ধারাবাহিক
উপন্যাস
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
যে চিঠি অতিশূন্যতাকে পড়তে
(১৪)
-শিলালিপির জন্য আমাকে নিতে হয়েছিল খরোষ্ঠি।
গান্ধারের দিকে এই লিপিই চলত। এদিকে চলত ব্রাম্ভী।
-ব্রাম্ভী বলছ কেন? ব্রাহ্মী
নয় কেন?
-ব্রাম্ভীই তো প্রাকৃত নাম। এবং প্রকৃত নাম। রাজা
ঋষভ তাঁর কন্যা ব্রাম্ভীকে শিখিয়েছিলেন এই লিপি। তাঁর নাম থেকে এই লিপির নাম
ব্রাম্ভী।
-ঋষভ রাজা? মানে প্রথম জৈন
তীর্থঙ্কর?
-অযোধ্যার রাজা হে! যে অযোধ্যায় রাম জন্মেছে বলে এত মারামারি চলে।
-সবাই অযোধ্যা নিয়ে মারামারি করেই বা কেন?
-সহজ করে বোঝো। এই অঞ্চল এক সময় ছিল জ্ঞানচর্চার এক
বিকল্প কেন্দ্র। আরো পশ্চিমে যখন বেদবাদীরা দাপাচ্ছে তখন এখানে ওই বেদ অপৌরুষেয়
হ্যানো ত্যানোকে গুলি মেরে নতুন নতুন কাজ হচ্ছে। সাংখ্য থেকে শুরু করে সব
অনিশ্বরবাদী দর্শন এখানে এসে মিশছে। জৈনরা তাদের প্রথম তীর্থঙ্করের জন্ম যদি এখানে
বলে তাহলে হিন্দুত্বের আইকন যে রাম তাকেও তো এখানেই জন্মাতে হবে নাকি? যতই পশ্চিমারা মধ্যের দিকে সরে এসেছে ততই তাদের মধ্যস্থলেই নিজেদের দাপট
দেখাতে হয়েছে। সুতরাং রামকেও এখানেই জন্মাতে হবে। নইলে টক্কর সমানে সমানে হচ্ছে
না।
-হুঁ!
-এত ভাবার কিছু নেই। আমার সময়ে কম স্তুপ তৈরি হয়েছিল বৌদ্ধ
আর জৈনদের! সে সব কোথায়? যা মাটিতে মিশেছে সে
বাদ দিলেও যা থেকেছে তার কত কত শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত এমন নানা মন্দিরে পাল্টে যায়নি?
-তা গেছে। দেখেছিও এমন কিছু।
-আমি কিন্তু এ হতে দিইনি। কাউকে কারোরটা দখল করতে
দিইনি। বারাবারের পাহাড়ে যাও, এখনো দেখবে পাশাপাশি সব গুহা।
বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক সবার জন্য।
-ব্রাহ্মণদের?
-তারা তো ভূস্বামী। তারা তো
গো-ধনের অধিকারী। তারা কোন্ দুঃখে মরতে যাবে
গুহাতে?
-ঋষিরা তো যেতেন।
-সে সব লোকের সংখ্যা অতি কম চিরকাল ছিল। এই বৌদ্ধ,
জৈনদের মধ্যে সারি সারি বিত্তবান লোক ছিল না? তারা
যেত নাকি গুহাতে থাকতে? আর এই ঋষিদের মধ্যেও যাঁরা অর্থবান
এবং রাজার দরবারে দাপুটে হয়ে উঠতেন তাঁরাও কেউ গুহায় থাকতেন না। জমিজমা, গরু-মোষ, শিষ্য-টিস্য নিয়ে জমিয়ে বসতেন।
-যাক গে! লিপির কথায় আসি। ওখানে খরোষ্ঠি এখানে
ব্রাম্ভী কেন নিলে?
-ওদিকটা - ওই গান্ধার - অনেককাল ধরেই যে পারসিক নয়
গ্রীকদের হাতে। ওদের ওখানে অ্যারামিক থেকে আসা খরোষ্ঠিই চলত। সুশাসন করতে হলে যার
যে ভাষা তাকে সে ভাষাতেই বোঝাতে হয়।
-এই লাইনটাকে বাড়ালেই কিন্তু চোখ রাঙানিকে চোখ
রাঙানি দিয়েই থামাতে হয় চলে আসে।
-হা হা হা হা হা!
তীব্র স্বরে হেসে উঠলো সুনীল। আশপাশ থেকে কিছু পাখি যেন
ডানা ঝাপটে উড়ে গেল শূন্যে।
-আমাকে বারেবারে মনে করাতে চাও আমি চণ্ডাশোক। যতই
শাসন করি না কেন আমি হন্তারক, এই তো?
-না মনে করালে তুমি আর পট আঁকবে না সুনীল। মনে আছে
আশির কথা? ছবি আঁকা ছেড়েছুড়ে তুমি তখন মত্ত মূলবাসীদের
অধিকার অর্জনের লড়াইতে। ঝাড়িখণ্ড চাই-ই চাই। মনে আছে?
তাকালো আমার দিকে একবার। তারপরে কিছু বলতে গিয়েও ঘুরিয়ে নিল
মুখ। সুনীল পটুয়া আকা করিম সাহাবুদ্দিন। মূলবাসী এবং মুসলমান। এবং ধর্ম নিয়ে মাথাই
ঘামায় না। বললে বলে,
-বর্ণহিন্দুদের অত্যাচারে মুসলমান হয়েছিল
বাপ-দাদাদের কেউ। কিন্তু আমি তো শবর। আমি দৈত্য। জগন্নাথের মন্দিরে দৈত্যপতি হওয়া
ছাড়াও কাজ আছে আমার। আমি সেই গুহায় পাথরের পূজারী। যে পাথর আসলে নীলমণি। বৈষ্ণব
রাজার লোভ যাকে কেড়ে নেবে বলে আমি নষ্ট করে ফেলেছি। রাজা তখন অধিকার পেতে মন্দির
বানালো। ধর্ম না, ঈশ্বর না, স্বপ্নাদেশ
না, আসলে ওড্র দেশের অধিকার। ভেবে দেখ, ওই এক জগন্নাথ প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে, শবরদের দৈতপতি
করার মধ্যে দিয়ে গোটা ওড়িশাটা কেমন হিঁদুয়ানির আখড়া হয়ে গেল। বৌদ্ধ মহাস্তুপের উপর
দাঁড়িয়ে পড়ল শঙ্করের মায়াবাদ। আরে
ও তো সেই বৌদ্ধ নাগার্জুনের শূন্যবাদই, জামা পাল্টে এলো মাত্র। দেখ দেখ হে লেখক, দেখ
দেখ। বৌদ্ধ দমাতে বৌদ্ধের দর্শনটাই হিঁদু কর্যে লিল, বৌদ্ধের
স্তুপ লিইয়ে লিল হে! হামারদের
ক্ষেঁপা শূয়ারের মতো তাড়াই তাড়াই লিয়ে এলে এই ঠেঙে। হাঃ,
ই তুমার কেমন ধরম? লাও শালো, কুড়হালি লাগাই দিই উয়ার...
সুনীলের ভাষা ভাঙতে থাকে। বেরিয়ে আসতে থাকে চণ্ডাশোক।
এই জন্য আশির কথা বলেছিলাম। মেদিনীপুর থেকে ঝাড়খণ্ড চলে
গিয়েছিল সুনীল একা। যুবতীর সঙ্গে তার দেখা হবে। হয়নি তখনো। বাড়ির কেউ ঠেকাতে
পারেনি। আগুন জ্বললো, রক্ত ঝরল, ঝাড়খণ্ড হলো,
সুনীলের জায়গা হলো না। ফিরে এসে
বলেছিল,
-থুঃ! শালোরা সব বিকাই হইয়েঁ গেঁছে।
এ ভাষায় পটুয়া কথা বলে না। কিন্তু সুনীল কখনো কখনো আর পটুয়া
থাকে না যে! আমাদের সুবোধ সাহিত্যে সবচাইতে বেশি লিখিত সান্থালিতে তখন সুনীল কথা বলতে থাকে। সুনীল তো
একটি চরিত্র,
তাই না? সুনীল আসলে কমেন্টেটর। সুনীল তো
গাভাসকর। মৃদু মৃদু হাসবে ছবি দেখালে টিভিতে। মাথার টুপিটা ঠিক করে নিতে নিতে বলতে
থাকবে,
-Just outside the good length spot and a huge six. Ooops! Well
punished for the blunder that he made.
বলার জন্য মধ্যিখানে গলাটা চড়বে, ওই
সিক্সের ডগা অবধি, তারপরে আবার নেমে আসবে সমে। পেছনে শ শ শ শ
শ করে হাজারে হাজারে হাততালি বাজতে থাকবে, ছক্কা লেগেছে বলে।
যেন চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে। সুনীল সে চাঁদের রূপে মুগ্ধ। মুগ্ধতা চরিত্রের মধ্যে থাকে, কিন্তু মুগ্ধতাই চরিত্র না।
একটা ছোট্ট অংশ। ঝাড়খণ্ড থেকে এনেছিল যুবতী হেমব্রমকে সুনীল। মুগ্ধ হয়েই। পোটো পাড়ায়
প্রচুর কানাকানি লেগে গিয়েছিল।
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন