সমকালীন ছোটগল্প |
রাম ভরোসা
মধ্যরাতে
ঘুম ভেঙে যায়। উঠে বসে রাম। গ্রামের এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বাইরের জানালাটা
গরাদহীন। জীর্ণ গরাদগুলো ভেঙে গেছে। পরিচর্যা নেই। মেরামতির টাকা শুকনো মাটিতে
ফেলা সামান্য জলের মতো কে যেন শুষে নেয়। রুক্ষ পৃথিবী, তেজী সূর্য কেড়ে নেয় পরিশ্রান্ত মানুষের অধিকার। গণতন্ত্রে
কারো কারো পোয়াবারো, জল পায়,
রোদ পায়, মাটি পায়, বাকিরা
প্রজ্বলিত যম আগুনে। স্বর্গ নরকের মাঝে আটকে পরা রামভরোসা উঠে বসে মধ্যরাতে। এত রাতেও বাইরে বোধহয় একটা
অস্পষ্ট গোঙানির শব্দ। ইদানীং কলকাতা জুড়ে মরে যাওয়া ম্যামথের পৈশাচিক কান্না শোনা
যায়। গোটা শহর আচ্ছন্ন করে প্রাগৈতিহাসিক জীবেরা জেগে ওঠে –
কখনো ডিপ্লোডোকাস লেজ আছড়ায় – মৃদু ভূকম্প হয়, কখনো আবার টিরানোসেরাস রেক্সের দাঁতের ঝলক। ঐ উড়ে গেল টেরোড্যাকটাইল ভোটের
প্রচার শেষ করে। এরই মধ্যে বাস্তব ও দুঃস্বপ্নের মাঝে দুলতে থাকা রামভরোসা জেগে ওঠে।
রাম
তার বাবার মতোই রোজ বনগাঁ লোকালে চেপে কলকাতায় আসতো কাজের খোঁজে। রাজমিস্ত্রির
কাজটা কলেজে পড়া রামের পোষাত না। ড্রাইভারি শেখার ইচ্ছে ছিল। বাবা রাজি হয়নি।
পাশের বাড়ির ভুবনের উনিশ বছরের ছোট ছেলেটা গাড়ি চালিয়ে মেঘের পানে ছুটে যেতে
চেয়েছিল। কিন্তু সবাই বীর হনুমান নয়। হনুমান জয়ন্তীতে জন্ম হওয়া সত্ত্বেও রবি গাড়ি
সমেত মাটিতে আছড়ে পরে। এখন তার মৃত্যুর ফাইল বন্ধ বাসি মদের বোতল হয়ে হিমঘরে।
সবেধন
নীলমণি রাম। তিন সন্তানের মরণের পর, তিন কন্যা সন্তানের পর আঁতুড়ে নিজের মাকে খেয়ে রাম আবির্ভূত হয় ধরাধামে যেমন
সম্ভবাবি যুগে যুগে। এক ঘন বৃষ্টির রাতে বাসুকির ছায়ায় পুত্রকে আলিঙ্গন করে ছুটে
যাচ্ছে বাসুদেব। দুরারোগ্য রোগ থেকে বেঁচে গেল বাসুর শেষ সন্তান রাম। অনেক লড়াই।
জীবনের শেষ পাঁচ বছরের সঞ্চয় ফুরিয়ে ধারদেনা করে ফিরে এলো রাম। রুগ্ন দুর্বল
ছেলেটি ছিল রাম ভরোসা । রাত একটা নাগাদ স্ট্যান্ডের শেষ অটো চালকের হাতে পায়ে ধরে
যখন হাসপাতালের দিকে ছুটে চলেছে বাসু তখন আধো আলো আধো অন্ধকারে স্ট্রিট লাইট ও
অন্য গাড়ির ছিটকে আসা দ্যুতিতে অচেনা লড়ির পিছনে লেখা চোখে পরে –
“রাম ভরোসা ”। কপালে হাত ঠেকায় বাসু। দুবার জন্ম হয়েছিল রামের। স্বর্গ
থেকে ধ্বনিত হয়েছিল ভবিষ্যবাণী –
দুবার মরবে রামভরোসা । First as
tragedy, then as farce.
যেদিন
পুনর্জন্ম পায় রাম, সেদিন তার
সমনামী মাতাল লড়িটির মৃত্যু হয় ওভারব্রিজের রেলিঙে টলে পড়ে গিয়ে। কে একজন মজা করে বলেছিল –
“রাম ভরোসা মারা গেল”। পাশ থেকে রাতের বোতল বন্ধু বলে – “মারা গেল, নাকি গাঁড় মারা গেল? দ্যাখ দ্যাখ ওর পোঁদে লেখা – রাম ভরোসা !” রাত্রি
কাঁপিয়ে ধ্বনিত হয়েছিল তাদের উন্মাদ হাসি। তবু ব্রিজের হাজার হাজার গাড়ি আটকে পরার
আগেই অটো পেরিয়ে গেছিল লড়িটাকে। মরে যাওয়া লড়িটা মূর্তিমান ট্র্যাজেডি হয়ে থ্যাঁতা
ইঁদুরের মতো শুয়েছিল কলকাতা নামক মর্গে যান্ত্রিক কাটাছেঁড়ার প্রতীক্ষায়। বিপদ
পেরিয়ে, ট্রাফিক জাম
পেরিয়ে বাসু কপালে হাত ঠেকিয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল – “রাম ভরোসা !” দুদিন যমে মানুষে টানাটানি। তারপর সুস্থ হতে শুরু করলো রাম। যেদিন ছোট্ট রামকে
নিয়ে বাড়ি ফিরল বাসু, সেদিন টিভিতেও
তার সন্তানের নামে জয়ধ্বনি শুনতে পায় – “জয় শ্রী রাম”। একটা মসজিদ
ভেঙেছে। রামের জন্মস্থানে আবার নাকি রামের মন্দির হবে। সে মন্দির ভাঙা পড়েছিল
একদিন। আবার শিশু রাম সগৌরবে ফিরবে নিজস্থানে। কপালে হাত ঠেকায় বাসু –
“রাম ভরোসা ! রাম ভরোসা ”। রামের ভরসাতেই দুবার ঠ্যাং ভেঙে জন্ডিস,
পক্স, ম্যালেরিয়া ও ম্যালনিউট্রিশন পেরিয়ে আমাদের রামও ধীরে ধীরে বড় হয়ে যায়। আমাদের
দেশও এগিয়ে যায়। ধীরে ধীরে প্রগতির হাওয়ায় ১৯৯২ সাল থেকে নয়া মিলেনিয়ামে পৌঁছে যাই
আমরা।
প্রথমে
বাবার সঙ্গী হয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ। জোগাড়ে হয় রাম। ছেলেবেলা থেকে দুর্বল –
অপুষ্টির শিকার, বেশি পরিশ্রম করলেই হাঁপ ধরে যেত। মিস্ত্রি সে হয়ে উঠতে পারে নি। প্রথম বছরের
পর কলেজ ছেড়ে দিয়েছিল জীবিকার খোঁজে। মন বসতো না লেখাপড়ায়। কলেজের স্যার প্রথমদিন
নাম ডাকতে গিয়ে থমকে যায়। “রামভরোসা ! এ আবার কি নাম রে বাবা। ভরোসা আবার কারো পদবী হয় না কি?
ব্যাটা তুই জেনারেল না এসসি বলতো? এসসিরা আজকাল পদবী লুকায়! হাহাহা!” অট্টহাস্যে ফেটে পরেন স্যার। তার জন্মের অত বড় গল্প বলা হয়ে
ওঠে না রামের। সে চুপ থাকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম তার মতো আরো অনেক রামভরোসা চুপ থেকেছে। হাত মুঠো হয়ে ওঠে রামের। কাঁপতে
থাকে কপালের রগ, তবু শতাব্দীর
জীর্ণ অভ্যাসে কণ্ঠ বিশ্বাসঘাতকতা করে, উদ্যত চোখ নেমে আসে, হাত স্থবির হয়। উচ্চ বেদীর ওপর আসীন গুরুর দিকে চেয়ে মাথা নত করে।
লেখাপড়ার
থেকে দূরত্ব তৈরি হয় দ্রুত। রুগ্ন শীর্ণ শরীরের রামভরোসা কে পেরিয়ে কেউ ফার্স্ট
সেকেন্ড হয়, কেউ জাতীয়
স্তরে খেলে আসে। গতি বাড়ে শহরের, গাড়ির সংখ্যা
মানুষের সাথে প্রতিযোগিতায় নামে। বাড়ে রাস্তা, উড়ালপুল, উন্নয়ন। দুর্ঘটনারও সংখ্যা বাড়ে। দ্রুতগামী শহরের মাঝে গা বাঁচিয়ে রামের ভরোসা
তেই তার ধুকপুক জীবনটা আগলে রাখে। মিস্ত্রি বাবা একদিন বহুতল বানাতে বানাতে ছিটকে পড়ে বাঁশের
কাঠামো থেকে। পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী তারপর থেকে। রামভরোসা চেষ্টা করে রিক্সা চালানোর,
টোটো চালানোর। তারপর একদিন শহরে ঢোকে নতুন প্রযুক্তি। বোতাম
টিপে টিপে ঘরে বসে সুখাদ্য পৌঁছে দেয়ার কাজ। কাজ পায় রাম। স্ক্রিনে ভসে ওঠে “Your
delivery man Ram Bharosa is about to deliver your package in 2 mins”. অচেনা মানুষের কাছে পৌঁছায় রোজ রামভরোসা ।
এখন
হাসপাতালের বেডে উঠে বসে তার গোটা জীবনটা ভেবে চলে রাম। ঘরে নিকষ কালো অন্ধকার। এই
ভয়ানক রোগের সময়ে কেউ কোথাও নেই। ছোঁয়াচে রোগের থেকে বাঁচতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের
দারোয়ানটিও দূরে কোথাও ঘুমিয়ে পরেছে। আচ্ছা সে কি বেঁচে আছে?
কত বয়স হল তার? সাতাশ বছর, না কি
তিয়াত্তর না কি হাজার হাজার বছর? সেই রামের জন্মের সময় থেকে – যে রাম বাস্তব আর পরাবাস্তবের মধ্যখানে – স্বপ্ন ও ভবিষ্যতের মাঝখানে? তার আর কোন অসুস্থতা নেই। স্যালাইন এবং গত সন্ধ্যায় শেষ হয়ে
যাওয়া দুর্লভ অক্সিজেন সিলিন্ডারের থেকে নিজেকে মুক্ত করে রাম। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে
বাইরে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকায়। কৃষ্ণপক্ষের এক ফালি চাঁদ চেয়ে থাকে তার দিকে।
চাঁদের গায়ে জাতীয় পতাকা আঁকা। নিঝুম রাতের পেঁচা গেয়ে ওঠে যেন –
“সারে জাঁহা সে আচছা”। গভীর ঘুম থেকে জেগে ওঠা রামকে নিশুতি রাত যেন
সংবর্ধনা জানায়।
কাশি
থেমে গেছে। জামার পকেট হাতড়ায় রাম। একটা বিড়ি হলে মন্দ হত না। শূন্য পকেট,
পোড়া বিড়ির টুকরো অবধি নেই, একটু ছাইয়ের গুঁড়ো লেগে আছে। আচ্ছা রামভরোসার পদবি কি ছিল?
সে মরে গেলে ডেথ সার্টিফিকেটে কি লেখা হবে?
রামভরোসা , মেল, টুয়েন্টি
সেভেন ইয়ার্স, ডায়েড ডিউ টু
কোভিড রিলেটেড কমপ্লিকেশনস? না ভুল? রাম যখন
কলকাতায় একের পর হাসপাতালে বেড না পেয়ে এই ক্রমশ আধামফস্বলে বদলাতে থাকা গ্রামের
স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এসে পৌঁছায় তার কাছে আধার কার্ড ছিল না কোন। কোভিড পরীক্ষাও
হয়নি। কাশতে থাকা, ধুঁকতে থাকা
শীর্ণকায় রামভরোসা কে কেউ ছুঁতে চায়নি, সারিয়ে তুলতে চায় নি। দুর্ঘটনা, ব্যাধি, অভাব,
অপুষ্টি, খিদে, বেকারত্ব নিয়ে
রামের ভরসায় বেঁচে থাকা রাম প্রমাণ করতে পারেনি সে এ দেশের নাগরিক। ধুঁকতে থাকা
রামের মনে পড়েনি হাসপাতাল খোঁজার আগে ভোটার, আধার খোঁজা দরকার ছিল তার। ভারতীয় উপমহাদেশের বেনাগরিক রাম
সুতরাং মারা গেলে হবে “আনআইডেন্টিফায়েড মেল, এজ আননোন, কজ অফ ডেথ –
কার্ডিয়াক এরেস্ট, রিজিন – আননোন”। এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোন মতে একটু বাতাস লাভ করে রাম।
অক্সিজেন সিলিন্ডার পেয়ে দীর্ঘ যাতনার পর ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।
ঘুম ভাঙা চোখে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে রামভরোসা । একটু এগোতেই একটা ঘুমিয়ে থাকা খেলার মাঠ। কারা এসে জড়ো হয়েছে ওখানে? সারি সারি মাথা সব। নিশুতি রাতের আগন্তুক। পিছনে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের খোলা দরজা দিয়ে যে সামান্য চাঁদের আলো পড়েছে তাতে রামভরোসা র দেহটার একটা আভাস পাওয়া যায়। তবে এ কোন রামভরোসা ? ট্র্যাজিক মরণ হল না তবে তার? সে কি মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই? রামের ভরসায় আবার বেঁচে উঠলো বুঝি সে! সারি সারি মাথার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলে রাম। প্রাগৈতিহাসিক জীবেরা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। শান্ত রাত। সোজা চলতে থাকে সে। তার হাতে বাঁধা লাল সুতলি, কোমরে মাদুলি, হাতে সস্তার পাথর। পিছনে চলতে থাকে তার মতো মানুষ থেকে ভুত হয়ে যাওয়া আরো অনেক রামভরোসা । ভোরের আলো ফোটার আগেই তারা পৌঁছে যাবে অযোধ্যা। নির্মীয়মাণ রাম মন্দিরের সামনে হাত জোর করে জবাবদিহি চাইবে।
আননোন ডেডবডি। ভর্তি হওয়ার সময় নিজেকে রামভরোসা বলে দাবি করেছিল, রাত ১২.১০ নাগাদ এক্সপায়ার করে গেছে। কারণ – স্বাস্থ্যকেন্দ্রের শেষ অক্সিজেন সিলিন্ডারটি শেষ হয়ে গিয়েছিল। ডাক্তারের এই রিপোর্ট আসা অবধি হে পাঠক অপেক্ষা করুন। রামভরোসারা এখন সারা রাত্তির জুড়ে হাঁটবে। ওকুপাই রামজন্মভূমি! এখনো ভোর হতে ঢের দেরি।
বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা আখ্যান...এবং হ্যাঁ অবশ্যই রাজনৈতিক।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ - কণাদ সাহা।
উত্তরমুছুন