কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ

ধারাবাহিক উপন্যাস 



যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে 




                            

(৪)
বেড়ালটা একটা লাফ মেরেছিল। সুনীলের ছবি আঁকা শেষ হতেই। একটা বাঘের মতো  লাফ মেরে উড়ে এসেছিল সামনের দিকে। হাতের বর্শাটা তাক করে ছুঁড়েছিল অশোক। বাঘটার বুকের ঠিক মাঝে গেঁথেছিল। তাও তার ভারী শরীর আছড়ে পড়েই স্প্রিং-এর   মতো খাড়া হতে চাইছিল। হু হু বাতাসের মতো ছুটে গিয়ে তরোয়ালটা চালালো  অশোক। ভারী তরোয়াল, বাতাসের মধ্যে দিয়ে একবার ধাক্কা খেল, অশোকের কাঁধের পেশীতে একটা প্রতিক্রিয়া লাগলো এসে। কাঁধ বেয়ে সেটাকে কোমরের মোচড়ের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে পিঠের ঋজুতা নিয়ে মাথা সোজা করে ফিরে দাঁড়ালো অশোক। বাঘটার মাথাটা ধড় থেকে আলাদা হয়ে ছিটকে গিয়েছে। ধড়টা কাঁপছে। এমন সময় এই মহাশক্তিমান ও একটি মুরগীর মধ্যে কোনো ফারাক নেই। মৃত্যুর পরে কিছু বিদ্যুৎ সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এভাবে খেলে যায় এবং তারপরে স্তব্ধতা একটি চাদরে ঢেকে দেয় অনন্ত খেলার সম্ভাবনাসমূহ। বিদ্যুৎ মরে গেলে জল আবার, মেঘ আবার, বৃষ্টি আবার, একটি জন্ম এবং বৈদ্যুতিক প্রকাশ।
দামাস্কাস ইস্পাতের তরোয়াল। ভেতরের অংশটার উপর আবার জ্বলন্ত আগুনে গলিয়ে এবং পিটিয়ে অন্য ইস্পাত লাগানো। গলানো টিনের আস্তরণ আছেধার একদিকে। গ্রীকদের দেখে এই তরোয়াল বানিয়েছে অশোক। বাতাসে কাটে যেন ভিজে রঙ  মাখানো ভারী তুলি। কব্জির মোচড়ে মোচড়ে যখন নাচে তখন মৃত্যুর রঙ ছেটানোর উল্লাস অশোকের মধ্যে লাফায়। গলার কাছে এসে জট পাকায়, উত্তেজনায় শিরাগুলো দিয়ে উল্লাস ছোটে, আহা মৃত্যু বাহা মৃত্যু করতে করতে অশোক নাচতে থাকে। জঙ্গলের যুবকরা যেমন নাচে। অশোক সে নাচ শিখেছে। পায়ের পদক্ষেপ বড় করে সে নাচ নাচলে হাতের সীমা প্রসারিত হয়। আরো অনেকটা বায়ুপূর্ণ স্থান হাতের নাগালে পায় অশোক। হাতের নাগাল মানে বর্শার নাগাল। মানে তরোয়ালের নাগাল। আরেকটা জীবনের নাগাল। অশোক, জীবনের এবং স্পেসের প্রভু।
এবং মাছটা, সুনীলের ছবির মাছটা আসলে যুবতী মাছ। জলে খেলছিল। শরীরে চিকণ কালো আভা। ঝরণার ঠিক নিচে যেখানে ঝরণা প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এসে  গভীরতর ক্ষত বানিয়েছে, সেইখানে। যেখানে কেউ প্রতিদিন লাফায় সেখানে একটা  ক্ষত তৈরি হয়। হবেই। একই জায়গায় এক নির্দিষ্ট ভরবেগ ক্ষতকে খুঁড়তে থাকে,  খুঁড়তে থাকে। অশোকের ভেতর আছে এমন ক্ষত। মহারাজ বিন্দুসারের ভেতরের ক্ষতটাতে অশোক প্রলেপ দিয়েছে। এবং মারতে পারেনি। কিন্তু বিন্দুসার অশোককে তার ক্ষত সারার সুযোগ দেননি। তক্ষশীলার বিদ্রোহ দমন করে অশোক রাজধানী ফিরতে চেয়েছিল, বিন্দুসার রাজী হননি। অশোককে সুসীম পছন্দ করে না। অশোক  এলে সুসীম ক্ষুব্ধ হয়। জনপদকল্যাণীর সন্তান, রাজ সন্তানদের সঙ্গে প্রতিপালিত হয়েছে, কিন্তু সিংহাসনে নজর - এ কেমন কথা!
মাছটা জলে থেকে নারী হয়ে উঠে এলে তার নগ্নতা অশোক পান করছিল। নির্লজ্জের মতো পাশের জঙ্গলে গাছের আড়াল থেকে দেখছিল একটু একটু করে নারীর শরীর  থেকে জল শুষে নিচ্ছে একটা গামছা। বেশ কারুকাজ করা গামছা। আর গামছার আড়ালে যখনই শরীরের অংশ বিশেষ লুকোচ্ছে, তখনই অশোক বাকি অংশকে পান   করছে। তৃষ্ণার্ত সে। খুব ইচ্ছে করছিল কাছে গিয়ে যুবতীর ঘাড়ের চুলটা একটু সরিয়ে নাক ডুবিয়ে দেয়। পাকস্থলী অবধি গন্ধ নেয় ওই শরীরের। গন্ধ একটা আছে। সে গন্ধ বাতাসে অশোক ছাড়াও আরেকজনের কাছে গেছিল। সে গন্ধের ফলাফলে সে লাফ দিয়েছিল নারীর দিকে অশোকের স্পর্ধায় ও ক্রোধে বিদ্ধ হতে। এমন হুলুস্থুলুর পরে অশোক গোপন থাকার পথ পায় না। প্রকাশ্য হয়ে যায়। নারী বিষ্ফারিত চোখে বাঘ, মৃত্যু ও অশোককে একসঙ্গে দেখে, একে একে দেখে এবং অবশেষে বাঘের কাছে নত হয়। ঠিক তখনই জানা যায় বাঘ না, বাঘিনী - গর্ভিণী ছিল।
- বিন্দুসারকে তো গর্ভ চিরে বের করে নিয়েছিলেন চাণক্য!
সুনীল ক্লান্ত চোখে তাকায় নিজের হাতের দিকে। আমিও তাকাই। আমার হাতেও ওই বাঘিনীর রক্ত, অজাত সন্তানের রক্ত। সুনীল মোছে না। আমি আস্তে করে একটি শাল  পাতায় মুছে নিই। কোনোদিন বৃষ্টি হলে ধুয়ে যাবে। মাটির লাল রঙের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার। আমার হাতে তাহলে কোনো রক্ত লেগে থাকবে না। সুনীলের ক্লান্ত পর্যবেক্ষণ ভারী হয়ে আসে গলায়।
- সেখানেই সমস্যা! মহারাজ চন্দ্রগুপ্তকে যে মহামন্ত্রী চাণক্য স্বল্প করে বিষ প্রতিদিন দিতেন, তা রাজপাচক এবং খাদ্যস্বাদগ্রহীতা ছাড়া কেউ-ই জানতো না। মহারাজ  আহ্লাদ করে গর্ভিণী স্ত্রী-কে দিয়েছিলেন সেই খাবার। স্ত্রী তো বিষে অভ্যস্ত নয়, তিনি  আক্রান্ত হলেন।
বিষের অভ্যস্ততা সম্পর্কে আমি কিছু জানি। বিতস্তা আমাকে বিষে অভ্যস্ত করেছে। বিতস্তার গল্পে একটি করুণ গান ছিল। বয়স্ক সঞ্জীবকুমার ছিল, তিরিশ হওয়া শর্মিলা ঠাকুর ছিল, একটা প্রাচীন রেডিও ছিল, যা সব সময় বড় আলমারির মাথায় রাখতে হতো এবং শব্দ তার গমগম করত। শর্মিলার একটা জা্নালা থেকে অন্য জানালায়  যাবার পথে লতা মঙ্গেশকর গেয়ে উঠতেন, 'রুকে রুকে সে কদম / রুক্‌কে বার বার চলে'! গানটায় আমি আটকে গেছিলাম। বলা ভালো বিতস্তার দীঘিজল চোখে  আটকে গেছিলাম। সেই এক দুঃখের গপ্প! সেই যে আঠারো শতক থেকে বাবুরা পাশ্চাত্য থেকে বুঝলেন 'মেয়েরাও মানুষ' - স্বপন সাহা সিনেমা বানানোর অনেক  আগে - তখন থেকেই মেয়েদের উপর অত্যাচার-অনাচারের গল্প খুব ভালো খায়  জানা গেল। তারপর সবাই লিখল। বাঙলা, মারাঠি, তামিল, তেলুগু, গুজরাতি কত কত ভাষায়। মেয়েদের প্রতিষ্ঠার গপ্প, আত্মপ্রত্যয় অর্জনের গপ্প, আত্মমর্যাদার লড়াই - প্রচুর লোক লিখল, প্রচুর লোক পড়লতারপরে কয়েকটা শতাব্দী চলে গেল। দুঃখের গল্পটা সত্যি এবং সত্যির ছাঁচ রেখে অনায়াসে গল্প বানানো চলে। সে গল্প বানাতে অনেকের ঈর্ষণীয় দক্ষতা বাড়ল।
যেমন বিতস্তার। তার গল্পে অত্যাচারী-ব্যাভিচারি স্বামী থেকে অবুঝ বাবা সব ছিল।  পুরুষতন্ত্রের সার্থক প্রতিনিধি। তার অনুপম সরলতা ছিল। কিচ্ছু বোঝে না সে। কিচ্ছু জানে না সে। কোনো অপরাধ তার নেই। ভায়ের মতো ছেলের সঙ্গে, ইস্কুলের বন্ধুর  সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে কেউ সংশয় প্রকাশ করতে পারে? কতবড় পাষন্ড হলে পারে! এ সব গল্পের লাইনে লাইনে সিনেমার গানটা ছিল। কিন্তু মজা হচ্ছে, গান তো শুরুই  হয় শেষ হয়ে যাবে বলে। গানটা শেষ হলে একটা রেশ থাকে। রেশ শেষ হয়ে গেলে গল্পের রূপসজ্জা খুলে পড়েব্রণগুলো, চামড়ার কাটা দাগ, ত্বকের যত্ন ও অযত্ন সব  দেখতে পাওয়া যায়। তখন জানা যায় যে, এই গল্পটায় গল্পই বেশি ছিল, সত্যির মতো দেখতে। যুধিষ্ঠিরের অর্ধসত্যের মতো ভয়ঙ্কর।
প্রশ্নটা হচ্ছে, যুধিষ্ঠিরের অর্ধসত্য কি মিথ্যার চেয়েও ভয়ঙ্কর নয়? দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে  শুধু বিশ্বাস করতেন না, ভরসা করতেন। পূর্বতন আচরণ বা আচরণের খেলা দিয়ে যুধিষ্টির এই ভরসা অর্জন করেছিল। সেই ভরসা বিশ্বাসের চেয়েও বেশি শক্তিশালী।  দ্রোণ ভাবতেই পারতেন না, কোনো অবস্থায়, যে যুধিষ্ঠির - আদর্শ যুধিষ্ঠির কখনো কোনো অবস্থাতে মিথ্যে বলতে পারে। মিথ্যে আচরণ করতে পারে। এই ভরসার মূল্য দিতে হয় মুন্ডচ্ছেদ দিয়ে। প্রাণ চলে যায়, ভরসা যায় না।
আর যুধিষ্ঠিরের শাস্তি? এর আগে যুধিষ্ঠিরের রথের চাকা মাটি ছুঁতো না সে চাকা মাটিতে নেমে এলোসবশেষে যখন পঞ্চপান্ডব হেঁটে স্বর্গে চললেন, তখন একমাত্র  যুধিষ্ঠির কুকুর সমেত সেখানে পৌঁছল নরক ঘুরে। ওই নরক ঘোরাটুকুই যা আরেকটু শাস্তি। গোটা রাস্তা সে অন্যে কে কী ভুল করেছে তার ব্যাখ্যা দিতে দিতে গেল! ভাবখানা এমন যে, সে ভুলের উর্দ্ধে। তাহলে মহাকাব্য কী শেখাচ্ছে?
শেখাচ্ছে যে, ভরসা তোমার প্রয়োজনে ভাঙতেই পার! তার বিশেষ কোনো শাস্তি  নেই। কেন না তারপরেও তোমার স্বর্গ সশরীরে বাঁধাই থাকবে, যেহেতু তোমাকেই নায়ক হিসেবে, আদর্শ সামাজিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, তাই। তোমার কোনো শাস্তি হবে না।
এর পরেও দুটি কথা আছে। মহাকাব্য তো! সব শিক্ষাই এমন সহজ সরল নয়উল্টোদিকে মহাকাব্য এও জানিয়ে যাচ্ছে যে, এই পৃথিবীতে নিজের প্রাণ দিয়ে অন্য  কাউকে ভরসা করে মূর্খরা। পৃথিবী উন্নত মানুষের জায়গা নয়এবং নায়কের  উচ্চতায় পৌঁছনোর জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক আচরণ বেশি বেশি করে কর। আর মধ্যে  মধ্যে ভয়ঙ্করতম সর্বনাশ করে চলে যাও, সমাজ উপেক্ষা করবে, স্বর্গ নিশ্চিত করবেই করবে। মানুষের ভরসার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সামাজিক ব্যবস্থা সমূহকে যথাস্থানে  অক্ষুণ্ণ রাখা। অর্থাৎ মানুষের প্রয়োজনে সমাজ নয়, সমাজের প্রয়োজনে মানুষ। গায়ের  জামা মানুষ পরে না, জামা মানুষকে পরে।
এর মূল সূত্র আছে উপন্যাসের মৃত্যুতে। উপন্যাস, আমাদের এই ভূখন্ডে যে আখ্যানভাগ শুরু হয়েছিল মহাভারতের বিশালতায়, সে আখ্যানভাগে ছিল একটা সীমাহীন ভূখন্ড। যেহেতু মহাকাব্য, তাই এর চরিত্রেরা গম্ভীর জামা পরে বেরিয়ে  পরেছিল নানা উদ্দেশ্য সাধন করতে। মহৎ উদ্দেশ্য থেকে অসাধু উদ্দেশ্য, সব উদ্দেশ্যকেই সে বিশালতায় ধারণ করেছে। মহাকাব্য না হলে সার্ভান্তেসের চরিত্রর মতো  একটি জীর্ণ ঘোড়া এবং একটি শীর্ণ গাধা সমেত সহচর সংগ্রহ করে এরা কি বেরিয়ে যেতে পারত? কাল্পনিক দৈত্য দমন করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে দেখত, এ তো এক  আজব দুনিয়া, কিছুই কিছুর সঙ্গে মেলে না! না, তা সম্ভব ছিল না। যে যুগে মহাকাব্য শুরু হয়েছে সে এক অপার যুগ। মানব সভ্যতার সব কিছুই একে একে গড়ে উঠছে। অসীম সম্ভাবনা। সার্ভান্তেস যে ইউরোপে তাঁর নভেল লিখতে শুরু করেছেন, সে হলো এই গড়ে ওঠার শেষ পর্বের খেলা। এর মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে  'দশকুমারচরিত'সার্ভান্তেসের কাছাকাছি। মহাভারতেও মানুষের সামাজিক জীবনের রীতি-নীতি মূল্যবোধগুলো ইচ্ছে মতোন ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু সে সব ভাঙচুর ঢাকা  পড়ে গিয়েছে একটি উচ্চতর আদর্শের খোলসে। মানুষ জন্তুই। জন্তুসুলভ লোভ,  লালসা, তাড়না নিয়েই তার অস্তিত্ব। সেই অস্তিত্বকে মহিমান্বিত করতে তার লাগে আদর্শবাদ। হাজারো অযথার্থ অসামাজিক কাজকে ঢেকে দেওয়া গিয়েছে 'ধর্মরাজ্যগড়ার কবিকল্পনায়।
'রামায়ণ' ঠিক এই কারণেই মহাকাব্য হলেও বড় বেশি সাদাকালো। ঈশ্বর এবং  ঈশ্বরেরা জগৎ সৃষ্টি করলেন। তার পাপ-পূণ্য, ন্যায়-অন্যায় সাদা-কালোতে বিভাজিত। সীতাকে রাবণ হরণ করে নিয়ে গিয়েছে এই অপরাধে রাবণের সঙ্গে সঙ্গে সীতারও মৃত্যু হয় অবশেষে। যতক্ষণ না হচ্ছে ততক্ষণ মহাকাব্যিক কবি থামতে পারছেন না। সাদা-কালোর মধ্যে ধূসর অঞ্চলে বসবাস তাঁর কাজ নয় কিন্তু 'মহাভারত'-এ কে  কার স্বামী, কে কার স্ত্রী, কে কার পুত্র সব ঘেঁটে একসা! মহানন্দে এই ঘাঁটার কাজটা মহাকাব্য-রচকরা করে গিয়েছেন। ঈশ্বরের মৃত্যুর পরবর্তী যুগের রচনাএ যুগে নতুন ঈশ্বরকে এঁরাই জন্ম দেবেন। অতএব ঈশ্বরের সেই অপার মহিমা নেই। সাদা-কালো জগত নেইমানুষ, তার বৃত্তের বাইরের পৃথিবীটাতে একান্ত অসহায়। একটি মাত্র সত্যের যুগ শেষ হয়ে গিয়েছে। অজস্র সত্যের মুখোমুখি হয়ে দিশাহারা মানুষ। তাকে দিশা দেবার জন্যই মহাকাব্য বয়ান। ব্যক্তি ও সামাজিক মানুষকে দিশা দিতে না পারলে সব ভেঙে যাচ্ছে।
এই ভাঙনকে মেনে নিয়েই যাত্রা শুরু 'দশকুমারচরিত'-এর। দন্ডি-র নামে লেখকসত্ত্ব নথিভূক্ত হলেও এ দন্ডি কেউই একা নয়। নানা হাতের ছাপ, এখানে 'মহাভারত'-এর  মতো করেই আছে। এখানে ন্যায়-অন্যায় পাপ-পূণ্য এ সব তুচ্ছ। যা চাও, যেভাবে  পাবে, সেভাবেই তাকে পেতে হবে। চুরি, জালিয়াতি, কামতাড়িত নারী ও পুরুষ সঙ্গ,  রাজ্য দখল, বিদ্রোহ, ক্ষমতার হস্তান্তর সব শুধুমাত্র খেলা। এক অসামান্য খেলার  বৃত্তান্তে খেলে যায় এই উপন্যাস। কোনো এক সত্য আর নেই। নতুন ঈশ্বরও মৃত। সামনে যা কিছু তার সীমা কেউ জানে না। অতএব এক তুমুল রোমাঞ্চকর যাত্রা হলো জীবন। এক ভয়াল যাত্রার নাম জীবন। কোন মোড়ে কার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে তা কেউ জানে না! পাঁচ থেকে দশ শতকের মধ্যে এই উপাখ্যান রচিত। এবং এই উপাখ্যানে কেউ কোনো আদর্শের জামা পরে নেই। মহাকাব্যের বয়ান যখন আধুনিক রূপটি নিয়ে এসে দাঁড়াল তখন এই 'দশকুমারচরিত'-এর যুগ। তাই মহাকাব্যের মধ্যেও আদর্শের জামা পরা চরিত্রগুলোকে মাপের থেকে ছোট লাগতে শুরু করল সেই ছোট হওয়া মাপ থেকে জামা খুলে নেবার কাজটা প্রায় গুছিয়ে সেরে ফেললেন মধুসূদন দত্ত। রামকে কার্যত প্রতিনায়ক করে লিখে ফেললেন 'মেঘনাদবধ কাব্য'
ঈশ্বর এবং পাপ-পূণ্যের মৃত্যুতে মানুষের কাজ বেড়ে যায়। অতএব এবারে চলে এলো মানুষের ঈশ্বর সাজার পালানানা সংস্কারের দাবিতে মুখর হয়ে উঠল লেখকদের  কলম। সে সব কলমই জন্ম দিল নতুন  চেহারায় নারীকে বঞ্চনার তীক্ষ্ণ সমালোচনার। বিধবাবিবাহ থেকে বাল্যবিবাহ অথবা বহুবিবাহ রোধ এ সব সামাজিক আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য নারী রক্ষা ও জাগৃতি। শুরু হলো পুরুষের হাতে। তারপরে  যার কথা তার হাতেই মানায় বলে নতুন শিক্ষিত নারী নিজের কথা বলতে শুরু করল। কিন্তু কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তো দুনিয়া বদলে গেল না! বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ চলতেই থাকল, বিধবাবিবাহ চালু হলো না। শিক্ষা ও সম্পত্তিতে নারীর  অধিকার সর্বত্র সুনিশ্চিত এমন কী আজ-ও নয় তার মানে সমাজ বদলায়নি। আবার সমাজে কিছু নারীর অবস্থা বদলে গিয়েছে। সামাজিক ক্ষমতার যে বৃত্তে পুরুষ  বসে অভ্যস্ত, সেখানে সে বসেছে। পুরুষ যা যা করে এসেছে সেও তাই তাই করেছে। দেশের প্রধানমন্ত্রী হলে রাতারাতি সব মানুষের স্বাধীনতা হরণ করতেও সে পিছ পা হয়নি। নারী বলে কোমল সত্ত্বা তাকে না ভাবিয়েছে না ঠেকিয়েছে! মুখ্যমন্ত্রী হলে চুরি থেকে বুটের ডগায় থেঁতলে দেওয়া কোনোটাতেই তার এলেম কম দেখা যায়নি! এইখানেই বিতস্তার গল্প প্রাসঙ্গিক। বিতস্তা যে গল্পটির কথক, সে গল্পটির উপাদান পূর্বতন নারীদের রচনা থেকে আহৃত, বয়ন বা বুননও তাই। বিতস্তার গল্পে বিতস্তার প্রকৃত অনুপস্থিতি স্বাভাবিক। পুরুষ যখন ধর্মরাজ্য গড়ার গল্প লিখেছে তখন আসলে সে তার সুবিধাকে আদর্শের জামা পরিয়ে চালিয়েছে যেমন, বিতস্তাও তেমন তার নিজের অপরাধকে সুনিপুণ অপরাধীর মতো চেপে গিয়ে একটি একপেশে গল্পের ছিপ  ফেলেছিল। সেই ছিপে আমার মতো মাছেরা ধরা পরেছে সহজেই। সে টোপ কেটে  বেরিয়ে যেতে পারা না পারার সময়ের মধ্যেই বিষ কতদূর গেল তার পরিমাপ নির্ধারিত হয়। আমি অনেকটা বিষ নিয়ে ফেলেছিলাম। আমিও বিষে অভ্যস্ত।
- মহারাজ বিন্দুসারের জন্ম, মহারাজ চন্দ্রগুপ্তের প্রেমের মৃত্যু এবং তাঁর প্রস্থানের সূচনাবিন্দু। বিন্দুসার বড় হলেই রাজ্য ছেড়ে তিনি চলে গেলেন নির্গ্রন্থ জৈন সাধু হয়ে।
সুনীল মাথার রুক্ষ চুলগুলোতে হাত চালাতে চালাতে কথাগুলো আলগা করে ফেলে দিল। যেন অনেকদিন এসব ভার সে বইছে। এবারে ফেলার সময় নিতান্ত নিস্পৃহতার সঙ্গে ফেলে দিচ্ছে। কালোয় কুঁদে তোলা সুনীলের শরীর বেয়ে কালো আরো কালো রঙ নামছে, যাকে আমরা সন্ধ্যা বলে থাকি। আমি সুনীলের কন্ঠের উষ্ণতা খুঁজে পেতে জন্য মরিয়া হয়ে বললাম,
- অথচ তাঁর শিক্ষক ও প্রধান পরামর্শদাতা, তাঁকে গড়ে তোলার কারিগর চাণক্য আজীবিক!
শব্দ নেই আর। সুনীল ডুবে গিয়েছে। সুনীলের বয়ানের ইচ্ছের মধ্যে শুধু ইচ্ছের প্রতি ইচ্ছেটাই অবশিষ্ট। বুঝতে পারলাম এরপর এইখান থেকে সুনীল কাহিনীটি বয়ান করবে। সুনীল নিজে চিরদন্ডিত এবং দন্ডের কাহিনীতে সে দন্ডদাতার ভূমিকাও একদিন পালন করে এসেছে। এই বদলাবদলি চরিত্রে তার কোনো আকর্ষণ নেই। সে ব্যক্তি হিসেবেও এখানে উপস্থিত নয়ব্যবস্থা যেহেতু চলে, তার ইচ্ছে করার ইচ্ছেতেই  চলে শুধু, ভালো মন্দ ব্যতিরেকে নির্গুণ ব্রহ্মের মতো সে সর্বগ্রাস করতে উদ্যত হয়, সেই ব্যবস্থার মতো সুনীলকে দেখতে লাগবে আলো এলে। সুনীল এখন রাত ন'টার  সময় কলকাতার যে এস আই বাইক থামায়, এটা ওটা কাগজপত্র চায় এবং সবশেষে আশা করে কোনোভাবে পঞ্চাশ টাকাও অন্তত হাতিয়ে নেবে, অথচ এ টাকার প্রতি যে তার আর কোনো মোহ নেই। সার্ভিসে কুড়ি বছর হয়ে যাওয়া এস আই-এর মুখের চেহারাটা এখন সুনীলের।

(ক্রমশ)




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন