গুস্তাভিয়া
এক দু’ ঘন্টা নয়, একেবারে সাত ঘন্টা লেট! সুমনা বারবার বলে দিয়েছিল পৌঁছে একটা ফোন করতে,
ট্রেন রাইট টাইম হলে এতক্ষণে পৌঁছে স্নান খাওয়া সেরে একঘুম হয়ে যেত। ফোন করবে কী?
নেটওয়ার্ক থাকলে তো! তিথি বিরক্ত হয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়ায়। কিছু লোক আছেন ট্রেনে উঠেই বেশ সংসার পেতে ফেলেন। ছড়িয়ে বসে কমলালেবু থেকে বাদাম মুড়ি, শনিমন্দির থেকে ক্যাটরিনা সব এনাদের নখদর্পণে। এরা নিজেদের নিয়েই সবসময় বিভোর লেট বা রাইট টাইম নিয়ে এদের মাথাব্যথা নেই একসময় পৌঁছলেই হলো। তিথির সামনের সিটে বসা পরিবারটি হলো তাই। ভদ্রলোক একটি বারমুডা পরে ঘাড়ে টাওয়েল ঝুলিয়ে কম্পার্টমেন্টের এমাথা ওমাথা ব্যস্ত হয়ে ছুটেই চলছে সেই সকাল থেকে। হাতে একখানা ব্রাশ। গিন্নি বোন আর ভগ্নিপতি মিলে জবর আড্ডা। বাচ্চাগুলো প্যাঁ প্যাঁ করে কাঁদছে, রেলিং ধরে ঝুলছে।
ইতিমধ্যে বারমুডা আর ঘাড়ে টাওয়েল জানিয়ে গেল সামনের অবরোধ, ট্রেন আরো ঘন্টা চারেক দাঁড়াবে। ডি আর এম আসবেন কী কী দাবী আছে সেগুলো মেটাতে হবে। সামনের সিটের তেমন কোনো উদ্বেগ প্রকাশ পেল না, বরং আরো জাঁকিয়ে বসে গল্প শুরু করলো। বিরক্ত মুখে তিথি এগিয়ে গেল দরজার দিকে। প্লাটফর্ম জুড়ে লোকের আনাগোনা। বেশিরভাগই এই ট্রেনের প্যাসেঞ্জার। মওকা বুঝে ফে্রিওয়ালাদের
ভিড় বাড়ছে। চা, কফি, পান বিড়ি থেকে বিস্কুট কেকের প্যাকেট, পুরি সবজি আবার থালায় জবাফুল সিঁদুর মাথা মাকালী। পায়ে পায়ে নেমে দাঁড়ালো তিথি। স্টেশনের পাশে একটা খুব চেনা গাছ... অপূর্ব ফুল ফুটে আছে, কী যেন নাম!
এক ঝলকে মাথায় বিদ্যুৎ খেলে গেল, গুস্তাভিয়া! সচরাচর এই বাংলায় দেখা যায় না। তিথি ধীর পায়ে এগোলো গাছটার দিকে।
গাছটার আশেপাশে আর কোনো গাছ নেই। ওই দূরে ধানক্ষেত ধানকাটা সবে শেষ হয়েছে। দূরে মেঠো আলপথে সাইকেল চেপে দু’ একজন। ঠিক যেন কোনো বাংলা আর্ট ফ্লিমের দৃশ্য। হেমন্তের রোদ বেশ মিঠে লাগছে তিথির। গাছের ডালে অসংখ্য পাখির কলরব। টুপ করে একটা ফুল খসে পড়ল তিথির গায়ে।
গড়পঞ্চকোট! হ্যাঁ সেখানেই গাছটা প্রথম আবিষ্কার করে রোহণ। ভোর ভোর তিথিকে টানতে টানতেই গাছটার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন এভাবেই তিথির গায়ে মাথায় ফুল ছড়িয়েছিল গুস্তাভিয়া। চা ওয়ালার ডাকে চমক ভাঙে তিথির। ওই দূরে ও কে! একমনে গুস্তাভিয়ার ফুলের দিকে তাকিয়ে! টাক পড়েছে মাথায়, মধ্যপ্রদেশ স্ফিত, চোখে চশমা এসেছে অথচ ঘাড় উঁচু করে দাঁড়ানোর ভঙ্গী একদম একই আছে এখনো। তিথির সামনের চুল অনেকটাই পাতলা, ডাবল চিন, মেঘে মেঘে বেশ বেলা গড়িয়েছে। হঠাৎ হুইসেলের শব্দে চমকে তাকায় দুজনে দুজনের দিকে। ট্রেন এবারে চলা শুরু করবে। একই ট্রেনের দুই প্রান্তে দুজন নিঃশব্দে উঠে যায়। ট্রেন চলা শুরু করেছে। স্টেশনে একলা গুস্তাভিয়া আস্তে আস্তে সরে যায়।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন