কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

কবি মৃণালিনীর সাক্ষাৎকার




সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি সুবীর সরকার






** কবিতা লেখার শুরুর দিনগুলির কথা কিছু বলুন।

**** কবিতা লেখার দিনগুলো কথা যদি বলি তাহলে গল্প উপন্যাসের কথাই সবার আগে এসে পড়বে। ছোটবেলা থেকেই গল্পের প্রতি এক অদ্ভুত টান অনুভব করতাম, কিন্তু শেষ হয়েও হইল না শেষমনের মধ্যে অসমাপ্তির অনুরণন চলতে  থাকত যার ফলশ্রুতি উপন্যাসের প্রতি ঝোঁক। ছোটগল্প বা উপন্যাসে যে ভাব বা বিষয় ব্যক্ত হতে অনেকটা সময় লাগে, তা হতে পারে চার-ছয় লাইনের পংক্তির  মধ্যে। এই ভাবনা থেকেই বলতে পারেন একটি বিস্তৃত ঘটনাকে কয়েকটি পংক্তিতে  বেঁধে নিজের মনের ভাব পাঠকের কাছে পৌঁছে দেবার উদ্দ্যেশে আমার কবিতা লেখা শুরু।

** আপনার বাল্যকাল, বাবা মা দাদা ও বোনের কথা শুনতে চাই। কেননা আপনার পরিবার তো বরাবরই সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চাকে ধারণ করেছে বলেই জানি?

**** হ্যাঁ এ কথা একশো শতাংশ সত্যি। আমার পরিবার বিশেষ করে আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি বাবাকে পড়াশোনা, যে কোনো বিষয়ে  জ্ঞানচর্চাকে সব কিছুর ওপরে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু এটাও সত্যি ছোটবেলা থেকেই বাবা ও মা-কে  অসুস্থ অবস্থায় দেখেছি। বড় হয়ে উঠেছি দাদাভাই ও দিভাইয়ের কোলে। বৌদির  মমতাভরা স্নেহে। আর পরী (দাদার মেয়ে) বাবার অবর্তমানেও বর্তমানে মৃণালিনীর চালিকাশক্তি।




** লেখালেখি করতে এলেন কেন?

**** বিশেষএকটি উদ্দেশ্য নিয়েই লেখালেখির জগতে এসেছি। কাব্য যেখানে মোহময়, তার বিপরীত পিঠে যন্ত্রণাময় গদ্য। প্রাত্যহিক জীবনের চোখে দেখা  গুরুত্বহীন বিষয়গুলোকে কবিতা ও গদ্য ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরবার একটা সামান্য প্রচেষ্টা বলতে পারেন।

** আপনার কবিতায় অদ্ভুত এক নিরাসক্তি আছে। খুব শান্ত করে কথা বলেন আপনি। ব্যাক্তি মৃণালিনীর মতন কবি মৃণালিনীর কবিতায় হেমন্তের রোদের স্নিগ্ধ উজ্বলতা! বড় মায়াবী কাব্যভাষা আপনার! কিছু বলুন!

**** “যন্ত্রণা বিষণ্ণতা ঘরে বাস্তুঘুগু উঠোনে / আমার শব্দাবলী মৃদুস্বরে ব্যর্থ কষাঘাতে।
আমার তো মনে হয় আমার  কাব্যভাষা নিয়ে আমার থেকে পাঠকেরাই বেশি ভালভাবে বলতে পারবেন।

** কবিতায় তত্ত্বের প্রভাব ও গুরুত্ব কতখানি?

**** কবিতা কবি মনের ভাব বা সুপ্ত চেতনার বহিঃপ্রকাশ। নির্জন মনের সাধনা। কিন্তু তাই বলে কবিতা একেবারে বাস্তব বিমুখ নয় বরং বাস্তবের কল্পচিত্র। কবি মনের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল। তিনি সমাজ ও বাস্তবকে কীভাবে দেখবেন এবং কীভাবে তাকে ব্যক্ত করবেন। নজরুলের কবিতায় বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ যেমন আছে,  তেমনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার তত্বের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক কালের কবিদের কবিতার মধ্যেও ভাবের ঘোরের সঙ্গে শুধু তত্ত্ব নয়, সমকালও ফুটে উঠেছে বিভিন্ন ভাবে, প্রতীকে, নিজস্ব আঙ্গিকে।



** পোষ্টমর্ডানিজম নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে চাই। 

**** আধুনিকতা ছিল কেন্দ্র সম্পর্কিত কথা, অর্থাৎ ফোকাসটি অস্পষ্ট হলেও তার কার্যকারণ বোঝাটা ছিল সহজ। উত্তর আধুনিকতায় যেহেতু মানুষের জীবন হয়ে উঠল জটিল এবং বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী টিকে থাকার লড়াই যেহেতু বেড়ে গেল, এই পর্বে বলা হল ভাঙচুরের কথা - অর্থাৎ কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এসে প্রান্ত ব্যবহারের কথা।
পোস্ট পোষ্টমর্ডানিজম বাংলা সাহিত্যে এক সময় যেভাবে প্রভাব ফেলেছিল তার  রেশ কিছুটা হলেও যে আছে এবং দিন যাবার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের জটিলতা আরও  নতুন কিছুর জন্ম দেবে। তবে পুরনোকে ভুলে বা তার থেকে শিকড় ছিন্ন করে  কখনোই নয়। সময়ের প্রয়োজনে।

** কার কার লেখা পড়ে শুরুর দিনগুলিতে প্রাণিত, তাড়িত হয়েছেন?

**** একথার বোধহয় সবার কাছে একই উত্তর - স্কুল জীবনে মধুসূদন দত্ত, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ, জীবনানন্দ দাস, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, নীরেন্দ্রনাথ  চক্রবর্তী। এছাড়াও নিজের ভাললাগা কিছু কবির লেখা পড়ি যাদের মধ্যে রয়েছেন  নবারুণ ভট্টাচার্য, জয় গোস্বামী, সুনীল-শক্তি, সুবোধ সরকার, মলয় রায়চৌধুরী,  নবনীতা দেবসেন। ভাললাগে বিনয় মজুমদারের লেখা।

** বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা কী? কবিতার আগামীর ভবিষ্যত কী?

**** বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা বর্তমানের অব্যক্ত যন্ত্রণাকে কবিতায় প্রকাশ করা। সময়কে বাদ দিয়ে কোনো সাহিত্য রচিত হতে পারে না। কবিতার  আগামী ভবিষ্যত বর্তমানের ওপর নির্ভরশীল - তবে কেউ কেউ ভিন্ন ধারার কবিতা লিখছেন।

** কবিতা লিখতে এসে আপনার চারপাশ থেকে কী প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?

**** এক কথায় বলতে গেলে প্রচুর ভালবাসা, স্নেহ, আশীর্বাদভবিষ্যতের জন্যে শুভেচ্ছা ও অনুপ্রেরণার সঙ্গে  প্রকৃত উদারমনোভাবাপন্ন মানুষের সৎ পরামর্শ। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখলেও ফেসবুকের সাদা পাতায় লিখে এত মানুষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছি যে, তাদের পত্রিকার জন্যে তাদের মন রাখতে অনেক লেখা লিখতে হয়। কেউ কেউ অনুরোধ করে তাদের মনের  কথা ভাষায় প্রকাশ করবার জন্যে - একটা কবিতা লিখে পোস্ট করবার  জন্যে। আমিও ব্যকুল হয়ে পড়ি আমার ফেসবুক পরিবারের অনুরোধ রাখাবার জন্যে। আর নিজের যে কাজটি শুরু করেছি, তার গতিবেগ ক্রমশ স্লোহয়ে যাচ্ছে। যেহেতু আমার পক্ষে সবসময়  সাহিত্যের অনুষ্ঠানগুলো এটেন্ডকরা হয়ে ওঠে না। তাই জনপরিচিতিও তেমন  একটা নেই। তাই চেষ্টা করি আমার লেখাই যেন আমাকে উপস্থাপিত করে সকলের সামনে।



** তরুণদের লেখা নিয়ে কী বলবেন?

**** ‘তরুণএই শব্দটির অর্থ আগে পরিষ্কার হওয়া উচিত। বয়সে তরুণ হলে  তাদের জন্য বলব, নিজের ভাললাগার বিষয় কবিতা বা সাহিত্যের যে কোনো ভাগ তা নাটক, কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প হতে পারে - সেই বিষয় নিয়ে নিজের মনে লিখে যাওয়া।  কিন্তু তরুণবলতে যদি ১৮-৬০ বছরের মধ্যে কেউ হয়ে থাকে, যে ইদানিং নিজের লেখা ছাপতে এসেছে  চিরাচরিত প্রথা বা সাহিত্যের অভিধান অনুযায়ী, তাদের তরুণবলতে আমি নারাজ।

আসলে একটা কথা আমরা চাইলেও এক ব্যক্যে অস্বীকার করতে পারব না। পারব না এর জন্যে যে এদের মুখোশগুলো  ধীরে ধীরে সবার সামনেই উন্মোচিত আগেও হয়েছে, আর এখনও হচ্ছে।  কিছু বিখ্যাত কবি-সম্পাদক (পাকা ব্যবসাদার) তারা বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত থাকায় সুযোগে তরুণশিরোনাম দিয়ে কিছু  নতুন চেহারা যেন একপ্রকার জোর করেই হয়তো বা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই কান  টেনে তুলে ধরে প্রমাণ করবার চেষ্টা করছেন, ‘ইনি একজন অসাধারণ কবি। আমি  মাঠে-ঘাটে ঘুরে ঘুরে এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা হীরক দ্যুতি খুঁজে পেয়েছি।প্রকৃত হীরে স্বকীয় প্রতিভায় উজ্জ্বল, আর আমার মনে হয়, পাঠক সঞ্চালকের কথার থেকে কবির কবিতা পড়তে শুনতে বেশি ভালবাসে। আর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হল, সকলের প্রিয় জীবনানন্দ ও বিনয় মজুমদার। সাহিত্যের নামে লবি আগেও ছিল, এখনও আছে, আর যতদিন এই ব্যবসাদার কবি-লেখক-লিটিল ম্যাগাজিনের  সম্পাদক হিসেবে বাবাজী-মাতাজীরা বিধান দেবেন, কে কবি আর কোন লেখাটা কবিতা বা অকবিতা, ততদিন বাংলা সাহিত্যে সদ্য লিখতে আসা তরুণনয়, বাংলা সাহিত্য বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে তরুণ হিসেবেই থেকে যাবে।

