী ছিল সেই দৃশ্যের। সেটা পরে জেনেছি অবশ্য


তো, আমি এক ছন্দা, যে কিনা ঘোর সংসারী, টুরিস্টের মতো পাহাড়ে যাই, মলে  গিয়ে উলেন কেনাকাটা করি, পাহাড়ি টুপি পরে বাড়ি ফিরি। পাহাড়ে গিয়ে আমি বৌদির হোটেল খুঁজি। ভাত পাওয়া যায় কিনা, পোস্ত আর মাছ... আমার ব্যাগে ভরা থাকে পেট খারাপের আর গ্যাস-অম্বলের বিস্তর ওষুধ। আমার মদ খাওয়া বেড়ে যায় পাহাড়ে গেলে। আমার খিদে বেড়ে যায় পাহাড়ে গেলে। আর, আর খুব শীত করে। শীতে হি হি করতে করতে আমি ভাবি, ওই যে ওরা ট্রেকিঙে চলেছে ওদের কী ভূতে তাড়া করেছে! সারা রাস্তায় কি খাবে ওরা, তাঁবুর ভেতরে শোয় নাকি কেউ! আর যদি পড়ে যায় খাদে? আহা বাছারা, কাজ নেই, তোমাদেরও তো পরিবার আছে।  যাও না কেন, একটুখানি ঘুরে ফিরে, এই আমাদের মতো বাড়ি ফিরে যাও সোজা।  এই এক ছন্দার বাইরে যে ছন্দা আছে, সে কিন্তু ততক্ষণে রেডি হয়ে গেছে জুতোর লেস বেঁধে। সারিবদ্ধ ভাবে বরফের বুক চিরে ধীরে ধীরে এগোতে দেখা যাচ্ছে যাদের, তাদের মধ্যেই এই ছন্দা রয়েছে। তার কোনো পরিবার নেই, সন্তান নেই, পিছুটান  নেই, মৃত্যু ভয় নেই, শীত নেই। তার চোখে আছে শুধু পাহাড়ে যাওয়ার, পাহাড়ের বুকে পা ফেলে ফেলে ঘুরে বেড়াবার নেশা। সে নেশার রঙ লাল নয়, সে নেশার রঙ বরফের মতো সাদা। এই ছন্দার কোনো চূড়া জয়ের নেশা নেই, সে শুধু পাহাড়ের  রূপ দেখেই বিভোর হতে জানে। জানে, মৃত্যুর খুব কাছে থাকে ঈশ্বর। মৃত্যুকে এড়িয়ে যেতে পারলে ধরা দেয় এই পাহাড়-দেবতা।

আর যে ছন্দা গায়েন, তার নেশাও পাহাড়। তার নেশা জয়ের। সে অনন্ত নেশায় পাহাড়ে যায় বারবার, আর বারবার পাহাড় জয় করে আসে। চূড়ায় পুঁতে দিয়ে আসে নিজের পতাকা। এমন ভাব তার, যেন এই পাহাড় শুধু তারই জন্য, এই পাহাড় সব সময়ে থাকবে তার পায়ের নিচে। পাহাড়ের মাথায় নৃত্য না করলে যেন তার ঘুম  হবে না। তুষার ঝড়, বরফের ধ্বস বা কোনো ক্রিভার্স তার পথ আটকাতে যায় নি  কি? গেছে, গেছে, অনেকবারই গেছে। এদের সঙ্গে তার নিত্য রেষারেষি। একবার ছন্দা গায়েন হারে, তো একবার ওরা। মৃত্যুর ভয় লাগে না তোমার, ছন্দা? সে ভয় থাকলে বোধহয় কেউ পাহাড়ে যায় না। সে ছন্দা গায়েনই হোক, কি এই আমি-ছন্দাই হোক বা ইন্দ্রনীল। ইন্দ্রনীল চাপা পড়েছিল তুষারের নিচে দুদিন। তার সাদা হয়ে যাওয়া ‘বডি’র সামনে ওই আমি যাই নি, যেতে পারি নি। কী সুন্দর পালিয়ে পালিয়ে  বেঁচে গেছি ইন্দ্রনীলের থেকে, ওর বৌ-মেয়ের থেকে। পালিয়েছি বলেই বেঁচে আছি এখনও দিব্যি বহাল তবিয়তে। আর নিষ্ফল কান্নার সামনাসামনি হয়ে, স্রেফ ভেঙে নুয়ে পড়বে না বলে, সেই কান্নাকে মুছে দিতে লড়াই করেছে ইন্দ্রনীলের স্ত্রী, কন্যা।  ইন্দ্রনীল ছিল সামান্য মানুষ, অতি সাধারণ এক মধ্যবিত্ত ঘর সংসার ছেড়ে হামেশাই  ছুটে যেত পাহাড়েশ্বাসকষ্ট বুকে নিয়েও। আর বিখ্যাত পর্বতারোহী ছন্দা গায়েন তার অদম্য জেদ নিয়ে পাহাড় জয়ের নেশায় ছুটে যেত পাহাড়ে। এই দুই ছুটে যাওয়ার মধ্যে তফাৎ কিছু নেই আসলে। ছন্দা গায়েনকেও পাহাড় টেনে নিয়েছে তার বুকে। তাহলে কি পাহাড় এভাবেই তাদের কাছের মানুষদের কাছে টেনে নেয়? আমাদের থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায় আমাদেরই প্রিয়জনকে তার নিজের কাছে?

এখন আসি সেই সাক্ষীর কথায়। আমার আর ছন্দা গায়েনের হাতে হাত রেখে যে প্রতিজ্ঞা ছিল, সেই প্রতিজ্ঞা দেখে নিয়েছিল এক অদৃশ্য পাহাড়ের ছায়া। আমরা দুজনেই শুনেছিলাম তার অট্টহাসি। সেই হাড় কাঁপানো হাসি শুনে আমাদের জেদ আরও বেড়ে গেছিল। আমরা শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম আমাদের হাত। আমাদের হাতের তালু ঘামছিল, তবুও আমরা ছাড়িনি আমাদের সংকল্প। ছন্দা গায়েন আদৌ হারায় নি পাহাড়ের কোলে। আমি তো দিব্যি বহাল তবিয়তে আছি। ছন্দা গায়েনের অনেক অনেক ছায়া, যেন পাহাড়ের ছায়াকেই ব্যঙ্গ করে চলেছে সমানে। এ হলো রক্ত  বীজের ঝাড়। মরলেও মরে না। জন্মাতেই থাকে। এভাবেই আমি আর ছন্দা গায়েন এবং ছন্দা গায়েনের ছায়ারা বারবার চূড়ায় পৌঁছে যাই। পতাকা পুঁতে দিয়ে আসি। আমাদের পতাকায় ভরে গেছে পাহাড়ের মাথা। আমরাই জয়ী হয়ে চলেছি। পাহাড় অবশ্য নির্বিকার, তার অত হেলদোল নেই। এক বিশ্বব্যপী অহংকার নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার কুটিল ছায়া এখনও হেসে চলেছে হা হা করে। 






(ছন্দা গায়েনকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি না। তবুও চিনে ফেলেছি ছন্দা গায়েন এবং তাঁমতো আরও অনেককে। যে পর্বতারোহীদের আমরা দেখি পাহাড়ের চূড়ায়  পৌঁছে গেছে, অথবা না পৌঁছতে পেরে ফিরে এসেও, আবার যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন, তাঁদের জন্য আমার মনের ভেতরে একটা ঘর রাখা আছে। আর তাঁদের  জন্যও আরও একটা ঘর আছে, যারা কোনো জয়ের নেশায় নয়, শুধুমাত্র পাহাড়ে  ঘোরার টানে বারবার দুর্গম পাহাড়ের বুকে কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঘুরে আসেকেউ ফে্রেন, কেউ ফেরে না। এমন ভাবেই একদিন আমার বন্ধু ইন্দ্রনীল ঘোষ  আর ফেরে নি। ঠিক যে সময়ে ছন্দা হারিয়ে গেলেন, সেই সময়েইবন্ধু হারানোর  ব্যথা যেমন থেকে যায়, তার পরিবারের একাকীত্ব তেমনি আমাকে কষ্ট দেয়। ছন্দা  গায়েনের জীবনী লেখা হয় বা হতেই পারে, তাঁকে নিয়ে আরও অনেক প্রামাণ্য তথ্য  থেকে যায় ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু ইন্দ্রনীলদের কোনো ইতিহাস থাকে না। এই ইন্দ্রনীলরা কিছুদিন অন্তত বাঁচুক আমাদের বুকে। ছন্দা গায়েন এবং ইন্দ্রনীলের উদ্দেশ্যে এই লেখা নিবেদন করলাম।)   
  

       

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন