কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা







২১) আবার রবীন্দ্রনাথ

আরো একটা পঁচিশে বৈশাখ চলে গেল। “সে চলে গেল, বলে গেল না...”কী করে বলে যাবে, যা জলঘোলা হলো, তাই নিয়ে! বিশ্বকবি আর গুরুদেব নামে যিনি  সমধিক পরিচিত, কবিগুরু বলেও যাঁকে সম্বোধন করা হয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তিনি হঠাৎ ‘কবিগুরি’ হয়ে গেলেন! তাঁর শান্তিনিকেতনে নাকি ‘গীতবিতান’ বানানো হবে! তাঁর কবিতা এখন কেউ কেউ কারেকশন করে দিচ্ছেন –“চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির”-এর শিরে সংক্রান্তি হেনে ‘উচ্চ যেথা সুর’ নাকি ‘শুঁড়’ কোট করা হচ্ছে। হায় রবি, ‘তুমি শুধু ছবি ...’!

অবক্ষয় যখন আসে, দুদ্দাড়িয়ে আসে। ভাত ছড়ালে কাকের অভাব হয় না, অথচ কাকশিল্পীও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তুলনা করেন এমন একজনের, যার ক-অক্ষর মহারাষ্ট্রে ব্যান্‌ড্‌। বুঝে বলেন, না কারো মন রাখতে, তা তিনিই জানেন।

তা উনি যখন এই সব মনোরঞ্জক ভাবনা ভাবতে পারেন, আমারই বা ভাবতে দোষ কোথায়? আমিও কবিগুরি-ই ব্যবহার করি তবে, ওটাই যখন ‘চলছে’!


একজনের খুব ইচ্ছে কবিগুরিকে নিয়ে একটা সিনেমা বানাবেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বললেন, রাজকোষ ফাঁকা। অমনি উনার গুসসা চেপে গেল। বললেন, এমন অর্থমন্তী ফোটাও। আমার চাই হর্ষদ যোশীর মতোন লোক। হরষদ যোশীটা যে কে, তা অনেকে বুঝতে  পারছিল না, একজন ভয়ে ভয়ে বলল, হর্ষদ মেহতা? ‘উনি’ বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ সেই। মেহতারা খুব কাজের লোক হয়।

হর্ষদ মেহতা তো বেঁচে নেই, ‘উনার’ মন রাখতে কেতন মেহতাকে নিয়োগ করা হলো  সিনেমাটার ডিরেক্টর হিসাবে। কেতন সিরিয়াস লোক, পড়াশোনা করতে বসে গেল  অবিলম্বে। ‘উনি’ বললেন, জানো তো, আমার রবীন্দোসঙ্গীত খুব সুন্দর লাগে শানের  গলায়। ও যে গানটা গেয়েছে - লাগিয়ে পালে আমার খোলা গলায়, দারুণ গেয়েছে। অমনি শানের কাছে তলব গেল, বেচারি শান আর কী করে? গুড়ি গুড়ি পায়ে কবিগুরির গান গাইতে চলে এলো কলকেতায়।

কেতন পড়াশুনা করছেন বিশ্বভারতীর লাইব্রেরীতে। সেখানে ‘উনি’ হাজির ডিস্কাশানের জন্যে। শানকেও নিয়ে গেছে অন্য একজন, দুজনকে আলাপ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘উনার’ সঙ্গে - এটা শান, তিনি কেতন। ‘উনি’ বললেন, আমি জানি, এটা কী, আমাকে মাটি চিনিও না!

কেতনকে বললেন, চিত্তোনাট্যটা ভালো করে বানাবেন। মা মাটির টাচ থাকে যেন।  তিস্তার জল ছাড়া হচ্ছে। বাংলাদেশের ব্যাপারটা গুছিয়ে লিখবেন।

কেতন রিসার্চ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশে জমিদারি করতে গেছেন কবিগুরি বৌ নিয়ে। সেখানে অনেক অতিথি আসে, তাদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে হয়। মৃণালিনী মুখচোরা মানুষ, তাঁর সাজগোজ আদ্ধেক হতে না হতেই কবিগুরি ডাক দেন, ছোটবৌ, শুনচো বলেবেচারি একদিকের গালে হয়তো পাউডার লাগিয়েছে, সেই   নিয়েই বেরিয়ে আসতে হয়।

বৌয়ের সাজ আদ্ধেক হওয়া এই জায়গাটার নাম উনি দিয়ে দিলেন সাজ-আধ-পুর।

জমিদারির কাজ তো আর এক জায়গায় না। ঘটিবাটি গুটিয়ে আর এক জায়গায় যেতে হলোএইভাবে যাওয়া আসা করতে করতে কবিগুরির জোব্বার দু তিন  জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। কবিগুরি স্ত্রীকে বললেন, সিলাই দেহ।

কবি মানুষ, তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে রোমান্স। বৌকে নিয়ে আদেখলেপনা। কিন্তু মুখচোরা  মৃণালিনী লজ্জা পান। বাস উঠিয়ে আর একজায়গায় জমিদারি করতে গিয়ে কবিগুরি ঘনিষ্ট হবার উপক্রম করতেই উনি ধমক দিয়ে বললেন, পতি সর্‌।

এই হচ্ছে কবিগুরির চার জায়গার নামের বেত্তান্ত। শান্তিনিকেতন, সাজাদপুর, শিলাইদহ আর পতিসর - এই নামের পেছনেও ‘উনার’ হাত - আই মীন হাত না অন্য কিছু, কেননা হাত তো কংগ্রেসের - ছিলজায়গার নাম দেওয়ার ব্যাপার তো আর আজকের না। গত চৌতিরিশ বচ্ছরে এইসব অজানা মূল্যবান তথ্য কেউ দিয়েছে আপনাদের?


এ এক মনগড়া গল্প। তবে ‘উনার’ কথা এটুকুই থাক। ‘উনি’ কখন যে কী বলবেন, তা কেউ জানে না। বরং তার কথা একটুখানি বলি, যিনি একের পর এক  কেচ্ছাকাহিনী লিখে বইপাড়ায় বেস্টসেলারের তকমা পেয়ে গেছেন। আর হ্যাঁ, সেই পাওয়ার জন্যে যার ঘাড়ে বন্দুকটি রেখেছেন, তিনি আমাদের এই ‘কবিগুরি’ই।

রবীন্দ্রনাথের সরাসরি বংশধর কেউ বেঁচে নেই। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে ঠাকুররা সরে গেছেন। দেশভাগের পর জমিদারি ব্যবস্থা চলে গেছে। শিলাইদহ, পতিসর, সাজাদপুর চলে গেছে বাংলাদেশে। শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠনে রবীন্দ্র-ভাবনার সম্ভবত কিছুই অবশিষ্ট নেই আর। রবীন্দ্রনাথের লেখার কপিরাইট উঠে গেছে। এখন তিনি সবার সম্পত্তি। যে যা খুশি লিখতে পারে তাঁর নামে।

এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে ব্যবসা চলছে মুখরোচক চানাচুর গল্পের। রবীন্দ্রনাথের বেডরুম স্টোরি হটকেকের মতো বিক্কিরি হচ্ছে বইমেলায়, লাইন লাগিয়ে কিনছে  আপামর বাঙালিশাস-বহুর টিভি সিরিয়ালে অভ্যস্ত বাঙালি তাদের পরিচিত এক   ঠাকুর্দার রস-কাহিনী পেলে পড়বে না? শুনলাম টিভি সিরিয়ালও হচ্ছে নাকি তাই নিয়ে।

তেলেভাজা বাঙালির বড় প্রিয়। এই গল্প তাদের যে তেলেভাজার স্বাদ জোগাবে, তা  তো বলাই বাহুল্য। আমি শুধু ব্যাপারটা একটু পদ্য করে পরিবেশন করে দিই।

একদা বঙ্গভূমে রঞ্জন বন্দ্যো
ফুলের মধ্যে খুঁজে জাঙিয়ার গন্ধ,
মিশিয়ে শ্রীমগজের শেষ ড্রপ জুস তক
লিখলেন পরপর গবেষণা পুস্তক।
বিজ্ঞাপনের আলো জ্বলে ওঠে নিয়নের!
চরিত্র যারা, তারা সব সানি লিওনের
মত আদর্শবাদী, একেবারে নোনতা।
তাদের রবি-ভাবনা পড়্‌, বোঝ্‌, শোন্‌ তা।
রাস্তায় হেগে রাখা, তার ওপরে বৃষ্টি
পড়লে ছেৎরে গিয়ে যে মহান সৃষ্টি
হয়, তারই মতো ঘেঁটে রঞ্জন বন্দ্যো
রবিকে প্রেজেন্ট করে। বাহবা, আনন্দ!
ভালো করে চেপে ধর হাতলটা চেয়ারের।
এই বইগুলো একে একে বুক ফেয়ারের
বেস্ট-সেলারের তাকে, বোঝ্‌ কী অবস্থা!
বাঙালির রুচি, আহা, ধরিস নে দোষ তার।
কান্না শুনতে পাস বইপাড়া সরণীর,
রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ তো করোনি?’
এ কী! খচে গেলি নাকি? ওরে দূর বোকা, শোন্‌ -
বিক্রি হচ্ছে, তুইও খুলে ফেল প্রকাশন।

এ ভাবেই চলছে বাঙালির সংস্কৃত চর্চা। সংস্কৃতি এগিয়ে চলেছে তীব্র গতিতে।  চারিদিকে উন্নয়নের প্রবল জোয়ার, তাতে ট্রাফিক সিগন্যালে সারাদিন গাঁক গাঁক করে বাজে রবিবাবুর গান। ভয়ঙ্কর গ্রীষ্মের দাবদাহে কুলকুল ঘামতে থাকা মানুষ বাদুড়ঝোলা হয়ে বাসে চড়েন, সিগন্যালে দাঁড়ানো সেই বাসের দিকে ধেয়ে আসে গান – আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে। লোক সময় ভুলে হাতঘড়ি দেখে। ও মা, এখন তো বেলা পৌনে দশটা! এই সময় জোচ্ছনা! মরণ!

পঁচিশে বৈশাখ চলে গেল। রবীন্দ্রনাথ, তোমার জন্যে আমার এই আট লাইনের বেশি কিছু দেবার নেই আজ।

রবীন্দ্রনাথ, তোমার গায়ে আঁশটে আঁশটে গন্ধ!
তোমায় নিয়ে কেচ্ছাখেলায় মেতে রঞ্জন বন্দ্যো,
পেনের মাথায় ডায়রিয়া তাঁর, পায়ুই ভাবেন ঠোঁটকে -
দিদি এবং ভাইরা তোমার পিন্ডি দিচ্ছে চটকে।
তোমায় নিয়ে ব্যবসা, শুধুই গুছিয়ে নেওয়া আখের।
দুর্বিষহ হচ্ছে স্মৃতি পঁচিশে বৈশাখের?
বোবা মাইক! গাঁকগাঁকিয়ে তোমার গানই গায় সে!
আবার তোমার শ্রাদ্ধ হবে এই শ্রাবণের বাইশে।


1 কমেন্টস্:

  1. আজকের মামাটিমানুস-আয়িত বাংলায় রবীন্দ্রনাথের যে এমন অবস্থা হবে, সেটাই স্বাভাবিক নয় কি?

    উত্তরমুছুন