** আপনি গদ্যও তো লেখেন। উপন্যাস লিখছেন কি? পরবর্তী উপন্যাস কী  ভাবছেন?

**** কবিতা ছাড়াও মুক্তগদ্য লিখে থাকি। কোনো ভালো পত্রিকা বা বই পেলে রিভিউও করে থাকি। ছোটগল্প ও অণুগল্প লিখেছি বেশ কয়েকটি। প্রায় বেশির ভাগ প্রিন্টেড পত্রিকায়, মাসিক সংবাদপত্রে নিয়মিত ছাপা হচ্ছে। কিছু কবিতা গল্প অনলাইন ম্যাগগুলোতেও ছাপা হচ্ছে। বাতিলের একটি দিন’ (২০১৭ কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল) কিছু সমস্যার জন্যে আবার এই বছর বইমেলায় দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপা হচ্ছে। পরবর্তী উপন্যাস নিয়ে এখনও কাজ চলছে।




** আপনার কবিতায় নিরুচ্চার এক বিষাদবোধ রয়েছে। একাকীত্বের অতলান্ত হাহাকার টের পাই। কী বলবেন এই নিয়ে? কোনো কষ্টবোধ?

**** আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর বোধহয় আমার পরবর্তী উপন্যাস শ্রীচরণেষু’-র মধ্যেই পেয়ে যাবেন।

** তথ্যপ্রযুক্তি আপনাকে লেখাপড়ায় কীভাবে সাহায্য করেছে?

**** তথ্যপ্রযুক্তি জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। অনেক প্রয়োজনীয় তথ্য ছাড়াও এখনকার অনেক ভালো কবি-লেখকদের লেখা নেট থেকে সহজেই পাওয়া যায়।

** আপনার স্বপ্ন, আগামী পরিকল্পনা?

**** আমার স্বপ্ন? আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বপ্ন নেই, যদি কিছু করবার থাকে  তা হল পরিবারের স্বপ্নপূরণ। আর লেখা যেহেতু আমার শখ, বলতে পারেন নেশা ও পেশা দুটোই। সেক্ষেত্রে  একজন সৎ কবি-লেখিকা  হিসেবে আজীবন লিখে যেতে চাই।

** আপনি মাঝে মাঝে অসুস্থ থাকেন বলে শোনা যায়। বলতে বিশেষ আপত্তি না থাকলে বলবেন আপনি কি কোনো সিরিয়াস রোগে ভুগছেন?

**** দেশ স্বাধীন হলেও নারী কিন্তু আজও পরাধীন, এই সহজ কথাটি কি  অস্বীকার করবেন? হয়তো না। নারী প্রতিদিন প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে যেমন বাড়িতে, ঠিক তেমনই কর্মক্ষেত্রে। আমি নারীবাদী নই, নই পুরুষ বিদ্বেষী। কারণ  একটি নারীর নির্যাতনের পেছনে পুরুষ থাকলেও  ঘটনাকে  যদি তুলোধূনো করে বিচার করা হয়, দেখা যাবে সমস্ত ঘটনার পেছনে কাজ করছে একটি নারীরও  মায়া-মমতাহীন রিরিংসা আগ্রাসী মনোভাব। প্রতিদিন নিজের কর্মক্ষেত্রে  নানারকম  ভাবে মানসিক নির্যাতন সহ্য করে ক্লান্ত হইনি বরং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি।  দেখেছি বাড়িতে দেখা, ইতিহাসে পড়া, বইয়ে পড়া নারীর কী বীভৎস রূপ! মিথ  ভেঙ্গে নারীর বিচিত্র ও বৈচিত্র্য দেখে দেখে আর রোজ নতুন ধরনের problem suffer করতে করতে ক্লান্ত। আর এই ক্লান্তিতেই মাঝে মধ্যে নারী-পুরুষ-সমাজ- দেশ-বিশ্ব সংসার নিয়ে এক অদ্ভুত ধারণার জন্ম দেয় - “give and take” neither “break down.”



                                                                                                 




1 কমেন্টস্: