চারজনের গল্পপাঠ
: আমার নাম লেভ নিকোলায়েভিচ্
কাঊন্ট টলস্টয়। ১৯১০ সালের নভেম্বরের এক মধ্যরাত্রিতে তাপমাত্রা যখন হিমাঙ্কের অনেক নিচে, তখন
নিরুদ্দেশ হই। রহস্যময় এই গৃহত্যাগ সম্পর্কে অনেকে
বলেন, টলস্টয়ান আদর্শবাদের গোঁড়ামি আমাকে আমার
পরিবার, দেশ ও সময় থেকে বিচ্ছিন্ন করেছিল। হবে
হয়তো, ঠিক জানি না। কিন্তু মানুষের ব্যক্তিগত সামাজিক ও সাহিত্যিক জীবন ঠিক কেমন হওয়া উচিত,
সে সম্বন্ধে সতেরো বছর বয়স থেকেই নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আর নৈতিক শুদ্ধতা অর্জনের উপায় রোজ ডায়রীতে লিখে রাখতাম। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা অর্ধসমাপ্ত রেখেই গ্রামের বাড়ি ইয়াস্নায়া
পলিয়ানায় ফিরে চাষার ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল খুলে তাদের পড়ানো, হদ্দ গরীবদের মতো
জুতো জামা পড়া, তেরেক নদীর ধারে কসাকদের সঙ্গে কিছুদিন কাটানো এবং এসবের সঙ্গে অজস্র ছোটগল্প লিখে চলা। সমাজ একটু নড়ে বসল।
তারপর যখন ‘যুদ্ধ ও শান্তি’ লিখলাম, ‘আন্না
কারেনিনা’ লিখলাম, বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হলো সেগুলো। নাটক লিখলাম, ‘অন্ধকারের ক্ষমতা’, নিষিদ্ধ হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। উৎসাহ পেয়ে আরো কতগুলো ছোটগল্প লিখে ফেললাম। প্রবন্ধ লিখলাম। ১৯০০ সাল, গোর্কির সঙ্গে দেখা হলো। দুজনের কথা আর ফুরোতেই চায় না! চার্চ ধর্মত্যাগী বলে
ফতোয়া দিল। তখন ভাবলাম আর কী করা যায়! শেষে সাউথ আফ্রিকায় একটা ফার্ম হাউস খুললাম, উদ্দেশ্য নন ভায়োলেন্স তত্ত্বটাকে
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেব। হাতেনাতে
ফল পেলাম। একটি তরুণ রাতারাতি আমার ভক্ত বনে গেল। সদ্য ওকালতি পাশ করেছে। বড় লাজুক। নাম বলল, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। কিন্তু মনে
তখনও খুঁতখুঁত, অদৃশ্যের হাতছানি।
পালালাম ঘর ছেড়ে বিরাশি বছর বয়সে।
: আমার নাম রবার্ট ফ্যালকন স্কট।
কী করে হারিয়ে গেছিলাম, জানতাম না। কম্পাস কাজ করছিল না, খাবার নেই, জল নেই। প্রবল
তুষারঝড়। সময়টা
১৯১২ সালের মার্চ, তাপমাত্রা মাইনাস চল্লিশ। পায়ের নিচে আদিগন্ত বার্ডমোর গ্লেসিয়ার, তার নিচে বিস্তৃত এক মহাদেশ অনন্ত
ঘুমে আচ্ছন্ন। জায়গাটা ৮৭° ৩৪’
সাউথ। উত্তরে
আমাদের প্রিয় জন্মভূমি ইংল্যান্ড। সভ্যতার আগুন জ্বালিয়ে আত্মীয়স্বজনরা অপেক্ষা করছে
সেখান। যদিও প্রথম আন্টার্কটিকা অভিযানের উত্তাপ এখন
সঙ্গে নেই। সেটা ছিল ১৯০১ সাল। লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি, রয়্যাল জিওগ্রাফিক সোসাইটি, হিজ
হাইনেস সপ্তম এডোয়ার্ড - কে না সাহায্য করেছিল তখন! সবাই
সবাই। কিন্তু
পোল পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি। মাত্র ৮৫০ কিমি বাকি রয়ে গিয়েছিল। পথের দেবতা তাই আবার ডাকলেন। দলের মধ্যে লরেন্সের ইচ্ছেটা সবার আগে হলো। ততক্ষণে ওর পায়ের পাতা আর আঙ্গুল বরফে খেয়ে নিয়েছে। টলতে টলতে আমাদের ছেড়ে এগিয়ে গেল ও। বলল, যাই বাইরে
থেকে একটু ঘুরে আসি। ওর শেষ বক্তব্যগুলো ডায়রীতে
নোট করে নিলাম, কারণ আজ এ দায়িত্বটা শুধু
আমারই। দ্বিতীয় এই সফরের হোতা একা আমিই, কারণ ইংলন্ড জানত স্কটের পোল ম্যানিয়া হয়েছে।
: আমি ছন্দা গায়েন। ২০১৪ সালে ২০শে মে কাঞ্চনজঙ্ঘা ওয়েস্ট থেকে ফিরতি পথে
নিখোঁজ। বেস ক্যাম্পে কো-পার্টনাররা ছিলেন, তার আগে সবাই মিলে মূল কাঞ্চনজঙ্ঘা
বিজয় পর্ব সেরে ফেলেছি। শুধু শেরপা দুজন দাওয়া ওয়াংচু আর মিংমাকে নিয়ে ওয়েস্টে
রওনা দিই। কী করব! তুষারপাত, পাহাড়, ক্রীভাসেসের মতো মৃত্যুফাঁদ, এসবের সঙ্গ না
করলে আমার বেঁচে থাকা ড্যাম্।
এভারেস্ট জয় করেছিলাম ২০১০এ। দলে তেরোজন
সদস্যের মধ্যে একমাত্র মহিলা। তারপর লোটস্, যোগিন ১ ও ২, ফালুট,
গঙ্গোত্রী কিচ্ছু বাদ দিই নি।
চুরমুর শব্দে নীলচে সবুজ বরফ ডিঙিয়ে তরতর করে উঠে গেছি। আর এখন জম্পেশ শুয়ে আছি ২৭৫ ফিট বরফের নিচে। ধোঁয়াধার হিমানী সম্প্রপাতের এক ধাক্কায় তীক্ষ্ম
ফাটল দিয়ে বহু নিচে এবং উপরিভাগ কঠিন তুষার স্তূপে বন্ধ। ড্রাই আইস।
গ্লেসিওলজিস্টরা বলেন, মোটামুটি একশো বছরে কোনো হিমবাহ গলে নিম্নগামী হয়। দেখা যাক, তেমন কোনো স্রোতের সঙ্গে...
: আমি শুভ্রা চ্যাটার্জী। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্টব্যাচ। ছোট ননদের বিয়ের সময় পঞ্চাশজন অতিথির রান্না একাই রেঁধেছিলাম। নিজের নিখোঁজ হবার গল্পটা এত গুছিয়ে বলতে পারব না। কারণ ওটা সমাজ, পরিবেশ এবং নিজস্ব মানসিক পর্যায় মারফৎ বহু বিভক্ত ও
উড়ালময়। হারিয়ে যাওয়ারও একটা প্রস্তুতি থাকে, গোপন। নিজের কাছেও। যারা হারিয়ে যায়, বাকিদের কাছে তারা বড়
লায়াবিলিটি। কেন
হারিয়ে গেল, কারণ খুঁজে বের করতেই হবে। আমি তাই হারিয়ে যাব বলে নিশুত রাতের কোনো ফাঁকা ট্রেনে উঠে পড়িনি। বরং ভালো মন্দ সবদিক ছাঁটাই করে ইচ্ছেমতো
নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিয়েছি টানা ৫০ বছর। ২০০৪। অমাবস্যার
গভীর রাত। কোনো এক রেলস্টেশনে ভিখিরি
উদ্বাস্তুদের সঙ্গে ধুলোর ওপর শুয়েছিলাম। কানে এলো - ‘গুরু গুরু গুরু গুরু ঘনো মেঘো বরষে...’
কবে কোন্ কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে
আমি তখন পুরুষবেশী চিত্রাঙ্গদা।
উঠে পা বাড়ালাম।
শনাক্তকরণের অভাবে আমার শব মেডিকেল স্টুডেন্টদের জন্য
তুলে রাখা হয়েছিল।
ঋণ স্বীকার : মলয় রায়চৌধুরী
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন