ধারাবাহিক উপন্যাস
প্রিয়দর্শিনী
(চতুর্থ অধ্যায়)
(১০)
বালিঘড়ি (চতুর্থ অংশ)
মেহেরৌলীর চক বাজারটা দারুণ জম জমাট। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে শেষে এক দোকানীর দোকান ঘরের বারান্দায় বসে পড়ল বিবাক। দোকানীর বেশ নাদুস নুদুস
ধরন। মাথায় ময়লা কাপড়ের পাগড়ী কিছু এলোমেলো। পরনের চকরা বকরা কামিজের প্রান্তে চিটেগুড়ের গুঁড়ো লেগে।
কী চাই?- কর্কশ সুরে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল দোকানী।
অর্থাৎ ভাল খদ্দের যদি হও তো বলো কী
জিনিষ খুঁজছো, নয়ত মানে মানে কেটে পড়। ফালতু লোকজনের বসার জায়গা এটা নয়। হিসেবী নজর বুলিয়ে বিবাক ততক্ষণে চারপাশ দেখে নিয়েছে। তাতার
ও বেদুইন জাতীয় লোকই বেশি। সকলেই ঢিলে কুর্ত্তা ও আলখাল্লা জাতীয় পোষাক পরে। সকলের
সঙ্গেই গোটা দুই তিন উট বা খচ্চর। খচ্চরের পিঠে বস্তায় মালপত্র বাঁধা। বিবাক যে
দোকানে এসে বসেছে সেখানে বড় বড় মাটির গামলায় চূড়ো করে বাজরা ও ডাল সাজানো। খেসারী
ছোলা, সব ধরনেরই ডাল রয়েছে। এছাড়া চিটেগুড় খাজা তামাকের
গুল তিসি ইত্যাদিও রয়েছে এক পাশে।
দোকানীর প্রশ্নে সে শুধলো,
বাজরা কী বা?
আঠারো কড়ি। কতটা দেব? - বলতে বলতে এক খাবলা বাজরা ওজনে তুলতে প্রস্তুত।
বিবাক নকাবের প্রান্তটা খুলে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল, ভাল নাচতে জানে, হাত ও পায়ের
গঠন সুন্দর ও মজবুত, এমন চেহারার কাউকে এ তল্লাটে
দেখা গেছে?’ তার কন্ঠস্বর একটু সতর্ক গোছের। দোকানের এক কোণে রেড়ীর তেলের প্রদীপ
জ্বলছে। জায়গাটা কালো ধোঁয়ায় ভর্ত্তি। দোকানের ভেতরে দেওয়ালে নানা স্থানে কালো
কালো ঝুল। এসবের মাখখানে চাঘানী দোকানীটির মুখখানি বড় ভাবলেশহীন দেখায়। আবার তাকে
শুধোয় বিবাক, মারী বাত্ সমঝ্ রহে হো না? তানকো বোলো...
চাঘানী দোকানীর চোখটি এবার
নিষ্ঠুর হল। হাতের মুঠোর বাজরা আবার যথাস্থানে রেখে দিয়ে বলল ফকির মিশকিনদের খবরা
খবর রাখা তার কাজ না। মাল কেনার না থাকলে বিবাক এ স্থান ছেড়ে উঠে যাক! নইলে...
হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখল বিবাক
পায়ে চামড়ার ফেল্ট জুতো কোমরে গোঁজা মস্ত শামসের, বৃষস্কন্ধ কানে গালপাট্টা – দুজন মোগল সৈনিক দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তাকে আপাদ
মস্তক নিরীক্ষণ করছে। দুজনেই অতিশয় ধূর্ত। বিবাকও ক্ষিপ্রহস্তে নকাব দিয়ে ফের
মুখচোখ ঢেকে নিয়েছে। সে একদমই চায় না কেউ তাকে দেখে চিনে ফেলুক। তার মন বলে কামরান মির্জার লোকজনেরা গোপনে তাকে নজর রাখে। হতে
পারে এই দুজন কামরানেরই পাঠানো। এসব ভাড়া করা গুন্ডাদের কোনও মায়া মমতা থাকে না। এবং
একবার নির্দেশ পাওয়া মাত্রই অক্লেশে এরা সব ধরনের কাজ করতে পারে। কিন্তু বিবাক
যদ্দূর জানে কামরান মির্জা এখন বন্দী, খুব শীঘ্রই তার বিচার হবে। বিচারে তার কী শাস্তি হয় সেটাই এখন আসল খবর। পরিচিত মহলও এজন্য
উদগ্রীব অবস্থায় রয়েছে। কারন আর কিছু না। মির্জা কামরান হলেন স্বয়ং হুমায়ুন বাদশার
বৈমাত্রেয় ভাই, চেঙ্গিজ খানের অন্যতম বংশধর। ভাইকে বাদশা বরাবর ক্ষমা প্রদর্শন করে
এসেছেন। কোনও দিনই তিনি কামরানের শত ছলনার একটাও বিরূপ জবাব দেন নি। কিন্তু এইবার
তা নাকি আর হচ্ছে না। একে তো হুমায়ুন পুনরায় হিন্দুস্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছেন।
তার ওপর মোগল রাজত্বের প্রধান শত্রু
এবং হিন্দুস্থানের অন্যতম ভাগীদার পাঠান কুলতিলক শের খানের মৃত্যু ঘটেছে। মির্জা কামরান বর্ত্তমানে কাবুলে অধিষ্ঠান
করছেন ঠিকই, কিন্তু মির্জার জন্য শাস্তি একবার বলবৎ হয়ে গেলেই হুমায়ুন বাদশার সেই
হুকুম সঙ্গে সঙ্গেই পালিত হবে। কামরানের ইচ্ছা ছিল সমগ্র হিন্দুস্থানের দখলদারী,
চেঙ্গিজ বা তৈমুরের মত খ্যাতি। কিন্তু বিশ্বজয়ের নেশা এমনই সর্বনেশে যে ভাই ভাই-এর বুকে ছুরি বসাতে দ্বিধা করেনা। ইতিহাসে তার
ভুরি ভুরি প্রমাণ।
বাবুর বলেছিলেন, আফগানেরা
বোধবুদ্ধির ধার ধারে না। তাদের বিচার বুদ্ধি দুর্বল। শত্রু হিসেবেও তারা যথেষ্ঠ
বলবান নয়। বন্ধুত্বের বিধি নিয়মও তাদের জানা নেই। হতবুদ্ধি মির্জা কামরান এই আফগানদের
সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে হুমায়ুনকে বহুবার উৎখাত করতে চেয়েছে। কিন্তু হুমায়ুন
ভ্রাতৃস্নেহে এমনই অন্ধ যে বারবারই তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। কিন্তু বর্ত্তমানে
পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হিন্দুস্থান পুনর্দখল হওয়ার পর সকল মোগল ললনা, আমীর
ওমরাহ, প্রদেশের শাসকগণ এবং যে সমস্ত ছোট বড় প্রজারা কামরানের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত, সকলে তারা বাদশাহকে পরামর্শ দিয়েছে মির্জা কামরানকে আর ক্ষমা করা যাবে না। এই
কুলাঙ্গার আপনার ভাই নন, বরং
মোগল রাজত্বর শত্রু। রাজ শাসনের
প্রশ্নে ভ্রাতৃত্ব গৌণ। যদি ভাই-এর
প্রতি মমত্ব প্রদর্শন করতে হয় তো রাজত্ব পরিত্যাগ করুন, আর যদি রাজত্ব ও সুশাসনই মুখ্য হয়ে থাকে তাহলে ভ্রাতৃত্ব ত্যাগ করুন! এই কামরান মির্জাই আপনাকে একটি রাতের জন্যও কাবুলে বসবাস করতে দেয়নি।
আর একবার গোপনে আততায়ী প্রেরণ করে আপনার মস্তকে তীব্র আঘাত হেনেছিল। মিথ্যা
প্রলোভন ও ছলাকলার মাধ্যমে বহু মোগল আমীরকে হত্যা এবং শেষাবধি এই সেদিন জাঁহাপনার
আর এক ভ্রাতা মির্জা হিন্দালকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে। কামরানের এই অত্যাচারে
চাঘতাই সম্প্রদায়ের লোকজনেরা প্রায় নিঃশেষ। অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠী কলহকে চিরতরে
খতম্ না করতে পারলে জাঁহাপনা প্রজা শাসন করা খুবই মুশকিল হয়ে পড়বে।
মোদ্দা কথা দরবারে উপস্থিত সবাই
এক যোগে দাবি তুলল, কামরান মির্জার শিরচ্ছেদ করা হোক।
জবাবে হুমায়ুন বললেন, এই যদি
তোমাদের সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে এবং এটাই যদি ভালো বলে মনে করো তবে একটা কাগজে তোমাদের
মতামত লিখে দাও!
মুহূর্ত্তে ডানে বাঁয়ে চারিদিকে যেসব আমীর ওমরাহরা ছিল একটা কাগজ কুড়িয়ে তাতে লিখলেন, ‘খুনী এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী মির্জা কামরানের শিরচ্ছেদ করা
হোক’।
এসব ছ’মাস আগের পুরনো ঘটনা।
কামরানকে এখন বন্দী অবস্থায় কাবুলে প্রেরণ করা হয়েছে। কারণ
হিন্দুস্থানের পক্ষে সে অতিশয় বিপজ্জনক। কিন্তু বিবাক নিশ্চিত, কামরানের পক্ষের লোকজনেরা এখনও দিল্লির পথে ঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দামুন্যা
গ্রামের ভিটে মাটিহীন উদ্বাস্তু বিবাককে তারা সহজে ছেড়ে দেবে না। চিনতে পারলেই
ঝকঝকে শামসেরের এক কোপে বিবাকের ধড় ও মুন্ডু আলাদা করে দেবে। হুমায়ুন বাদশা এখন ক্ষমতার শীর্ষে, তাঁর নাগাল
পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু বাদশার কাছে বেমক্কা বায়না করে যে আউলে মত লোকটা দু’ দিনের জন্য দিল্লির মসনদে বসে তামাম
হিন্দুস্থানের বাদশা বনেছিল,
একবার খুঁজে পেলে তাকে জন্মের শোধ তুলে নেবে তক্ষুনি।
বিবাক রাজা সাজতে চায় নি। গোপী
বলেছিল রাজাদের নাকি কানে চোখ থাকে। অবাক হয়ে বিবাক বলেছে, সে আবার কেমন কথা?
তুমি জান না? সম্রাট কান দিয়েই
দেখেন।
ধুত্!
তোমার ভাগ্যে যদি কোনওদিন রাজ
সন্দর্শন ঘটে তো আমার কথাখানা মিলিয়ে নিও!
তবু সেদিন বিবাক গোপীর কথা
কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি। কান আর চোখ দুটো সম্পূর্ণ পৃথক জিনিষ। দুটোর কাজও
পৃথক। সম্রাট কোথায় কদ্দূরে থাকেন তাইই ভাল জানা নেই, তার ওপর আবার তাঁর কান আর
চোখ...!
কিন্তু বিবাকের ভাগ্যে রাজদর্শন
যোগ লেখা ছিল। বোধহয় মুঘল তখতে বসারও দুর্লভ সৌভাগ্য শুধু তার মত উচ্ছন্নে
উণপাঁজুরের কপালেই লেখা ছিল, তা নয়ত গৌড়ে অত লোক থাকতে সেদিন সেই কেন শুধুমুদু নৌকো যোগে পাটনা অভিমুখে যাত্রা করেছিল!
গোপী পরামর্শ দিয়েছিল, সম্রাটের সঙ্গে সত্যিই যদি সাক্ষাৎ করতে চাও তো চলো দুজনে
পাটনা যাই! শুনেছি তিনি নাকি সন্ত্রাসবাদীদের দমন করার জন্য দিল্লি থেকে দক্ষিণ
দিকে রওনা দিয়েছেন।
তুমি সম্রাটকে চেনো?
সন্ত্রাসবাদীদের ঠেকাতে গৌড়ের
বাদশা সম্রাটের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন, তিনমাস আগেকার খবর এটা।
সন্ত্রাসবাদী? এরা কোথ্থেকে এল?
কোথ্থেকে এল তা আমি কেমন করে
বলব? তবে ওরা যে সম্রাটের সঙ্গে গায়ে পড়ে লড়াই করতে চায়, সেটা এখানে সবাই জানে।
বিবাক একমনে শুনছে। গোপী আবার
বলল, ওই যাকে বলে বাদশাহী আদেশ, গৌড়ের
প্রজারা এখন সেই আদেশই কী করে রক্ষে করবে তাই ভেবে সারা
হচ্ছে।
কেন সম্রাট কী আদেশ করেছেন?
সম্রাটের যুদ্ধ বিগ্রহ করার
তেমন ইচ্ছে নেই, কিন্তু যুদ্ধ যদি ঘাড়ের ওপর
এসে পড়ে, তবে তো তাকে আর ঠেলে রাখা যায় না!
বিবাকের বেশ উত্তেজনা হল। যুদ্ধ
হলে সে সম্রাটের পক্ষে। যুদ্ধ কতদিন চলবে জানা নেই, তবে ভবিষ্যতে সুযোগ বুঝে কোনও
একদিন সম্রাটকে নিজের দুঃখকষ্ট জানালেই হল। দামুন্যা বা বাংলাদেশের ছোটখাটো সমস্যাগুলো
সম্রাটের পক্ষে দিল্লি থেকে লাঘব করার তেমন সুবিধে নাও হতে পারে, বিবাক তবু এসব
কথা সম্রাটকেই বলবে। কেননা জমিদার বা রাজার ওপরে আর তার ভরসা নেই।
গোপী বলল, আজ রাত্রেই ভাবছি
রওনা দেব, কি বলো?
ঘোর ভেঙে বিবাক বলল, আমিও যাব।
দক্ষিণের ঠিক কোন জায়গাটায় সম্রাট আসছেন?
বক্সার বলে একটা জায়গা আছে,
সেখানেই নাকি শতাধিক মোগল সৈন্যকে শের শাহ বন্দী করেছেন, সেখানেই সম্রাট তাঁর সেনাদের মুক্ত করতে আসছেন।
মনে পড়ল, তখনও বিবাক মোগল পাঠানের শ্রেণীভাগ জিনিষটা ঠিক বুঝত না। এমন কি হুমায়ুন
সম্রাটের নাম হুমায়ুন এই সাদামাটা জিনিষটাও ছিল সম্পূর্ণ অগোচরে। আকাশের নীল দেখলে
যার, নিচে মাটির ওপরে ঠিক কোন সময়ে কি কি ঘটনা ঘটছে সে সবের খেয়াল থাকে না তার
কাছে মোগল বাদশা হুমায়ুন বা আফগান শাসক
শের শাহ দুইই সমান। কে এল আর কে গেল তাতে কি আসে যায়? তখতে বসলে তখতের মালিকের
কাছে বাকি সবাই বিরোধীপক্ষ। এই দুনিয়ায় অনাদি কালের এইই নিয়ম। তখত্ সিংহাসন এসব বস্তু তাই তার কাছে কেমন হাস্যকর।
তবু বিবাক যেন নিজেরই অজান্তে নিজেকে হুমায়ুন বাদশার দলে কেমন করে দলভুক্ত করে নিয়েছিল। তখন আষাঢ়ের শেষ। গঙ্গার জল ক্রমাগত বাড়ছে। ছোট্ট একটা
পানসিতে বিবাক আর গোপী সেই রাত্রেই পশ্চিম দিকে রওনা দিয়েছিল। আকাশের নিলীমা কম্পমান
গঙ্গাবক্ষ উদভ্রান্ত জীবন, সব মিলিয়ে বিবাক কেমন এক উদাস নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে
সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিল। গোপী তাকে বারবার একটুক্ষণের জন্য জিরিয়ে নিতে
বলেছিল। কিন্তু ঘুমের কথা তার মনেই আসেনি। বেশ কয়েকটা রাত আর দিন তারা দুজনে
গঙ্গার নানান শাখা প্রশাখা বেয়ে এগিয়ে চলেছিল। ক্রমে তারা কনোজের কাছাকাছি এসে
পৌঁছায়। জায়গাটা লোকালয় বর্জিত। অদূরে সারিবদ্ধ পাহাড়, সন্ধ্যার অন্ধকারে সেগুলিকে
আরও ঘনায়মান দেখাচ্ছে। নদীর দু’ তীরেই প্রচুর অনাবাদী খালি জমি। দুজনেরই মন ভাল হয়ে গেল, ঠিক করল এখানেই কিছুদিন
নৌকোবাস করা যাক। কারণ পথে আসতে আসতে এ যাবৎ কোথ্থাও মোগল সেনার ছাউনি চোখে পড়েনি। হতে পারে যুদ্ধ শেষে সম্রাট হয়ত আবার সুদূর দিল্লি
ফিরে গেছেন।
পরদিন সকালে গোপী নদীতে জাল ফেলল। মাছ ধরা হবে। তার
ছোট্ট পানসিতে সবই মজুত। আকাশে ঝকঝকে রোদ্দুর। সেই আলোয় নজরে এল বিশাল এক শবয়ী মাছের দল। চকচকে
আঁশ, গোলাপি পাখনায় ঝিলিক তুলে দ্রুত
পার হচ্ছে। এক মুহূর্ত্ত দেরী করল না গোপী।
প্রায় ঝড়ের বেগে পানসিকে নিয়ে চলল এগিয়ে, বিবাককে বলল, তুই দাঁড় চালা
জলদি!’
কতক্ষণ এমন চলেছিল কারু খেয়াল
ছিল না। হঠাৎ দেখা গেল নদীর জলে
সন্ধ্যের অন্ধকার, ভেসে আসছে পোড়া কাঠের টুকরো। ভর দুপুরে আকাশে কালো ধোঁয়া। কোথায়
মিলিয়ে গেছে শবয়ী মাছের ঝাঁক। গোপী অবাক হয়ে শুধিয়েছিল, কিছু একটা ঘটেছে কোথাও,
তুই কিছু দেখতে পাচ্ছিস?’
না, বিবাক তখনো কিচ্ছু দেখতে
পায়নি। কিন্তু মন যেন কী একটা ইশারা করছে। বৈঠা বাইতে বাইতে পানসিটা দুলে উঠল। এত ধোঁয়া কোথ্থেকে আসছে দেখা
যাক! দেখা গেল ভরা গঙ্গাবক্ষে একটি জীবন্ত মানুষ জলে হাবুডুবু খাচ্ছে। চতুর্দিকে
ইতস্তত ভাসমান মৃতদেহ, রক্তাক্ত অগ্নিদদ্ধ। কী ব্যাপার? কোথাও কি লড়াই বেঁধেছে? গোপীর ধুরন্ধর চোখ তখনও শবয়ী দলকে
খুঁজে বেড়াচ্ছে, ওরই মধ্যে বলল, তাড়াতাড়ি পানসিটা
ওদিকে নিয়ে চল্! লোকটা ডুবে মরতে বসেছে!’
নৌকোয় টেনে তোলার পর দেখা গেল
মানুষটার হাতের আঙ্গুলে তিনটি হীরকাঙ্গুরীয়, আরও দুটি মণিমণিক্য গাঁথা সোনার আংটি।
এক পায়ে জড়ি বসানো নাগরা জুতো, অন্য পাটি জলে তলিয়ে গেছে। পরনে নিমচা জামাহ্, যুদ্ধের পোষাক। পোষাকের প্রান্তে কিছু পোড়া কাঠের
টুকরো ও জলঝাঁঝি আটকে। পাটাতনে ঊঠে মানুষটি তখন ডাঙায় তোলা মাছের মত ধড়ফড়াচ্ছে।
বিবাককে দেখতে পেয়েই বল্লেন, বহোৎ
খুব! তুই কে?’
ততক্ষণে মানুষটির শরীর থেকে
তাজা আপেলের খোশবাই বিবাকের নাকে এসে ঝাপটা মেরেছে। নজরে এসেছে দুধসম পেলব পায়ের
দুটি পাতা। আঙ্গুলগুলি যেন সদ্য ফোটা ফুলের পাপড়ি। ঘরে তৈরী টাটকা ঘিয়ের মতই তাদের
বর্ণ। মুগ্ধতার সেই শুরু। কে ইনি? ইনি
মানুষ না কোনও ফেরেস্তা?
মানুষটি ততক্ষণে চোস্ত চাঘতাই
তুর্কীতে বলে চলেছেন, আমার সৈন্যরা বোধকরি কাছে পিঠেই আছে। তোর নাম কী?
গোপী থমকে গেছে। তার মস্তিষ্ক
সব ছেড়ে এখন এই মানুষটির প্রতি সজাগ। এনার চোখের মণিদুটি ঘোর নীল বর্ণ, মুখাবয়বে স্বর্গীয় সুষমা...
ফিসফিস করে গোপী উচ্চারণ করল,
জাঁহাপনাহ্!
ইতিমধ্যে পশ্চিম দিকটায় প্রবল
মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কী
উত্তর দেবে বিবাক ভেবে পেলনা, কোনও ক্রমে বলল, এজ্ঞে এদিকটায় এসে ভালো করে বসুন!
পেছন থেকে গোপী কোনক্রমে তুতলে
বলল, হুজূরে আলম্! ভগবানকে অসংখ্য
ধন্যবাদ যে আপনি প্রাণে বেঁচেছেন!
এক জায়গায় প্রচুর ফুল বিক্রী
হচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে বিবাক ফুলমালীর সামনে এসে দাঁড়ালো। জায়গাটা সুগন্ধে ভরপুর।
বিবাকের মাথার মধ্যে অতীত বর্ত্তমান ভবিষৎ সব ঘুলেমিলে ঘুমঘোর। যদিও বাজারের এ
তল্লটটায় এত মশাল জ্বেলে রাখা হয়েছে যে রাত্তির বলে মনেই হয়না। ভিড়ের মাঝে একজন
পর্তুগীজ ধীরেসুস্থে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যমুনা এখান থেকে খুব দূর নয়। ঠান্ডা একটা বাতাস বইছে সেইদিক থেকেই। সেই বাতাসের মধ্যে বিবাকের বালিঘড়ি বালি মিশে। নাহ্
বাজারের এত ভিড়ে আজও সে গোপীকে খুঁজে পেল না। বুক খালি করে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে
এল।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন