কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১ নভেম্বর, ২০১৯

এলিয়া বার্সেলো




প্রতিবেশী সাহিত্য


এলিয়া বার্সেলোগল্প      

(অনুবাদ : জয়া চৌধুরী) 






পরিচিতি : স্পেনীয় বংশোদ্ভূত এই কল্পবিজ্ঞান লেখক থাকেন অষ্ট্রিয়ায়। সেখানে স্প্যানিশ ভাষায় অধ্যাপনা করেন। আধুনিক কল্পবিজ্ঞান হিস্পানিক সাহিত্যে  কিউবান লেখক দাইনা চাভিয়ানো এবং আর্জেন্টিনীয় লেখক আঙ্খেলিনা  গোরোদিশের সঙ্গে সমান ভাবে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। তাঁরা তিনজনে গঠন করেছেন ‘ত্রিনিদাদ ফেমেনিনা দে সিয়েন্সিয়া ফিকসিওন’। অসংখ্য পুরস্কারে  ভূষিত এই মহিলার বেশ কিছু বই পৃথিবীর আঠেরোটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।



Minnie (মিনি)

ওর নাম ছিল মিনি। ও দারুণ সুন্দরী ছিল, কিংবা অন্ততঃ তখনও পর্যন্ত খুব সুন্দর দেখতে ছিল। মিয়ামি-র মহাশূন্যবন্দর তিয়েররা সলে যাইহোক না কেন, অন্ততঃ ততদিন পর্যন্ত, আমি নিশ্চিত। সেদিন ঝকঝকে চোখ আর খিদেয় আধখোলা ঠোঁট নিয়ে সৌরজগতের বাইরের রিসেপশনে বসেছিল, নইলে  নাবিকদের পানশালায় আধা গ্যালাক্সী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে বিয়ার পান করছিল।
সব্বাই ওকে পছন্দ করত; কেউ করত ও মিষ্টি ছিল বলে, কেউ বা সুন্দরী বলে। বেশির ভাগই পছন্দ করত ও বেশ অন্য রকমের মানুষ ছিল বলে। কেননা ওকে কেউ বুঝত না। আর সেইজন্য, কিংবা হয়ত এসব সত্ত্বেও ওকে তারিফ করত।
বন্দরের একটা স্টোরে সে ডান্স গার্ল ছিল। একটু একটু করে সব ধরনের কাজকর্মই করত। তবে এসবই শেষ হল যখন তার সঙ্গে আলাপ হল সবচেয়ে চৌকস ঝকমকে যুবক ভ্লাদের।

আমি যখন তাকে দেখি সে সময় সে মোমরঙে আঁকা ল্যান্ডস্কেপ বিক্রি করত। সে সব তেররা শহরের এমন সব দৃশ্য যেখানে ও নিজে কখনও যায় নি। মিনি খুব গরীব ছিল। ঐ শহরটাই ওর গোটা পৃথিবী ছিল। আর তার নিয়মিত কাজ ছিল না বলে সে ঘুরে বেড়ানোর টাকাও জোগাতে পারত না। পথ চলতি লোকেরা, মহাবিশ্বের বাসিন্দারা যা বলাবলি করত, সেসব শুনে শুনে ওর কাছে  থাকা সাতটা রঙ দিয়ে সেসব জায়গার ছবি আঁকত। ক্বচিৎ কখনো কোন ট্যুরিস্ট প্রেমিক প্রেমিকা যুগল কিংবা কোনো সৈনিককে, যে বাড়ির জন্য অদ্ভূত বিদেশী সেই সুদূরের কোনো নক্ষত্রের মাঝের কোনো জায়গার কিছু উপহার  নিয়ে যেতে চাইত, তাকে ছবি বিক্রি করত।

তেররা তে আমি সাতবার যাত্রাযতি দিয়েছিলাম। তার মধ্যে তিনখানাই বাজে মৃত্যুর মালবাহী যাত্রা ছিল। স্রেফ ওকে দেখবার জন্য। ওর বিশ্বাস আর তীব্রতা আমায় ভীষণ টানত। সেরকমই কোন এক যাত্রায় ওর গল্পটা আমায় বলেছিল। বলেছিল ভ্লাদের সঙ্গে কীভাবে ওর আলাপ হয়। ও যখন মিয়ামির সবচেয়ে আকর্ষণীয়া, অন্যের হিংসের পাত্রী নর্তকী ছিল, তখন কেমন হাস্যকর দামে ভ্লাদ  ওর কোম্পানিটা কিনে নিয়েছিল। আমায় সে ভ্লাদের কথা বলত। ভ্লাদের সেই শীতল উপহাস মেশানো দৃষ্টি, প্রায় আদিম প্যাশন, দারুণ কথাগুলো। কীভাবে  তার নক্ষত্রমন্ডলীর আলো আর বরফ ফুলে ভরা হ্রদে বরফ জমাট বেধে চকচক করত। কেমন করে সে সেই নক্ষত্রমন্ডলের উঁচু চকচকে রুপোলি মিনার থেকে এসে পড়েছিল।

সেই গ্যালাক্সী সদৃশ নায়কটির জন্য মিনির অনুভূতিগুলো এত তীব্র ছিল যে আলগোছে অন্যমনস্ক ভাবে শুনতে শুনতে ওর প্রেমের সঙ্গে সেই ছেলেটির প্রেমের তুলনা না করে পারতাম না।

যে অবসরে নৌবাহিনী তার কাজের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছিল সে সময়েই ওরা একসঙ্গে থেকেছিল, মাত্র দুসপ্তাহ। সে দুসপ্তাহ হলদে পাতায় ছাওয়া শরতের  গাছের তলায় কাটিয়েছিল। তেররার বিপুল সুনীল গভীর সমুদ্রের দিকে চেয়ে চেয়ে কাটিয়েছে ওরা। সে জীবন মিনিকে আমূল বদলে দিয়েছিল। যখন ভ্লাদ ওকে বলল ফিরে এসে সে ওকে নিয়ে যাবে বিপুল নক্ষত্রপুঞ্জ ঘেঁষা তার নিজের ঘরটিতে, তখনই মিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চাকরিটা ছেড়ে দেবে।

ওখানকার দুএকটা দোকানেই খাঁটি তামাক পাওয়া যায়। সেখানকারই কোনো  এক দোকানে মুখোমুখি কার্পেটে বসে আমায় যখন একথাগুলো বলত মিনি, ওর চোখদুটো ব্রোঞ্জের মত চকচক করত। তখন চার বছর পার হয়ে গিয়েছিল, ভ্লাদ  সেখান থেকে চলে গেছে, অথচ বলবার সময় মিনির চোখদুটো অনির্বাণ বিশ্বাসে জ্বলজ্বল করত। ওকে সে বলেছিল যুদ্ধজাহাজের একটা বাহিনীর উন্নত সংস্করণে সে থাকে, যে জায়গায় সময় খুব আলাদা ধরনের। যেটায় পৌঁছনো মিনির জন্য বহু বছরের অপেক্ষা। তবে একজন ভ্রামণিকের কাছে সেটা তুচ্ছ একটা ব্যাপার।  ভ্লাদ সেটা বিশ্বাস করত আর মিনিকেও তাই বলেছিল। বেস হন-এর একজন ভূপদার্থবিদ মিনিকে জোর দিয়ে বলেছিল নক্ষত্রপুঞ্জের নায়কেরা যা বলেন তা ভুলে যান, কখনই তাঁদের প্রতিজ্ঞা রাখেন না। মিনি শুনেছিল, তবে বাতাস যেভাবে পাতার কথা নিয়ে আসে মিনিও তা ভেবে অপেক্ষা করে যাচ্ছিল।
ভ্লাদ ওকে কখনো চিঠি লেখে নি, এটা ঠিকই। কিন্তু মিনি ওকে বলতে শুনেছিল,  নক্ষত্রমন্ডলীর সংস্কৃতিতে চিঠি লেখার চল নেই। তারা কেবল কথা বলতে পারেন। মিনি তাই ভ্লাদের খবর না পেয়েও আশ্চর্য হত না।

-   সেইজন্যই তো আমি এই মহাশূন্য-বন্দরে ওর অপেক্ষা করি। - হাঁটু জড়িয়ে বসে সেকথাই আমায় বলেছিল সে। – আমি জানি ও যখন ফিরবে এখানে আমায় অপেক্ষা করতে দেখলে খুশি হবে। তার ওপর আমার বাড়ি কীভাবে যেতে হয় সে রাস্তাও ওর পক্ষে ভুলে যাওয়া  সম্ভব। – লোকে বলত কোথাও থিতু গাড়া বিষয়টা নক্ষত্রপুঞ্জের নায়কেরা পছন্দ করে না।

সেসময় আমিও ভাবতাম মিনি পাগল। পাগল না হলে কে আর ভ্লাদের মত একজন ভাড়াটে সৈন্যের বা আমার নিজের মত একজন লোকের কথায় এত বিশ্বাস কে করতে পারে?

পাঁচ বছর পরে আবার ফিরে গিয়েছিলাম। মিনি তখনও ঐ মহাশূন্য-বন্দরে ল্যান্ডস্কেপ বিক্রি করত আর বিয়ার খেত। তখন আরো বেশি বেশি খেত। কিন্তু সেটা কেবলমাত্র বিক্রিবাটা খুব একটা হত না বলে খেত। পুরুষেরা তার প্রতি উদারই ছিল। প্রথমটায় সে আমাকে চিনতে পারে নি। পরে যখন স্মৃতি তাজা হয়ে ফিরে এল, সত্যি সত্যি দারুণ খুশি হল সে। আমায় একটা সিগারেট  বাড়িয়ে দিল। আর আমিও হঠাত ঝোঁকের মাথায় তার একটা ছবি কিনেই ফেললাম। একটা ছোট ছবি, তাতে পাহাড় আছে, বরফ আছে, অচেনা অচেনা বাদামী রঙের বিরাট আকারের জন্তু জানোয়ারও আছে। ওকে বললাম - আমি বৃষরাশির নক্ষত্রমণির সেনাদের এরকম অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, তারা কেউ  ভ্লাদ নামের কাউকে চেনেন কী না। ভ্লাদ যে কিনা বহু বহুদিন আগে তিয়েররা ভ্রমণে এসেছিল। কিন্তু কোন কিছুই তো পরিষ্কার করে বের হত না। মিনি হেসে বলল - মহাশূন্য বিরাট বড়, জোয়েল!

মনে মনে এসময়েই আমি ওর প্রেমে পড়ে যাই। তখন কিম্বা যখন সে আমার কাছে তার প্রথম বড় গোপন কথা বলে স্বীকার করেছিল যে, সে ছবি বিক্রি করে পয়সা জমাচ্ছে বৃষ রাশির নক্ষত্রমণিতে যাবে বলে, তখনই আমি ওর প্রেমে পড়ি। নক্ষত্রমণির লোকেরা ওকে বলেছিল, যখন একজন পুরুষ বহু সময় ধরে মহাশূন্য পরিভ্রমণ করতে থাকে, একেক সময় তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো আর বেশি শক্তি প্রতিরোধ করতে পারে না, তখন ওরা তাকে ভ্রমণ করতে বারণ করে। শুধু নিষেধই করে না ওর অফিসিয়াল লাইসেন্সও কেড়ে নেয় আর বাকী জীবনের মত পুনর্বাসিত করে দেয়।

-   তবুও তো অনেকে আবার মরেও যায়। - চোখ বিস্ফারিত করে মিনি বলল। - তবে হ্যাঁ, এসব ভ্লাদের সঙ্গে কখনও যে হবে না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ও বেশ তাগড়াই চেহারার মালিক।
সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল মিনি। তারপর এত স্বাভাবিক ভাবে ওর কথা চালিয়ে গেল যে আমার চোখে জল চলে এল-
-   সে জন্যই ভাবি ওখানে যাওয়াই আমার পক্ষে ঠিক হবে। জানি এসব অনেক টাকাকড়ির ব্যাপার। আমার অনেক সময়ও লাগবে জমানোর জন্য। তুমি ভাবতে পারো ও আর কখনও ফিরবে না, আমরা আর কখনো  পরস্পরের দেখা পাব না, একথা ভাবাটাও কতখানি কষ্টকর? আমাকে  যেতেই হবে। সেটাই ভাল হবে না?

না বলার ক্ষমতা ছিল না আমার। কিন্তু হ্যাঁ-ও বলতে পারছিলাম না। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম ওর দিকে। আমার মাথা ঘুরছিল, মনে হচ্ছে ডুবে যাব, আর টানতে পারব না। ও তখনও আমার উত্তরের অপেক্ষা করে যাচ্ছিল। তখন, দুম করে ওকে বলে ফেললাম ওকে ভালবাসি, ও কি আমায় বিয়ে করতে রাজি আছে?
ক্লান্ত চোখে তাকাল আমার দিকে। দারুণ দুঃখে মুখ কালো হয়ে গেল তার, যেন কোন বাচ্চা ছেলের কথা শুনেছে। যতই হোক ও আরো ভাল কিছুর আশা করছিল। নীল জাম্পস্যুটের ভেতর আঙুল ঢুকিয়ে গলা থেকে ঝুলছিল একটা ছোট্ট বটুয়া, সেটাকে টেনে আনল। বাঁ হাতে সেটাকে উপুড় করে খালি করল। আমার দিকে বাড়িয়ে ধরে বলল-
-   কিন্তু ডিয়াল জোয়েল, আমি যে বাগদত্তা। আমি তো ওর, দেখছ না? আমি চিরকালের জন্য ওরই। আমায় যে ও সেকথাই বলেছিল।
বাঁ হাতে একটা ছোট্ট পাথর। লাল ঝকঝকে যেন মানুষের রক্তে তৈরি একটা ফোঁটা।

মধুর কন্ঠে বলে চলল সে -
-   ভ্লাদ যখন চলে গেল আমি ওকে একটা সোনার আংটি দিয়ে ছিলাম যেটা মা আমায় ছোটবেলায় পরিয়েছিল, আর ও এটা আমায় দেয়। ওদের  মহাশূন্যে এটা অনেকটা বিয়ের প্রতিশ্রুতির প্রতীকের মত, - আমায় বলেছিল ভ্লাদ। এটা প্রতিশ্রুতির চেয়েও বেশি এটা চিরকালের চিহ্ন। আমাদের দুজনেরই এগুলো আছে, বুঝলে জোয়েল?
কিছু বলি নি আর।
বলিনি যে যেমন পাথর ওর আছে ইমমালিয়ার মাটি এমন লাল পাথরে ভর্তি। বলিনি ভ্লাদ একটা বেজন্মা যে ওকে নিয়ে মর্মান্তিক ঠাট্টা করেছে। ও কক্ষনো সেই বুড়ি, ভুলে যাওয়া দেশ তিয়েররায় ফিরবে না আর। আর যদিই বা ফেরে মিনিকে মনেই পড়বে না আর। ওকে বলিনি বৃষরাশি নক্ষত্রমণিতে কোন আলো বরফের ফুল বা রুপোর মিনার পাওয়া যায় না।

আমায় ও বিশ্বাস করবে না। ও বড্ড বেশি সুন্দরী। বড্ড বেশি নিষ্পাপ। বড্ড বেশি কে জানে কী!
আমি আর কখনও তেররা তে ফিরি নি। হয়ত মিনি এতদিনে তার পথখরচা জমিয়ে ফেলতে পেরেছে। হয়ত মরে গেছে। হয়ত মিয়ামিতে, তেররা তে, সলেই দিন কাটাচ্ছে... ভ্লাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
তোমরা যদি কখনো সেখানে যাও, তাকে দেখো, দয়া করে বোলো ওকে যে জোয়েল কখনও ওকে একটা জামাও দেয় নি ঠিকই, কিন্তু তাকে ভোলেও নি। তাকে এখনও ভালবাসে।
রিগেল-এর জোয়েল যে এখন আর উড়তে পারে না, সে এখনও ওর জন্য অপেক্ষা করে, অপেক্ষা করেই যাবে। এটুকুই।
আহ্‌! দয়া করে আমার ঠিকানাটা লিখে দিও তাকে। রিগেলবাসীরা যে লিখতে পারে না।

 
        
          



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন