কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

০১) অলোকপর্ণা

নয়েজ



জেরক্স মেশিনের আলোয় চকচক করছে কুন্তলের ঘামেভেজা মুখ। কিছুক্ষণ আগের উত্তেজনাতে মেশিনটা এখনও নয়েজ দিয়ে যাচ্ছে। মাটিতে বসে থাকা কুন্তল মেশিনের দিকে মুখ তুলে তাকাল, “এতদিনে, এতদিনে, এতদিনে!”... এতদিনে ইন্দ্রনাথকে সরানো গেছে পৃথিবী থেকে!
তার মুখে পাশবিক হাসি ফুটে ওঠে।

কুন্তল মেশিনের সামনে উঠে দাঁড়ায়, অর্ডারের ভারী বইটা স্ক্যান করতে থাকে।



(১)

ক্লাস ওয়ানে পড়ার সময় মা ইন্দ্রকে বলেছিল, “সামনের ক্লাসে তোমার নাম বদলে দেওয়া হবে।” ছোট্ট ইন্দ্রনাথ মজুমদার ভাবতে পারেনি নাম বদলানো কাকে বলে। নাম বদলের সাথে আরো কি কি বদলে যায় তাও সে ভাবেনি। তার শুধু আনন্দ হয়েছিল, নতুন বছর নতুন খাতা-বইয়ের মতো নতুন নাম,- “মা, প্রত্যেক বছর নতুন নাম দেওয়া হবে আমায়?!”
ছুটির ছাদের পাঁচিলে হেলান দিয়ে বসে ইন্দ্র নতুন নামের কথা ভাবত। সে দেখত নতুন নামের ইন্দ্রনাথ তার পাশে হাসিমুখে এসে বসেছে। যেন নতুন বন্ধু! ইন্দ্রও হাসত। সে মনে মনে কথা বলে যেত নতুন ইন্দ্রনাথের সাথে... তার বাড়ি কোথায়, সে কোন্‌ স্কুলে পড়ে, তার মা বাবা কেমন, আরো কত কি! “কবে ক্লাস টুতে উঠবো আমি!? খুব মজা হবে তখন! আমি আর আমি থাকব না, আমি তুই হয়ে যাব, নতুন হয়ে যাব!” ফাঁকা ছাদে আচার ভাগ করে খেতে খেতে হেসে উঠত তারা দুজনেই।

কিন্তু পরের বছর ইন্দ্রনাথের নাম কেটে দিয়ে স্কুলের রোল-কলের খাতায় উঠে এল কুন্তল মজুমদার। কুন্তল কারো সাথে মেশে না, লাস্ট বেঞ্চে একা একা বসে। তার ইরেজারটা না বলে ব্যবহার করায় কুন্তল রূপকের হাতে পেন ফুটিয়ে রক্ত বার করে দিল,- ইন্দ্রর ভালো লাগল না। কুন্তলকে ভা্লো লাগল না ইন্দ্রনাথের।



(২)

ইন্দ্রনাথ চিরকাল কুন্তলকে সামলানোর চেষ্টা করে গিয়েছে। বোনকে যে রাতে অ্যাবিউস করল কুন্তল, ইন্দ্রনাথের ইচ্ছে হয়েছিল রান্নাঘর থেকে ছুরিটা নিয়ে এসে ঢুকিয়ে দেয় কুন্তলের পেটে! কিন্তু সে কুন্তলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি।


বাবা পরদিন বাড়ি থেকে বের করে দিল কুন্তলকে। ইন্দ্রনাথ অবাক হয়ে দেখল-- মা, বাবা, বোন কেউ তার খোঁজ পর্যন্ত করছে না, যেন সে বাড়ির সবার কাছে মৃত!

কুন্তলের মুখে থুতু ছেটাতে ইচ্ছা করল ইন্দ্রর।



(৩)

কুন্তল দোকানের কাজ বুঝে নিয়েছে প্রায় এক বছর। এখন আর মল্লিকদা তদারকি করার জন্য বসে থাকেন না। পুরো দোকান একাই সামলায় সে। কপি করতে করতে একেক সময় নিজেকেও একটা ফটোকপিই মনে হতে থাকে তার... কার কপি? ইন্দ্রনাথের? চোয়াল শক্ত হয়ে আসে কুন্তলের, সে মেশিনে মন দেয়।

এমনই একা থাকা এক সন্ধ্যেবেলা ইন্দ্রনাথ তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তাকে বলল,- “ইন্ট্রুডার!”
কুন্তল চমকাল না, রাগে তার মাথা ঝনঝন করে উঠল, “ভেতরে যাও! ভেতরে যাও! ভেতরে যাও!”- তিনকপি জেরক্সের মতোই কুন্তল চিৎকার করে উঠে ইন্দ্রর কলার চেপে ধরে তাকে কোণঠাসা করে ফেলল।

তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে ইন্দ্র বলল, “আমি চলে গেলে তুই ফিকে হয়ে যাবি রে কুন্তল, তুই... তুই তো আমার ছায়া মাত্র!”
কুন্তল ঝাঁপিয়ে পড়ে ইন্দ্রর ওপর, দোকান তছনছ করে ধ্বস্তাধ্বস্তি করে তারা। কেউ জেতে না, কেউ হারে না।
হঠাৎ মল্লিকদা চলে আসায় ইন্দ্রনাথ আবার ঢুকে যায় কুন্তলের ভেতর।



আজ বিকেলে ইন্দ্র আবার কুন্তলের মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।

তাকে দেখামাত্র কুন্তল পেপার কাটার ছুরিটা তার গলায় ঠেকিয়ে বলল, “তোকে আমি হয়েই থাকতে হবে চিরকাল। তোকে আমি হয়েই থাকতে হবে চিরকাল। তোকে আমি হয়েই থাকতে হবে চিরকাল।” ইন্দ্র অনেক কষ্টে বলে উঠল, “তুই না। আমি বল, আমি - ইন্দ্রনাথ! কুন্তল কেউ নয়, কুন্তল কেউ না!”

কুন্তল ইন্দ্রনাথকে চেপে ধরল জেরক্স মেশিনের কাচে। খুব জোরে গলা টিপে ধরে থাকায় একটু পরেই ইন্দ্র জেরক্স মেশিনে ঢুকে গেল। কুন্তলের ঘামেভেজা মুখ জেরক্স মেশিনের আলোয় চকচক করতে থাকল।



(৪)

অটোমেটিক কপিমেশিনে কপি হয়ে গিয়েছে গোটা বই। মল্লিকদা ভারী বইটার পাতা উল্টে দেখছেন, সব ঠিক ভাবে সাজানো আছে কি না। পাশে দাঁড়িয়ে পাতাগুলো দেখতে গিয়ে কুন্তল চমকে ওঠে, -- প্রতি পাতায় ওয়াটারমার্ক হয়ে হাসছে মেশিনের কাচে চেপে ধরা ইন্দ্রনাথের মুখ!



কুন্তল দু’হাতে কান চেপে ধরে। তার মাথায় ঢুকে আসছে হুবহু জেরক্স মেশিনের মতো ইন্দ্রনাথের হাসির নয়েজ! ইন্দ্রনাথের হাসির নয়েজ! ইন্দ্রনাথের হাসির নয়েজ!




3 কমেন্টস্:

  1. অনবদ্য ! আমাদের সবারই এরকম একটা করে ফটোকপি আছে নিশ্চয়ই ! আলবাত আছে...

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. ঝুরোগল্প লিখতে পারিনা তাই বুঝতে এসেছিলাম। কত জায়গায় যে কত মাণিক্য ছড়িয়ে আছে... এটি তারই প্রকাশ। গল্প পড়ে আমি থ।

    এতখানি কন্ট্রোলে নিয়ে একটা ভাবনাকে গল্পছাঁচে এক্সিকিউট করা মুখের কথা নয়। তবে হ্যাঁ, শিখলাম। কেননা লিখতে বসে শ'য়ে শ'য়ে শব্দরা ভিড় করে আসে, তাকে পাশ কাটিয়ে মূলসুরটা শুনিয়ে দেওয়া সহজ ছিল না।

    ধ্রুপদী সঙ্গীত যেমন কম পরিসরে উপস্থাপন করা কঠিন, এই অনু-পরিমমানতাও তাই। এতকিছু সামলে... বাপরে।

    উত্তরমুছুন