সমকালীন ছোটগল্প |
সহযাত্রী
ব্যাঙ্ক ছুটির পর কলেজ স্ট্রীট বইপাড়া থেকে দুটো বই কিনে বাড়ি ফিরছিলাম। আমহার্স্ট স্ট্রীট ক্রসিং-এর কাছে আসতেই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। প্রায় মরে যাওয়া ঠাণ্ডা শেষ ফাল্গুনের এমন বিরল বৃষ্টিতে আবার প্রাণ ফিরে পাচ্ছিল। বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রায় পনেরো মিনিট পার করে ফেলেছি। হঠাৎই উল্টোদিকের ওষুধের দোকানের পাশে এটিএম বুথের সিকিউরিটি গার্ডের দিকে আমার চোখ আটকে গেল। মাধববাবু না? খুব ইচ্ছে করল রাস্তা পার হয়ে একবার সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কতদিন দেখা হয়নি, কথা হয়নি। কিন্তু তখন মুষলধারে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। সাথে ছাতা নেই। তাই রাস্তা ক্রস করবার উপায় নেই। তবে লোকটি মাধববাবুই কিনা সে ব্যাপারে একটা ধন্ধও রয়ে গেল। পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারলাম না। অনেকসময় এরকম কতই তো হয়! অচেনা লোকের মধ্যে চেনা মুখের আদল খুঁজে পাওয়া যায়।
এর মধ্যেই গলফগ্রীনগামী একটা বাস পেয়ে গেলাম। মাঝারি ভিড়। স্টপেজ ছেড়ে যাবার আগে আরও একবার জানালা দিয়ে এক ঝলক নিরীক্ষণ করলাম। কিন্তু লোকটা যে মাধববাবুই সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হতে পারলাম না। মনের মধ্যে অনেক প্রশ্ন দেখা দিল। উনি এটিএমের সিকিউরিটি গার্ডের কাজ ধরলেন কবে থেকে?
মাধব বসাক কাজ করতেন আমারই প্রোমোটার বন্ধু নিখিল দাসের কোম্পানিতে। নিখিলকে অনেক বলে কয়ে আমিই কাজে ঢুকিয়েছিলাম। চাকরি হারিয়ে মাধববাবু তখন বিপর্যস্ত, মানসিকভাবে ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন। আমার অনুরোধে নিখিল সেবার এগিয়ে না এলে ---
তাহলে কি নিখিলের কোম্পানি ছেড়ে দিয়েছেন
মাধববাবু? ফাঁকা রাস্তা পেয়ে বাস দ্রুতবেগে এগোচ্ছিল সামনের দিকে। আর আমার ভাবনা
পাক খেয়ে পিছিয়ে যাচ্ছিল অনেকটা।
মাধববাবুকে প্রথম দেখি নৈহাটি লোকালে। উনি শহরতলীর বিভিন্ন সেলুনে কমদামী শেভিং ক্রিম আর আফটার শেভ লোশন সাপ্লাই করতেন। অনামী সেইসব ক্রিম আর লোশন বিক্রির উপর অল্প মাস মাইনের সাথে কিছু কমিশন দিত কোম্পানি।
সহযাত্রী হিসেবে পরিচয়টা সামান্য ঘনিষ্ঠতার জায়গায় পৌঁছনোর পর আমাকে দেখলেই একগাল হাসি ছড়িয়ে দিতেন মাধববাবু। সিটে বসে বা দাঁড়িয়ে নানান গল্প, আলোচনায় কখন যে সময় পেরিয়ে যেত টেরই পেতাম না। মাধব বসাক নৈহাটিতে নামতেন। ওনার কোম্পানির অফিস ওখানেই। কখনো কখনো বারুইপুর, সোনারপুর, ডায়মন্ডহারবারের দিকেও যেতে হত তাঁকে। কমদামী ক্রিম লোশনের মূল বিক্রিটা ছোটখাটো সেলুনে হলেও ওইসব জায়গায় দু’একটা মুদি দোকানেও অর্ডার পেতেন তিনি।
শিয়ালদা এসে ডান দিকে ঘুরল বাস। মৌলালিতে পেছনের সিটে বসবার জায়গা পেলাম। বসতেই প্রাক্তন সহযাত্রী মাধববাবুর সাথে ফেলে আসা আরও কিছু স্মৃতি এলোমেলো ভেসে আসতে লাগল।
আমি ব্যারাকপুরে নামতাম। সদ্য প্রমোশন পেয়ে তখন ব্যাঙ্কের অফিসারের চেয়ার পেয়েছি – ব্যারাকপুর ব্রাঞ্চে। মাধববাবুর সংসারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ঐ ক্রিম লোশনের কোম্পানিতে কাজ করার আগে কাঁচড়াপাড়ায় একটা জুটমিলে চাকরি করতেন তিনি। সেটা বন্ধ হয়ে যায় বহুকাল আগে। তারপর থেকেই নৈহাটির এই কোম্পানিতে। ওঁর একমাত্র কন্যা তখন বঙ্গবাসী কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। মেয়ের বিয়ে-থা, পড়াশোনা – এসব নিয়ে বেশ উদ্বেগের মধ্যেই থাকতে দেখেছি মাধববাবুকে। নেহাত রাজাবাজারের পৈতৃক বাড়িটা ছিল – তাই রক্ষা। না হলে বাড়ি ভাড়া গুনে যেতে হত নিরন্তর। মাধববাবুর স্ত্রী বৈঠকখানার একটা মেসে দু’বেলা রান্নার কাজ করতেন আর মেয়ে বাড়িতে গোটা দুই টিউশুনি – এসব কথা প্রায় বছর দুয়েক আগের। এরপর আমি মধ্য কলকাতার ব্রাঞ্চে বদলী হয়েছি এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই মাধব বসাকের সাথে যোগসূত্রটা ছিন্ন হয়েছে।
মাঝে মাঝে অবশ্য ট্রেনে মাধববাবুর দেখা পাওয়া যেত। লেডিজ বগির পরের বগিতে উঠতাম। উনিও তাই। কামরায় উঠতেই – ও দাদা, এদিকে -- ডাক-টা এখনও কানে বাজে। জুন মাসের মাসের মাঝামাঝি কোনও এক সময়ে মাধববাবু অনেকদিনের জন্য বেপাত্তা হয়ে গেলেন। ভরা বর্ষা তখন শহরের বুকে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ট্রেন পরিষেবাও মাঝে মাঝে অনিয়মিত হচ্ছিল। মাধব বসাকের ফোন নম্বর ছিল আমার কাছে। কিন্তু করব করব করেও ফোন আর করা হয়ে ওঠেনি। ব্রাঞ্চে তখন অসম্ভব কাজের চাপ। রাত সাড়ে সাতটা, আটটার আগে অফিস থেকে বেরোতেই পারি না। মাধব বসাক নামটা ধীরে ধীরে কখন যেন আবছাই হয়ে গেল।
আগস্ট মাসের শেষের
দিকে আবার একদিন দেখা
পেলাম ওনার। সেই নৈহাটি লোকালে লেডিজ বগির পরের বগিতে। চম্কে উঠেছিলাম ওনাকে দেখে। সপ্রশ্ন দৃষ্টি
নিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম তাঁর দিকে। চেহারা এতটা রুক্ষ হয়ে গেল এই ক’দিনে! রোগা তো ছিলেনই কিন্তু এখন যেন রুগ্নতায় ভরা মাধববাবুর শরীর। দু’চোখের নিচে একপোচ কালি। গালে তিন চার দিনের না কামানো
কাঁচাপাকা দাড়িতে বয়স এক ধাক্কায় অনেকটাই যেন বেড়ে গেছে। কেমন এলোমেলো আর
উদ্ভ্রান্ত লাগল মাধববাবুকে।
কামরায় সেদিন লোকজন কম। ওনার পাশে বসলাম। কাঁধের সেই অতি পরিচিত ঝোলা ব্যাগটা দেখলাম না। উনি একটু হালকা হাসলেন। বললাম – অনেকদিন পর যে! এতদিন কি অন্য বগিতে যাচ্ছিলেন?
না, না, ওসব কিছু
নয়, আসলে কোম্পানিটা বন্ধ হয়ে গেল! মালিক ব্যবসাপত্র গুটিয়ে নিলেন। শেভিং ক্রিমের
বাজারে অনেক লোক ঢুকে পড়েছে যে! সেভাবে অর্ডার আর পাচ্ছিলাম না। কোম্পানির মূল
লক্ষ্য ছিল ছোটোখাটো সেলুন, ফুটপাতে বসা নাপিত আর কয়েকটা মুদি দোকান। ব্যবসার খাতিরে অনেক সময়ই পেমেন্ট বাকি
রাখতে হয়েছে। সে সব টাকা অনেকে শেষপর্যন্ত দেয়নি। এ নিয়ে ঝগড়াও কম হয়নি ওদের সাথে।
কোম্পানিই বা এসব শুনবে কেন? মালিকের লস্ বাড়ছিল লাফিয়ে লাফিয়ে। বেতনও অনিয়মিত
হয়ে গেল। আরও দু’জন সেলস্ম্যানও ব্যবসা দিতে পারছিল না। তারপর একদিন মালিক কোম্পানি
তুলেই দিলেন।
নৈহাটি লোকাল তীব্র গতি নিয়ে ছুটছিল। ঝিক্ ঝিক্ শব্দের সাথে জানালা দিয়ে হু হু করে ঢুকে আসা হাওয়ায় এলোমেলো হয়ে যাওয়া চুলগুলো ঠিক করতে করতে কী যে বলব বুঝে উঠতে পারলাম না। মাধববাবুও নির্বাক, নিঃস্পন্দ। আমিও অনেকক্ষণ মূক হয়ে বসে রইলাম। তারপর বললাম – তা এখন কোথায় যাচ্ছেন? এরপর কী করবেন ঠিক করলেন?
-নৈহাটি
যাব। মালিকের বাড়ি। কিছু টাকাপয়সা পাওনা আছে, আজ দেবেন বলে ডেকেছেন। তবে এখন কিই বা করব? এ বয়সে কে চাকরি দেবে আমায়?
কথা বলতে বলতে কেশে উঠলেন মাধববাবু।
কাশির শব্দটা ভালো ঠেকল না আমার কাছে। বুকে প্রচণ্ড কফ্ না জমলে এমন ঘড় ঘড় শব্দ
হয় না। একদলা কফ্ মুখ বাড়িয়ে জানালার বাইরে ছুঁড়ে দিলেন তিনি।
তারপর বললেন – দেখবেন, যদি কোনও কাজকর্মের সন্ধান দিতে পারেন। এক্কেবারে বেকার হয়ে
গেলাম দাদা। কী করে যে সংসার চলবে
এবার?
ট্রেন ধীরে ধীরে
ঢুকল ব্যরাকপুরে। নামার সময় বললাম – দেখি, চেষ্টা করব। কোনো কাজ টাজের খোঁজ পেলে
জানাব। এই শুকনো আশ্বাসটুকু ছাড়া সেই
মুহূর্তে আমার আর বলার কিছু ছিল না।
অদ্ভুত একটা শব্দ করে ব্রেক কষল বাসটা। চিন্তার জালও সাথে সাথে ছিঁড়ল আমার। দূরদর্শন ভবনের সামনে কয়েকজন নেমে গেলেন। জোরালো বৃষ্টিতে রাস্তায় জলও জমেছে বেশ। অন্যমনস্ক হয়ে মোবাইলটা ঘাঁটতে লাগলাম – মাধব বসাকের নম্বরটার খোঁজে। পাওয়া গেল না। বাড়িতে পুরনো ফোনটায় থাকতে পারে – ভাবতে ভাবতে ঠিক করলাম আগামীকাল অফিসে যাওয়ার আগে ঐ এটিএম বুথে যাব।
পরদিন সকালে ঝলমলে রোদ উঠল। পুরনো মোবাইলটা খুঁজে পেলাম না বাড়িতে। তাই মাধববাবুর নম্বরটাও আর পাওয়ার উপায় নেই। হাতে অনেকটা সময় নিয়েই বেরোলাম বাড়ি থেকে। আমহার্স্ট স্ট্রীটের ক্রসিং–এ নেমে সেই এটিএম বুথেই ঢুকলাম কিছু টাকা তোলার অছিলায়। কিন্তু মাধববাবুকে দেখলাম না। সিকিউরিটি গার্ডের পোশাকে বছর বাইশ তেইশের একটি ছেলে বসে আছে চেয়ারে। হাতে খবরের কাগজ। একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলাম – ভাই, গতকাল রাতে বয়স্ক একজন গার্ডকে দেখেছিলাম, আমার চেনা অনেকদিনের। নাম মাধব বসাক। তিনি কি চলে গেছেন সকালে?
খবরের কাগজ থেকে
মুখ তুলল ছেলেটি। বলল – কোন এটিএমে দেখেছেন? এটায়?
-হ্যাঁ, এখানেই। খুব
বৃষ্টি পড়ছিল। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন উনি।
-কিন্তু কালকের
নাইট ডিউটিতে তো বিপ্লবদা ছিল। বিপ্লব অধিকারী। আজ সকাল আটটায় ডিউটি চেঞ্জ হল আমার সাথে। মাধব বসাক নামে তো এখানে কেউ কাজ করে না! আর বিপ্লবদার তো তেমন বয়স না। আমার থেকে বড়জোর বছর
তিনেকের বড়।
-ওহ্ আচ্ছা, তাই
নাকি?
আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম
কিন্তু পেছনে কাচের দরজায় টক্ টক্ আওয়াজ হল। দেখলাম দু’জন লোক লাইন দিয়েছে।
ভেতরে আসতে চায়। দাঁড়ালাম না আর। দ্রুত বেরিয়ে এলাম।
হয়ত বৃষ্টির মধ্যে গত রাতে ভুলই
দেখেছি। নিজের প্রতি বিরক্ত হলাম – এসব ফালতু ভেবে লাভ আছে কোনও? কবেকার কোন এক
মাধববাবু তার সাথে এখন দেখা হলেই বা কী আর না হলেই বা কী? তাছাড়া দুজনের সামাজিক, আর্থিক
অবস্থানেরও যথেষ্ট তফাৎ আছে। একজন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অফিসার কেন একজন ফেরিওয়ালা টাইপের লোকের জন্য এতটা
উতলা হবে? দেখা হলে যদি টাকাপয়সা ধার চেয়ে বসে – পারব তো দিতে? প্রশ্নটা নিজের
কাছেই রাখলাম।
ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছে। দশটা প্রায় বাজে বাজে। অফিসারকে ব্যাঙ্কে টাইমমতো ঢুকতে হয়। রাস্তার বাঁদিক ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। উঠে পড়লাম তাতে কিন্তু মনের খট্কাটা দূর হল না। একটা চোরা অস্বস্তি কাঁটার মতো বিঁধে রইল।
অফিসে ঢুকে ফোন
করলাম নিখিলকে – আমার প্রোমোটার বন্ধু। মিনিট দুয়েকের মতো কথা হল ওর সাথে। কিন্তু
যা শুনলাম তাতে আমি আরও বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। মাধববাবু ওর কাছে বছরখানেক কাজ
করেছিলেন। দুর্বল, অশক্ত শরীরে দৌড়ঝাঁপের কাজ
আর পারছিলেন না। তারপর কোনো এক সিকিউরিটি এজেন্সিতে
চাকরি পেয়ে ছেড়ে দেন নিখিলের কোম্পানি। সামান্য কিছু টাকা
পাওনা ছিল নিখিলের কাছে। তবে তা নিতে আসেননি অনেকদিন। তারপর নিখিলই একদিন মাধববাবুর
বাড়িতে টাকাটা পৌঁছে দিতে গিয়ে জানতে পারে – নিউমোনিয়ায় ভুগে মাধববাবু মাস খানেক
আগে মারা গেছেন।
খুব সংবেদনশীল লেখা টি হৃদয় ছুঁতে পারলো বলবো না, বলাবো হৃদয়ে ছাপ রেখে গেল ।
উত্তরমুছুনতথাগত বাবুকে আমার অনেক ভালোলাগা এবং শুভেচ্ছা জানাই এবং কালিমাটি পত্রিকা এবং সম্পাদক কাজল বাবুকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
খুব সংবেদনশীল লেখা টি হৃদয় ছুঁতে পারলো বলবো না, বলাবো হৃদয়ে ছাপ রেখে গেল ।
উত্তরমুছুনতথাগত বাবুকে আমার অনেক ভালোলাগা এবং শুভেচ্ছা জানাই এবং কালিমাটি পত্রিকা এবং সম্পাদক কাজল বাবুকে অনেক ধন্যবাদ জানাই।
অনেক ধন্যবাদ।
মুছুনলেখা
উত্তরমুছুনলেখা টা বেশ ভালো ও মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো , আমাদের প্রতিদিনের ইদুঁর দৌড়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় এভাবেই কত চেনা পরিচিত মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেলি সেটা অনেক সময় আমাদের আর খেয়াল থাকে না !!
উত্তরমুছুনThanks a lot.
উত্তরমুছুন