কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২০

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

নিঃসঙ্গতা এক অন্তহীন কারুকাজের আরামকেদারা




চাঁদের আলো দেখিনা বহুদিন; বিকল্পও। শুধু এক গোলাকৃতি ঝুলে থাকতে দেখি আকাশের গায়ে। কখনও বা যোনিমুখের আদল, কখনও বা কোন মানবীর মুখ। খুব মন দিয়ে চোখ খুঁজি। যদি আলো দেখতে পাই। কিন্তু আলোরা ছুটি নিয়েছে নিশানা খুঁজতে। কীসের নিশানা? প্রেমনির্মাতারা একটা একটা করে খুঁটি পুঁতে দেয় পূর্ণচন্দ্রের গায়ে। চাঁদগলা জ্যোৎস্না চিবিয়ে চিবিয়ে যখন ছিবড়ে হয়ে ওঠে তখন তারা ক্যানালের জলে নেমে সাঁতারের ভান করে। আমি বুঝি সন্তরণের স্পৃহা আসলে গর্ভধারণ পটীয়সীর নগ্ন নৃত্যকলা। নৃত্য ভেঙে দেখেছি আমি। নৃ থেকে বিচ্ছিন্ন এক আশ্চর্য মানবী। ভাঙা আয়নার টুকরো কাঁচে প্রতিবিম্ব সাজিয়ে সাজিয়ে নিজেকে কামধেনু করে তোলে। কামযোগিনীর ভূমিকায় অভিনয় করতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলে। তারপর ধরতাই এ গিয়ে সবকিছু ওলোটপালোট। সংখ্যাতত্ত্ব এসে বসে হাতের আঙুলে। আঙুলশিকারিদের অন্তর্গত আকাশে তখন শূন্য চাঁদ জেগে ওঠে তন্ময় সংগীতে।

 

আজ সারাদিন মনে হল এখনও দিন শেষ হয়নি এখন                                               সন্ধের মাঝামাঝি একটা সময় আর কিছু                               পরে রাত নেমে আসবে

এবং কালকের মতো দিনটি শেষ হয়ে যাবে অতীত হয়ে যাবে অথচ আমি                             ভাবিনি এভাবে একটা দিন শেষ হয়ে যায়

(নিঃসঙ্গতা- প-৯)

 

দিন শুরু হয়ে শেষ হয়ে যায় একসময় – এটা আমার রেসপেক্টে অবাস্তব, কারণ এই করণে আমি কোথাও নেই। আমি আছি আমার ভাবনার মধ্যে- গতকালও আমি ভাবিনি এভাবে একটা দিন শেষ হয়ে যায় – এই হল আমার বাস্তব। বাস্তব আর অবাস্তব নিঃশব্দে জায়গা বদল করে নেয় দ্বান্দ্বিক টানাপোড়েনের চোরাবালিতে ডুবতে থাকা যুক্তি খুঁজতে থাকে যুক্তিহীনতার সোপান এই থাকা-না-থাকার গোলমেলে বিষয়টার ভেতর শুরু হয়ে যায় “নিঃসঙ্গতা এক অন্তহীন কারুকাজের আরামকেদারা” উপন্যাসের নামের ভেতর এক সুস্পষ্ট সংজ্ঞা নিরূপণের ইঙ্গিত। আমরা ভাবতে থাকি নিঃসঙ্গতার রূপারূপ। নিঃসঙ্গতা এক বায়বীয় অলঙ্কার। সঙ্গকামী মানুষও নিঃসঙ্গতার মোহ কামনা করে; যার ভেতর তার নিশ্চিন্ত আশ্রয়; আরামের কালবেলা ঘেঁষে গেঁথে নেয় অন্তহীনতা। রোয়ানো ভাবনাগুলোর পিঠে কারুকাজের সামিয়ানা। নাম্বার সিস্টেমের চাপে ও তাপে ঈকারান্ত ঘাড়ে বসে রাশিগুলো অমূলদ করে দেয়। মাথাগোণাদল আর খোঁজাদলের দলীয় পরিধি ফুঁড়ে মুখ রাখি উপন্যাসের জানলায়। পাতার খাঁজে লটকে থাকা পাতাবাহার আরামকেদারার কারুকাজে হাত রেখে দেউলে হতে চায়। আর নিঃসঙ্গতার প্রত্যেকটা দেউলিয়া খুঁজতে গিয়ে আমরা একটা একটা করে বর্ণ হারাই, মাত্রা হারাই; লেখকের কেয়ারি আঙুলের মোহে জড়িয়ে যাই। জড়ানো ভেতরবাড়ির আপন নিঃসঙ্গতার ভেতর বাসা খুঁজে খুঁজে নিজের বাড়ি বানাই; বাড়ির গায়ে নাম, রাস্তার গায়ে নাম। নামান্তরের লক্ষ্য উপলক্ষ্য ছেড়ে ভেসে পড়ি আগলখোলা দরিয়ায়।

 

সাধারণত প্রত্যেকটা নামের ভেতর আমরা প্রতীক বসাই। এই উপন্যাসেও রাস্তার না্মে বাড়ির নামে একটা করে প্রতীক চিহ্ন ব্যবহার করাই যেত। কিন্তু লেখিকা প্রতীকে বিশ্বাসী নন বরং নামের ভেতর যে ফাঁক আর সেই ফাঁকের ভেতর গড়িয়ে পড়া ফন্দিফিকিরসহ নম্বর নিয়ে খেলায় মাতেন লেখিকা নাম্বার সিস্টেমের ব্যবহার ফ্রান্সের উলিপো সাহিত্য আন্দোলনের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। যেমন কবিতার প্রত্যেক পংক্তির বিশেষ স্থানে অবস্থিত বিশেষ্যটিকে অভিধানে দেওয়া ওই অবস্থানের বিশেষ্য দিয়ে বদলে দেবার খেলা। এইরকমের বহু শব্দক্রীড়ার পিছনে ছিল গণিতজ্ঞ কাব্যপ্রেমীর শব্দসম্ভাবনার মন্ত্র। এই উপন্যাসে সংখ্যাতত্ত্বের ব্যবহার পাঠককে উলিপো সম্পর্কে উসকে দিলেও লেখিকা এখানে কোনো বিশেষ পন্থা অনুসরণ করেননি বা এই সংখ্যাতত্ত্বের পিছনে গণিতের কোনো হাত নেই। তিনি প্রত্যেকটা চরিত্রকে নামের পরিবর্তে একটা করে নাম্বার দিয়ে সিগনিফাই করেছেন। হয়ত রাস্তার নাম্বার বা বাড়ির নাম্বারের সঙ্গে চরিত্রগুলোকেও একই পদমর্যাদা দিতে চেয়েছেন। এরা সকলেই একই সাধারণতন্ত্রের অন্তর্গত। আর এই তন্ত্রের বাইরে অবস্থান করে প্রধান দুটি চরিত্র, আবিদা ও আমি। সাধারণের থেকে পৃথক অস্তিত্ত্ব – এজন্যই যেন এরা নাম্বার সিস্টেমের বাইরে। উদ্দেশ্য বিধেয় যাই হোক, নাম্বারের এই ব্যবহার পাঠককে কিছুটা গোলকধাঁধায় ফেলে দেয়। সম্ভবতঃ এই ধাঁধা রচনাও লেখিকার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। সহজকে সরলে গড়িয়ে দিতে নারাজ তিনি, বরং কিছুটা গরলে গলাগলি করাই স্বভাব এই কলমের। তো এই স্বভাবকে মেনে নিয়েই মাথাগোণাদলের সঙ্গে সঙ্গে আমিও একটা হিসেবের মধ্যে ঢুকে পড়ি। প্রজন্মের নামকরণেও যখন ৯ ৯৯ ৯৯৯ নাম্বার সিস্টেম চালু হয়ে যায়, একটা নিরাপত্তাবোধের অভাব নিজের অজান্তেই চারিয়ে যায় পাঁজরের গভীরেবারবার ফিরতে থাকি ‘কেন’র কাছে। খুঁজতে থাকি উত্তর; যে খোঁজের মাঝে থাকে এই সময় এই সমাজ আর নিত্যকালীন প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্কের অনুপুঙ্খগুলো। উত্তর দেবার কোনো দায় লেখকের নেই; বরং মাথার ভেতর চারিয়ে দেন কিছু ধারণা আর ধারণা অনুযায়ী বিভাজন পদ্ধতি –

 

ক – ভয় পাওয়ার অভ্যাসে যারা ভয় পায়

খ – কখনো হয়নি যা এমন কখনও হবে না, এমন ধারণায় বিশ্বাসী যারা

গ – পূর্বপুরুষ যা ভাবেনি এমন কখনো ভাবা উচিত নয়, এমন ধারণা যাদের

ঘ – উচ্ছেদের ভয় পাওয়া মানুষ

 

চারটে ধারণার মধ্যে উচ্ছেদের ভয় জয়লাভ করে; কারণ প্রাচীন অভ্যাস ছেড়ে নতুনকে গ্রহণ করার কিছু কষ্ট আছে। এতগুলো বছর ধরে সবাই মিলে যে অভ্যাস তৈরি করেছে সেখানে যেমন অনায়াস নিরাপত্তা তেমনি কিছু মায়াও রয়ে যায় জড়ানো। বাইরের কিছুকে সহজে গ্রহণ করতে আমরা একটা মানসিক বাধার সন্মুখিন হই নতুনের স্পর্শে তাই উচ্ছেদের ভয়। আমাদের অস্তিত্বের পিঠে লেখকের এই বহুমাত্রিক ব্যবচ্ছেদ কোনো সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসারেখা টানে না। বরং টান দেয় পাঠকের নিহিত অভিজ্ঞতার উৎসবিন্দুটিতে; যা তার একান্ত নিজস্ব যেখানে সে আপন বোধ আর অবোধের পাঠ নেয় একান্তে।

 

একটা রাস্তার আদলে আর একটা রাস্তা, একটা বাড়ির আদলে একটা প্রতিবাড়ি তৈরির প্রস্তাব থেকে লেখিকা প্রতিমানুষ তৈরির ভাবনায় এসেছেন। জেনেটিক ক্লোনিং এর ভাবনা উসকে ওঠে মাথার ভেতর সমচেহারার সঙ্গে সমভাবনার দল তৈরি হয় যদি মাথার ভেতর নিউরাল নেটওয়ার্কে সমটঙ্কার ধ্বনি ওঠে – এই ভয় এই ভাবনার মধ্যে লালিত হতে থাকে ধারণার কলম। আর এইসব ভাবনার চোরাস্রোতে লেখিকা নিপুণ দক্ষতায় বইয়ে দিয়েছেন আবিদার পূর্ণচন্দ্র প্রেম। যদিও প্রতিমুহূর্তে মনে হয়েছে সে প্রেম চাঁদের প্রতি নয়, নিজের প্রতি। পূর্ণচন্দ্রকে প্রেক্ষাপটে রেখে নিজের অবস্থানকে যাচাই করা – কে বেশি সুন্দর। কারণ ৫ নম্বর রাস্তার ৫ নম্বর বাড়ির ৫ নম্বরের দেওয়া একটা ‘মতো’ শব্দ, চাঁদের মতো সুন্দর তুমি, তাকে তাড়া করে ফেরে।

 

এই আবিদাকে ঘিরে যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহাওয়া টেনে এনেছেন লেখিকা, তার অন্তর্মূলে রয়েছে এক রাজনৈতিক টানাপোড়েন। প্রতিদ্বন্দ্বিতার অভাব ক্ষমতাশীল মানুষকে অন্ধ করে দেয়; নিজের অবস্থানের গুরুত্ব সম্পর্কে সে উদাসীন হয়ে পড়ে। আর সেই ক্ষমতার চুষিকাঠি ৫ নম্বরের মুখে লালা ঝরায়; যেখানে হাওয়া দেয় মাথাগোণাদলক্ষমতার বিষাক্ত লালা থেকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিদ্বন্দ্বী জীবাণুরা। আক্রান্ত হয় নায়ক ‘আমি’। এই ‘আমি’ চরিত্রটি প্রায়শই উপন্যাসে এক উদাসীন পর্যবেক্ষকের ভূমিকা নেয়। জগতের সমস্ত কোলাহলের মধ্যে বাস করেও সে নিঃসঙ্গ। সমস্ত পরিবেশের সঙ্গে লিপ্ত থেকেও সে উদাসীন। নিজের এই নিঃসঙ্গতাকে সে উপভোগ করে। কারণ এই নিঃসঙ্গতার মধ্যেই তার নিজস্ব আশ্রয়। এই ‘আমি’ ৫ নম্বরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুরু করলে সকলেই একটু নড়েচড়ে বসে; যদিও ক্ষমতার ধামাধরা লোকেরা তার প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে আমল দিতে নারাজ। এরপর গল্প এগোয়। অর্থের গহন তল ছুঁয়ে ছুঁয়ে নানা মুখ উঠে আসে আমাদের সামনে যেখানে আপাত সত্যগুলো সমস্যার মুখ দেখে আর চিনে নিতে থাকে আত্মক্ষরণের পূর্ণরূপ। ভিন্ন রং ও রেখায় নাম্বার সিস্টেমের মোড়কে আমাদের হাতে উঠে আসে দুটো সিদ্ধান্ত যার নির্যাস এইরকম –

 

১ – সফল হবার থেকেও জরুরি সাফল্যের খবর ওপরওয়ালার কাছে পৌঁছে দেওয়া। সময় মতো বা সময়ের আগে।

২ – কারোর চোখে চোখ রেখে যদি বলো ভালো আছো তো, তাহলে সে বোকা বনে যায়।

 

উপন্যাসের অধ্যায়গুলোর গায়ে যদি নাম্বার লাগাই তবে ১ থেকে ৯ অধ্যায় হাতে উঠে আসেনাম্বার ভালো না বাসলে নামেরও একটা লিস্টি বানানোই যেত। কিন্তু লেখিকা কোনোটাই করেননি বা করতে চাননিকিছু যুক্তি আর যুক্তিহীনতার অবয়বে রেখে গেছেন ভাবনার টুকরো। টুকরোগুলোকে এই উপন্যাসের চলনশক্তি বলা যায় – যার গতি ও রতি দুটোই ভাবনার সম্ভাবনায় মুখরআত্মআবিষ্কারের বহুমুখী নির্মাণে নতুনতর যে অভিযান তাকে চিহ্নিত করতে নীচের তালিকাটা তৈরি করি

 

 

নম্বর         নাম                              ভাবনা

১      নাম্বার সিস্টেম           আজ সারাদিন মনে হল এখনও দিন শেষ হয়নি এখন

সন্ধের মাঝামাঝি একটা সময় আর কিছু পরে রাত নেমে আসবে এবং কালকের মতো দিনটি শেষ হয়ে যাবে অতীত হয়ে যাবে অথচ আমি ভাবিনি এভাবে একটা দিন শেষ হয়ে যায়

 

২     ধ্বনিসন্ধান                ড্‌ ড্‌ ড্‌ ড্‌ ড্‌ ড্‌

ডিগ্‌ ডিগ্‌ ড্রুড্‌ ডিগ্‌ ডিগ্‌ ড্রুড্‌ ড্রি ড্রি ড্রি

ড্রি ড্রিহ

ডিগ্‌ ডিগ্‌ ড্রুড্‌ ডিগ্‌ ডিগ্‌ ড্রুড্‌ ড্রি ড্রি ড্রি

ড্রি ড্রিহ

ড্রাIIIহ্‌ ড্রাIIIহ্‌ ড্রাIIIহ্‌ ড্রিড্‌ ড্রিড্‌ ড্রিড্‌

ড্রিইইইইইইঢ্‌ ড্রিঢ্‌ ঢ্‌ ঢ্‌ ঢ্‌ ঢ্‌

 

৩     স্টেইনলেস স্বপ্ন                 ক্যানাল ইস্ট রোড। কার্নিভালের আদলে সেই রাস্তা। শুরু

থেকে শেষ অবধি বয়ে চলা লাগাতার কার্নিভালের আদলে। বিছিয়ে দেওয়া স্বপ্নরা যে যার মতো শুয়ে থাকে যা নিয়ে এই ক্যানাল যাবতীয় অহংকারে বলতে পারে এই আমাদের স্টেইনলেস ড্রিমস্‌। হাহ্‌!

 

৪     ভাগ্যকৌটো              গতকাল রাতের ভূমিকম্প যখন হয় তখন আমার বোধ

অচেতন এবং আমি গভীর অচেতন অবস্থায় ঠিক বোঝার মতো অবস্থায় ছিলাম না কতটা তখনও বাকি

 

৫     রহস্য সমাধান                  অথবা যারা যারা আমায় ছেড়ে চলে গেছে যাবে বলেই

এসেছিল...যদিও তাদের যাবার কোনো জায়গা নেইতবু আমার কোনো হাত নেই কোনো কিছুতেই... করারও কিছু নেই...শুধু জানি সময় আমাকে তার মতো চালনা করে...চালনা করে অপেক্ষা...তাও

 

৬     খোঁজার কবর                    স্বপ্নের ভেতর স্বপ্ন আশ্রয় নিলে যতটা জায়গা তৈরি করা

যাবে বলে মনে হয় আসলে তার চেয়েও বেশি জায়গা একটা স্বপ্নের ভেতর মাথাচারা দিয়ে ওঠে আর বলে যায়

 

৭     আবিদার পেট                    কোনো কিছু করার না থাকলে যেভাবে কোথাও যাবার না

থাকলেও আমরা আমাদের পায়ে কিছুটা গতি দিই হীনভাবে বা হীনতার কথা ভেবে যদিও আমাদের কোথাও যেতে না পারার অসহায় অভিমানই আমাদের ক্রমাগত বাধা

 

৮     খোঁড়ার কাটা প্যান্ট             জলের কাছাকাছি যেসব ঢেউ আমরা তার খোঁজ কখনোসখনো

পেলেও যুক্তি দিয়ে গুরুত্ব না দেবার ইচ্ছা আমরা প্রকাশ করি বা সেগুলো ঢেউই নয় এমনভাবে যাতে অন্যদের খুঁজে পাওয়াও মূল্যহীন হয়ে যেতে চায়

 

৯     খোঁজ শেষ ভাঙা শুরু    ও সোনা বন্ধু রে আমি তোমার নাম লইয়া কান্দি তোমার

বাড়ি আমার বাড়ি মধ্যে সুর নদী সেই নদী কেমনে হইল অকূল জলধী উইড়্যা যায় চকুয়ারে পঙ্খী পইড়া রইল কায়া কোন পরানে বিদ্যাশে রইলা ছাড়ি দ্যাশের মায়া রে বন্ধু

 

নাম্বার সিস্টেমের ডনবৈঠক পেরিয়ে দ্বিতীয় অধ্যায়ে ধ্বনিমিছিলে ঢুকে পড়ে হাতে যা উঠে এল তার নির্যাস বানিয়ে তুললে তা দেখতে হয় খানিকটা এইরকম

 

ড্রাহ ড্রাহ ড্রাহ ড্রাহ

নিয়মিত ভয় পাওয়ার অভ্যাস আমাদের নিশ্চয়তাবোধ তৈরি করে

লাগাতার বেঁচে থাকার মাতলামি, ভাবনার মাতলামি

শবমিছিল

উন্মাদ কোলাহল

মিছিলের শেষে খোঁড়া মানুষ যার প্যান্টের ঝুল খোঁড়া পায়ের পাতা থেকে তিন ইঞ্চি নিচে ঝুলছিল। আশা খোঁড়া পা টা একদিন গোটা পা হয়ে উঠবে

 

মিছিলের সন্মিলিত আওয়াজকে প্রেক্ষাপটে রাখলে জীবন ও মৃত্যুর লাগাতার কোলাহল থেকে উঠে আসে কিছু টুকরো ভাবনামাথার ভেতর অসমান ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া এক অত্যাশ্চর্য জগত ও অভিজ্ঞতার ভেতর নিক্ষেপ করে। পথের কোলাহল থেকে সে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তার বিষণ্ণতা তার একাকিত্ব ও তাদের ভেতর অন্তরভেদী প্রক্ষেপগুলো অনায়াসে তাকে সামিল করে ফেলে বিশ্বমানবের মিছিলে যেখান থেকে সে বিচ্ছিন্ন করেছিল মানুষ নামক সত্তার প্রতিকৃতি। তারপর সেখানে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে; সম্পুর্ণ স্বতন্ত্র মাত্রায়। এরই মাঝে এক অদ্ভুত কথোপকথন শুনি খোঁড়া আর ‘আমি’র মধ্যে –

 

সে – আমি সুযোগ পেলেই যে কোনো মিছিলে ঢুকে পড়ি। বিশেষ করে ডেডবডির মিছিলে। আমার ভালো লাগে। আগুন আমি ভালোবাসি। মড়াপোড়া দেখতে আমার ভালো লাগে।

আমি – আজ পর্যন্ত কটা ডেডবডির মিছিলে হেঁটেছেন?

সে – শেষ গুণেছিলাম উনিশ। তারপর ছেড়ে দিয়েছি। আর গুণিনি...

...

আমি – এর মৃত্যু হয়েছে রাস্তায়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে লেখা হয়েছিল ব্রট ডেড। সেখানে লেখা হয়নি এ মৃত... ঝামেলা হবে এই মড়া পোড়াতে... অনেক ঝুটঝামেলার পর যাওবা একে পোড়ানো হবে তারপর শুরু হবে আরো খেলা। এর মৃত্যুর নথি পাওয়া যাবে না... পুড়ে যাবার পরেও এর স্মৃতি নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া হবে একে মৃত প্রমাণ করার জন্য...সবার মনে এর স্মৃতি মানেই ব্রট ডেড।                                                              (নিঃসঙ্গতা-প-২২-২৩)

 

সাধারণত উপন্যাসে আমরা জীবনের নকশা খুঁজি, যারা রূপ নিয়ে ক্রমশ অরূপের দোরগোড়া ছুঁতে চায়। বাস্তব পেরিয়ে অবাস্তবের জানলাগুলো খুলতে খুলতে নিজেকে মেলে ধরেকিন্তু এ উপন্যাসের লেখিকা তথাকথিত সাজানো পথে হাঁটার বিরোধী। পথ আছে; কিন্তু তারা কখনই সোজা নাক বরাবর হাঁটে না বা হাঁটতে চায়না। প্রত্যেকটা পথ নিজেকে ভাঙে ঠিক যেখানে এসে আমরা একটা স্থিতি খুঁজছিলাম। ভেঙে টুকরো টুকরো করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়। তারপর যেকোনো একটা টুকরো বেছে নিয়ে আবার হাঁটাপথ। ফলতঃ কোথাও কোনো কংক্রিট রাস্তা তৈরি হয় না। প্রত্যেকটা মোড়ে একটা করে সম্ভাবনার মন্ত্র পুঁতে দেন। জল দেন; সার দেন; মাটি কুপিয়ে যথাযথ কর্ষণযোগ্য করে তোলেন পাঠকের ভূমিতারপর ডুয়েল লড়ার আহ্বান জানান-

 

ড্রাহ শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে যায়। আমাদের চারপাশে অনেক মানুষের ভিড়... সবাই দেখলাম খোঁড়া। সবারই এক পায়ের প্যান্ট অন্ততঃ ইঞ্চি ছয়েক করে ঝুলছে। এরা গোল মিছিল তৈরি করে লেংচে লেংচে ঘুরতে থাকে... এই যে মানুষের মিছিল তা ক্রমশ অন্ধকার হয়ে ঘুরতে থাকে। সেই অন্ধকারের ছায়াকে এঁকেবেঁকে লেংচে লেংচে আরো অন্ধকারের জন্ম দিতে দেখে আমি ৫ নম্বরকে খুঁজতে থাকি, এইজন্য যে তাকে বলতে চাই আমাদের এলাকায় অন্ধকারের পাশে অন্ধকার হয়ে একটা মিছিল ঘুরছে। যার মধ্যে সবাই ৩ নম্বর রাস্তার বাসিন্দা। আর আশ্চর্য এই অন্ধকারে ঘুরবে বলেই তারা সবাই আজ খোঁড়া। দিনের আলোয়ও তাদের খোঁড়া দেখায়নি।

(নিঃসঙ্গতা-প-২৪)

 

তোমার মতামতের অবস্থান কোথায়? কোন বিন্দুতে স্থির হয়ে আছো হে? অবস্থানের স্থিরতা মানে আংশিক মৃত্যু। তাই জীবনবিরহী লেখিকা অস্থির টান দেন স্থিরতার শেকড়ে। আমরা দোলাচলে পড়ি। যাবোকিযাবোনা টলটলায়। লেখিকা বোঝেন এই মুহূর্তটি। আর ঠিক সেই মুহূর্তটাকে ভেঙে খানখান করে দেন পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনায়। সূচনা মানে আমরা একটা ইতিবৃত্ত ভেবে বসি। ভাবনার পরম্পরা অনুযায়ী নিজেকে কিছুটা বিন্যস্ত করে গুছিয়ে বসি। অথচ বসা মাত্রই লেখিকার কলমের ছোটার সাধ হয়। আমাদের সাধ্য সাধনা সমস্ত তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে খলখল হেসে ওঠে। বলগাবিহীন বলাৎকারের বিষ ছড়িয়ে দেয় স্নায়ুতন্ত্রের জালে –

 

একদিন সকাল হলে আমাদের বাড়ি পাল্টে যেতে চায় হয়ে উঠতে চায় আর পাঁচটা বাড়ির মতো লম্বাটে আর গোলাকার চাঁদেরা বাড়ির চারপাশে তাদের আলো এবং নিঃসঙ্গতা নিয়ে পূর্ণ হয়ে উঠতে চাইলে আমি সেই পূর্ণতার মায়ায় বন্ধুহীন মায়াদের সঙ্গে ধীরে ধীরে এক সর্পিল আলোবৃত্তে ঢুকে যেতে থাকি। আর এত স্বপ্ন আমার চোখে তোমার চোখে কাকে কাকে বাছব! কোন কোন স্বপ্নকে আমি রূপ দেব? আমি স্বপ্নে বাড়ি বানাই যার এক একটা দেওয়াল একটু একটু করে গড়ে তুলি। কিছুদিন সেই বাড়িতে থাকি তারপর একটা একটা দেওয়াল একেকবারে বারবার ভেঙে ফেলি যাতে সেখানে একটা মিনার গড়ে তুলতে পারি। যখন দেখি সেই মিনার আর গড়ে তুলতে পারছি না আবার সেই পুরোনো বাড়িতে ঢুকে পড়ি। যে দেওয়ালগুলো ভেঙেছিলাম সেগুলো আবার জোড়া দিই। রোজ এই গড়া আর ভাঙা আমার চলতেই থাকে। এদের মাঝেই আমার স্বপ্নদের রাখার চেষ্টা করি। তুমি চাইলেই কি তাদের ছুঁতে পারবে? একফালি সুগন্ধীবাতাস আমি বন্দি করতে চাই আমার নিঃশ্বাসে যখন চাই তখনই। এইজন্য যাতে সে চাইলেও আমাকে ছেড়ে চলে যেতে না পারে। তাকে আমি জানি সেই বৃক্ষ যার ছায়ায় আমার ছায়া, যে ছায়ায় আমার সব দুঃখ ভোলা, তার ছায়ায় বসতে চাওয়া। তুমি আমার কাছে যা জানতে চাচ্ছ তা আমি তোমাকে কীকরে বলি? কী করে প্রকাশ করি? সেগুলো তো আমার ভীষণ নিজস্ব। আমার একান্তদৌলত। আমার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী।

(নিঃসঙ্গতা-প-৩০)

 

আমরা ঢুকে পড়ছি স্বপ্নমঙ্গল অধ্যায়ে যেখানে পাতা আছে নিঃসঙ্গতা নামে এক আরামকেদারা। যেখানে স্বপ্নকে বানানো হচ্ছে স্টেইনলেসস্টেইনলেস স্বপ্ন কেমন? যে স্বপ্নের গায়ে কখনো মরচে ধরে না। অর্থাৎ যে স্বপ্নেরা পুরোনো হয় না। ঝকঝকে সেই স্বপ্ন বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। যাপনের লড়াইটাকে সাহস যোগায় কথাটা নতুন কিন্তু ভাবনাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই আমরা নিজেদের স্বপ্নের সঙ্গে রিলেট করতে পারি। অর্থাৎ ‘আমি’র জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ফেলি। আর এইখানেই উপন্যাসের সার্থকতা। পাঠক আপন অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনে উড়ানের গল্পগুলো, মিলিয়ে নেয় চরিত্রের চলনের সঙ্গে। তন্ময় মুহূর্তগুলো ফিরে ফিরে চায় নিজের দিকে।

 

আমি চরিত্রটি স্বপ্নের গায়ে নম্বর লাগায় –

 

১ নম্বর স্বপ্ন – তোমার সঙ্গে দেখা হবে। এই তুমিটা কে? লেখিকা বলেননি তবু চিনে নিতে দেরি হয়না। এ সেই তুমি যা প্রত্যেকটি মানুষের অন্তরঙ্গ, যা আত্মার অনুষঙ্গে অব্যক্ত তরঙ্গ, যে চিরকাল সীমা চেয়ে চেয়ে অসীম গাইল অথচ সে গান অশ্রুতমালার মুক্তো হয়ে ঝুলে রইল।

 

২ নম্বর স্বপ্ন – নিজের এলাকার মাথা হওয়া। আর সেই স্বপ্নের হাত ধরে ৫ নম্বরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আবিদার সঙ্গে প্রেম। এই প্রেমের মধ্যে যে উদাসিনতা তা ১ নম্বর স্বপ্ন থেকে অনেকটাই আলাদা যেন। একই ‘আমি’র মধ্যে দুরকমের আকাঙ্ক্ষা। এক জায়গায় সে নিজের স্বত্ত্বাধিকার সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিবহাল আর অন্য জায়গায় তার আকাঙ্ক্ষা অদ্ভুত নিরাসক্ত। আবিদার সঙ্গে আলিঙ্গনে কোথাও কোনো কাতরতা দেখিনা। শুধু বারবার তার কাছে ফিরে আসার ইচ্ছেকে স্বপ্নের ভেতর বয়ে নিয়ে যায়। আর তাই প্রত্যেকবারেই সে অতিসহজে ছেড়ে যায় আবিদাকে। দুটো স্বপ্নকেই অব্যবহৃত রাখতে চায় সে, তাই পালটে পালটে দেখে। আকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে হাতের মুঠোয় পেলেই পাবার স্বপ্নটা আমাদের ছেড়ে যায়তাই সে কোনো স্বপ্নকেই বাস্তব করতে চায়না। বরং স্বপ্নকে স্টেইনলেস বানায় অর্থাৎ স্বপ্ন চায়, স্বপ্নপূরণ নয়।

 

ভাগ্যকৌটো অধ্যায়ে ঢোকার মুখেই লেখকের মন্তব্য, সময় আমাকে তার মত চালনা করে। কিন্তু সময় কী? সময় বলে তো আসলে কিছু হয় নাসময় একটা ধারণা মাত্র, আমাদের কার্যক্রমের কৌণিক পর্যায়গুলো খন্ড খন্ড করলে সময়ের পলগুলো উঠে আসে হাতের পাতায়। তো চলন আগে না সময় আগে একটা দ্বন্দ্ব লাগে মনে। সে যাই হোক, সময় এখানে বিষয় নয়, বিষয় হল খোঁজ। খোঁজাদলের খোঁজা-৩৩ এর খোঁজ। নিশানা খুঁজতে খুঁজতে হাতে পেয়ে গেল সে সোনারং ভাগ্যকৌটো। হাতে পেল কিন্তু খুলতে পারল না। ফলে গুপ্তধনের আশ্বাস এল মনে। সে বিশ্বাস করতে শুরু করল এই কৌটোর দৌলতে তার ভাগ্যোন্নতি শুরু হয়েছে। খোঁজা-৩৩ এর খোঁজ শেষ হল ভাগ্যকৌটো হাতে পেয়ে। কিন্তু শুরু হল সুযোগ জন্মের। প্রতিদিন সে কৌটো খোলার চেষ্টা চালিয়ে গেছে আর প্রতিদিন একটা একটা করে সুযোগের জন্ম দিয়েছে। যত বিফল হয়েছে তত সুযোগজন্মের হার বৃদ্ধি পেয়েছে; নতুন আশায় নতুন সুযোগে বুক বেঁধেছে। কী সেই সুযোগ লেখিকা বলেননি। হঠাৎ নজরে হয়তো ঘটমানতা পাঠকের নজর এড়িয়ে যাবে। কিন্তু কথনের ওই পরিসরে স্থির হয়ে বসলে অনায়াসে হাতের পাতায় উঠে আসে বিক্ষুব্ধ জীবনের প্রেক্ষাপটে বাস করা অণু পরমাণুর আবর্তগুলো। আবিদার প্রেম, এলাকার মাথা হওয়া-এইসব সুযোগের কথা ধরিয়ে দিলে খোঁজা-৩৩ হেসে ওঠে। কারণ এগুলোর কোনোটাই সে সুযোগের তালিকায় ফেলে না। তার মতে এসব তুচ্ছ সুযোগ, যার জন্য ভাগ্যোদয়ের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু বুদ্ধির। এবং কারো স্বীকারের অপেক্ষা না করেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতে পারলেই এলাকার মাথা হওয়া কিছু বিচিত্র ব্যাপার নয়। এই অধ্যায়ের চমক ছিল শেষে – সামান্য একটা মোচড়েই খুলে গেল বহুলোকের হাতফেরতা সেই ভাগ্যকৌটো। তার ভেতর কী আছে সেটাও এখানে কখনই বিষয় হয়ে ওঠেনি, কারণ লেখিকা তাকে পাঠকের ভাবনার হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। ভাগ্যকৌটোর খোঁজ, খোলার চেষ্টা ও সুযোগের অপেক্ষা এরাই প্রাধান্য পেয়েছে। আর তাই ঢাকনা খুলতে পেরে ‘আমি’র গলায় নিশ্চিত সিদ্ধান্ত শোনা যায় – “ভাগ্যের ঢাকনা খোলা মোটেও কঠিন নয়। শুধু ঠিক জায়গায় কায়দা করে মোচড়টা দিতে হয়"

 

উপন্যাসের প্রতিটি অধায়েই আবিদা এসেছে ঘুরেফিরে। আবিদার প্রেম, আবিদার আয়না, আবিদার চাঁদ – এই ত্রিনয়নের বিভ্রম প্রতিটা অধ্যায়েই ঘুরছে। সমুদ্রের ঢেউ যতটা উদাসীন জলাবর্তের সূত্র গাঁথে ততটাই সূক্ষ্ম তন্তু একটার পর একটা বিভ্রমে জড়িয়ে যায়কখনোবা জট পাকিয়ে একটা অ্যাবসার্ডিটির চেহারায় নিজেকে দাঁড় করায়। অ্যাবসার্ডিটি নিয়ে আমাদের পূর্বনির্ধারিত একটা ধারণা মাথার মধ্যে গাঁথা থাকে। কিন্তু লেখিকা টান দেন সেই শেকড়ে। অর্থাৎ পূর্বনির্ধারিত সেই ধারণা হুড়মুড় করে ভেঙে দেওয়াই যেন লেখকের ইচ্ছেযেহেতু আমরা ঢুকে পড়েছি লেখকের বানানো ক্যানাল স্ট্রিটের ওই পাড়ায়, ফলত আমাদের ইচ্ছেগুলো অনায়াসে চলে আসে লেখকের হাতের মুঠোয়। আমরা নিজেদের স্থাপন করে ফেলি সমবাহু ত্রিভুজের তিনটি কৌণিক অবস্থানে; প্রতিটা বাহুর মান যেখানে ধরে রেখেছে প্রত্যেকটা কোণের অভিমান। কিন্তু আবারও নিছক মান অভিমানের দাদন মেটানোর কোনো উৎসাহই লেখিকা দেখান না। বরং আমাদের অবস্থানের কৌণিক মাপ বা মাপের অভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। নাগরদোলার আবর্তন যেমন গ্র্যাভিটির ঝুঁটি ধরে উপরনিচ করার খেলায় মেতে থাকে তেমনি লেখিকা আমাদের যাপনের অলিগলিতে নিশানা পুঁতে পুঁতে মানসিক পর্যায়গুলো নিয়ে পর্যালোচনায় মেতে থাকেন। প্রত্যেকটা নিশানায় কিছু খোঁজ থাকে, যাকে লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে কখনো কলমের মুখে আবিদার চাঁদের ছায়া পড়েকখনোবা ছায়ারাই একটা আস্ত চাঁদের মুখ ঢেকে দেয় ধূসর সিদ্ধান্তের আড়ালে। অথচ ধূসর হলেও তারা দ্বিধাহীন; মায়াবী আঁচল খোঁজেনি কোনোদিন।

 

তো এভাবেই পাঠকের চাহিদাকে লেখিকা নিজের মত করে চালিত করেছেন বা করতে চেয়েছেন। তবু কিছু কিন্তু নিজের হাতেই ছড়িয়ে দিয়েছেন লেখিকা। আবিদার পেট উপন্যাসের কিছু অধ্যায় জুড়ে আছে। বয়ানের ঢঙে কিছু প্রশ্ন আক্রমণ করে। নিছক নারীবাদীর গলা এই উপন্যাসের চলপথ কি কিছুটা পিচ্ছিল করে দিল? নাকি নারীবাদ শব্দটাই অহেতুক এখানে? যদি মনুষ্যবাদ বলি তবে ভাবনাটা অন্যপথে চালিত হয়ে যায়। যেহেতু লেখিকা আবিদার গায়ে কোনো নম্বর লাগাতে চাননি, তাই প্রথম থেকেই তাকে সাধারণের থেকে আলাদা একটা অবস্থান দেওয়া হয়েছে আর এই অবস্থান থেকেই আবিদার কণ্ঠে উচ্চারিত হতে শুনি মনুষ্যবাদের চিরপরিচিত উক্তি, নারী হবার আগে আমি একজন মানুষ, আমার একটা পৃথক সত্ত্বা আছে, তোমাদের দেওয়া বীর্যকে অস্বীকার করে আমি বলতেই পারি, আমার গর্ভের সন্তান তোমাদের কারো নয়, সে নিতান্ত আমারই। এ উপন্যাস নিরাকারের সাধনা করেছে বরাবর। উদাসীন সম্পর্ক ভেতরবাড়ির দেয়ালগুলো একবার ভেঙেছে আর একবার গড়েছে। অথচ এই ভাঙাগড়ার সঙ্গে কোথায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েনি। প্যাশানের ভেতর বারবার মূর্তি গড়ে ভাঙা হয়েছে। টুকরোগুলো থেকে নির্মাণের নতুন রাস্তার খোঁজসেখানে আবিদাও তার আয়না হাতে সামিল হয়েছে বরাবর। তার নিরুদ্দেশ চলে যাওয়াও নিঃসঙ্গতার আরামকেদারায় নিজস্ব চিহ্ন রেখে যায় অন্তহীন কারুকাজে।

 

খোঁড়ার কাটা প্যান্ট অধ্যায়টিতে অনবদ্য কলমের আঁচড় লাগছে কল্পজগতের গল্প বলতে। খোঁড়া খোঁজাদলে নাম লেখাতে চায় কিন্তু খোঁড়া বলে কাজ পায়না তখন সে এক অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কার করে খোঁড়া পায়ের প্যান্টের পা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুটা বড় ছিল ওটা কেটে ফেলতেই পা মাপে চলে এল আর খোঁড়াও একটু সোজা হয়ে গেল-

 

আমি আমার প্যান্টের পা কেটে ফেললাম। আর একটু সোজা হয়ে গেলাম। এইভাবে আমি আমার যত প্যান্ট আছে সবার পা একটা একটা করে কেটে ফেলব, আর আমার পা পুরো সোজা হয়ে যাবে। আর আমি খোঁজা হয়ে যাব, নিশানা পাব, নিশানায় জিনিস খুঁজে পাব।                     (নিঃসঙ্গতা-প-৫৭)

 

আমাদের ভাবনারা প্রায়শই নিজের মত কল্পজগত তৈরি করে কিন্তু সবসময় তাকে যথাযোগ্য রূপে বাস্তবের মোড়কে পাঠকের কাছে মেলে ধরতে পারিনা প্যান্টের পা কাটার সঙ্গে সোজা হাঁটার এক মানসিক প্রতিক্রিয়া কীভাবে জড়িয়ে থাকে আমাদের মননে তারই প্রতিফলন দেখি খোঁড়ার পদ্ধতিতে আর খোঁজ; কিছু খোঁজার জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলা; লেখিকা আরো একবার অভিভূত করে দিলেন এই সামান্য বিষয়ের অসামান্য প্রেজেন্টেশানে

 

সাধারণত উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে এসে আমরা সমাধান খুঁজি। কিন্তু লেখিকা শুরুয়াতেও যেমন কোনো ধরতাই রাখেননি তেমনি শেষে এসেও কোনো সমাধানে উপন্যাস মেলাতে চাননি। খোঁজ শেষ করে ভাঙার কাজ শুরু করেছেন মাত্র। ভাঙতে ভাঙতে কোথায় যাবে জানা নেই। অর্থাৎ বিনির্মাণের এই বিন্দুতে যাত্রা শুরু করে পাঠকের ভাবনারা। তোমার অবস্থান কোথায়, চলপথের কোন বিন্দুতে, এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয়েছিল উপন্যাস। শেষে এসে পাঠক মুখ ফিরিয়ে দেখে সেই প্রশ্নটাকেই। খোঁজ শুরু হয়ে যায় এক নতুনপথে।

 

বশীকরণ মন্ত্র লেখিকের আঙুলে বশংবদ চিরকাল চলনে বলনে কথনে আর আমরাও হালভাঙা পালছেঁড়া নৌকোর মত ভেসে যাই উদ্দেশ্যহীনতায় কেন কোথায় কখন কীকরে প্রশ্নগুলো বুজকুরি কাটতে থাকে শ্বাসের ভেতর কিন্তু লেখিকা শক্তহাতে শ্বাসনালী টিপে ধরে রাখেন অসহায় প্রশ্নগুলো গলার কাছ অবধি উঠে এলেও নির্গমনের পথ দেখতে পায় না পাঠক তখন নিজেই লেগে পড়েন উত্তর খুঁজতে ফলত অনন্ত সম্ভাবনার জন্মমুহূর্ত দিকে দিকে ড্রাহ ড্রাহ ড্রাহ ধ্বনি ছড়িয়ে পড়তে থাকে জড়িয়ে যায় চলপথের সমস্ত ইতিহাস পূর্বকথন ছাড়াই তারা নিজেরা নিজেরা এক একটা রাস্তার জন্ম দেয় নির্মাণের মোহে সে হেঁটে যায়, কেবলই হেঁটে যায় কোথায় যাবে কতদূরে যাবে জানা নেই লক্ষ্যহীন হেঁটে যায় আরো নতুনের খোঁজে খোঁজের ভেতর ধীরে ধীরে জেগে ওঠে তার আপন আলোর জ্যোতির্বলয়; যেখানে সে নিজেকে খুঁজে পায়

 

যে লেখিকার অন্তহীন কারুকাজের পথ ধরে আমার এই নিঃসঙ্গ ভ্রমণ নতুনের খোঁজে তাঁর সংক্ষিপ্ত পরিচয়:

 

সুদেষ্ণা মজুমদার


গদ্যসংস্কৃতির নির্দিষ্ট বাঁধা সুর, গঠন বা আঙ্গিকের ঢং অগ্রাহ্য করে ২০০৯-তে সুদেষ্ণা মজুমদারের প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সেই সাপ জ্যান্ত’। ২০১০ এ এসে আবার একবার চিরায়ত গদ্যসীমার অনুশাসন ভেঙে দ্বিতীয় গ্রন্থ এই উপন্যাস, “নিঃসঙ্গতা এক অন্তহীন কারুকাজের আরামকেদারা”। দুটোই প্রকাশিত হয় কৌরব প্রকাশনী থেকে। জন্ম ও গড়ে ওঠা উত্তর কলকাতায়। গান শুনে আর নানান ধরণের বই পড়ে জীবন কাটাতে পারলে আর কিছু চান না আর সব কিছুর প্রেমে পড়াটা মস্ত ভালো লাগা। কৌরব গোষ্ঠীর সাথে প্রায় বছর কুড়ি।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন