স্বাধীনতা দিবস
পূর্ণেন্দু মিত্র
স্বাধীনতার বয়স যখন সবে দশ, আমার তখন ছয়। নেহরুজী দেশের প্রধানমন্ত্রী। দশ নম্বর স্বাধীনতা দিবস মর্যাদার সাথে পালন করতে দেশজুড়ে সাজো সাজো রব তুলেছেন তিনি। তার আঁচ লেগেছে আমাদের পাঁচমিশালী রেলশহরেও। অন্যান্যদের মতো রেল কলোনীর বাংলা মিডিয়াম স্কুলে চলছে উৎসবের মহড়া। প্রভাত ফেরীর তোড়জোড়। ভোরের আলোয় ট্রাকবাহিত দিদিরা গাইবেন – ‘ধন ধান্যে পুষ্পেভরা…’ থেকে ‘ও আমার দেশের মাটি…’, সব দেশাত্মবোধক গান। আর দাদারা ট্রাকের সামনে ড্রাম বিউগল বাজিয়ে, ‘চল চল চল ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল…’এর তালে তালে মার্চ্চ। আমরা কিছু কুচোকাঁচা ট্রাকের উপর শূন্যস্থান পূরণ। কলোনী ঘুরে স্কুলে পৌঁছে প্রভাত ফেরী শেষ হবে, তারপর বড়দিদিমণির বক্তৃতা, পরিশেষে সাদা পায়রা উড়ানো এবং বালক-বালিকাদের পাউডার গোলা দুধ, লজেন্স, কলা, সেও-বঁদিয়া বন্টন। ছুটি।
তখন ইংরেজ কাগজে কলমে চলে গেলেও ফেলে গেছে ভগ্নাংশ। ডড, রড্রিগস, কুক, স্যামপায়োরা আমাদের পাশের পাড়ায় থাকে। তাদের কচিকাঁচা টাইগার, ফ্রেড, ডরোথি, লিলিরা বিভেদের বেড়া ডিঙিয়ে সাহেবপাড়া থেকে নেটিভ পাড়ায় খেলতে আসে। তাদের মধ্যে সেরা লোকো ড্রাইভার ডডের কন্যা ডরোথি। অনর্গল কথার খই ফুটছে, ছটফটে জীবন্ত। এক এক দিন বেবী সাইকেল চালিয়ে বোঁ করে আমাদের চমকে দিয়ে, ঘুরপাক খেয়ে, সোঁ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্যদিন লাল রঙের গোটা তিনেক বড় বড় রিং এক এক করে মাথা গলিয়ে অসীম দক্ষতায় কোমরে ঘোরাতে থাকে বন বন বন বন। সে মেরীর ঘর বানাতে শেখায়, বড়দের দেখাদেখি গানের তালে তালে রক এন্ড রোলের স্টেপিং শেখায়। এহেন ডরোথিকে ওর মা একবার, য়ুরোপিয়ান ইনিস্টিটিউটে ম্যাটিনি শো’তে ‘উড়ান খাটোলা’ চলচ্চিত্র দেখতে যাবেন বল্ আমার মা’এর জিম্মায় রেখে গিয়েছিলেন। সেই দুপুরে নাচে গানে বহুমুখি প্রতিভায় আমার মা’কে সে এমন মোহিত করে যে, ভবিষ্যৎ-এ আমাদের দু’ভাই-এর একজনকে মা ডরোথি নিমিত্ত সমর্পিত করে রাখেন। অথচ স্বাধীনতা উৎসবে ডরোথির পাড়া একেবারে নিঝুম।
আর ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী প্রেম সিং হোড়া। রেলকোম্পানীর টিকিট চেকার, প্রাক্তন লাহোরী, শিখ সর্দার। স্বাধীনতার নামে তাঁর মাথায় আগুন জ্বলত। এমনিতে গোটা বছর সর্দারজী সাত চড়ে রা কাড়তেন না। লাইন ফেরতা সাদা প্যান্ট, কালো কোট পরা বেঁটেখাটো স্থূলকায় সিংজীকে, টিফিন ক্যারিয়র দুলিয়ে, স্টেশন থেকে মন্থর পায়ে ঘরে ফিরতে দেখা যেত। ঘরে ফিরেই হাঁক দিতেন – অয় জিড্ডু কি মা... সুখী ওয়ে… ইত্থে আ…! সর্দারের ডাক শুনেই সর্দরিনী সুখবিন্দার কাউর উর্ফ সুখী আন্টি শশব্যস্ত হয়ে একটি থালা হাতে নিয়ে সর্দারের সামনে দাঁড়াতেন। সর্দার প্রথমে ডান প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাতেন, তারপর বাঁ পকেটে, কোটের ডান তারপর বাঁ, কোটের বুক পকেট ডান-বাঁ, একে একে সব পকেট থেকে মুঠো মুঠো এক আনি, দু আনি, সিকি, আধুলির খুচরো বের করে থালার ওপর ঢেলে জড়ো করতেন। তারপর দিন দুই ছুটি। দেওয়ালে টাঙানো গুরু গোবিন্দ সিং-এর বিশাল ছবিতে দু’ফুট লম্বা কৃপাণ ছুঁইয়ে, চামর দুলিয়ে গুরুগ্রন্থ পাঠ। বাকি সময় উঠোনে খাটিয়া ফেলে চিৎপাত। ক্বচিৎ কদাচিৎ নীল ডোরাকাটা আন্ডারপ্যান্ট এবং স্যান্ডো গেঞ্জী পরিহিত সিংজীকে খোলাচুলে বাগান পরিচর্যারত দেখা যেত। সন্ধ্যাবেলায় সোডা এবং জনি ওয়াকারের বোতল নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়তেন সিংজী। ঢুকু ঢুকু পর্ব শেষ হতো মাঝরাতে নিস্তব্ধতা চেরা হাহাকার মেশা কান্নায়। সুখী আন্টি আমার মা’কে বলতেন, পার্টিসনের দাঙ্গায় বাপ-মা-ভাই-বোন খুইয়ে নাকি সর্দারের এই অধগতি। আমার মা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন, আহা রে! ঠাকুর! ঠাকুর!
“ফাঁসীর মঞ্চে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান” তাঁদের প্রতি আমার মা’এর ছিল অচলা ভক্তি। মাস্টারদা সূর্য সেন, শহীদ ভগৎ সিং, বীর ক্ষুদিরামের আত্মবলিদানের কাহিনী আমাদের দু’ভাইকে পাখিপড়া করে মুখস্ত করিয়েছিলেন। নয় নম্বর স্বাধীনতা দিবসে মা কোয়ার্টারের সামনের বাগানে একটা বাঁশ পুতে তাতে তিরঙ্গা ঝান্ডা টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। নিচে টেবিলের ওপর নেতাজীর গলায় মালা আর থালায় রাখা গুজিয়াবাতাসার স্তুপ। প্রেম সিং পুত্র জিড্ডু সমেত পাড়ার সব ক্ষুদেরা জড়ো হয়েছিল সমবেত কন্ঠে ‘জন গন’ গাইবে বলে, আর গুজিয়াবাতাসার লোভে লোভে । নীলুর পিসি ছিলেন মা’এর অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাঁর বর অনিল পিসেমশাই, যাঁকে আমি দেখিনি, ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। এক কালে জেল খেটেছেন, বোমা ছুঁড়েছেন। দেশভাগের পরে পরে স্ত্রীকে নিয়ে বেনাপোলের বর্ডার পার হতে গিয়ে, রাতের অন্ধকারে লুটপাট হানাহানির মাঝে তিনি যে কোথায় হারিয়ে গেলেন, কেউ জানে না। আজও তাঁর খবর নেই। সেই থেকে নীলুর পিসি ভাইয়ের পরিবারে অন্নভুক্ত। আজ স্বামীগরিমায় তিনি প্রধান অতিথি।
নবীন জাতীয় পতাকা পত পত করে উড়ছে, অনুষ্ঠান শুরু হব হব, এমন সময় ‘যো বোলে সো নিহাল’ হুঙ্কার দিয়ে মাথার ওপর বন বন করে কৃপাণ ঘোরাতে ঘোরাতে টলোমলো পায়ে আকন্ঠ জনি ওয়াকারে নিমজ্জিত প্রেম সিং হোড়া ঝাঁপ দিলেন। শিশুরা আতঙ্কে চীৎকার করে উঠল, হুটোপাটি শুরু। মা’এরা প্রাণপণে সামলাচ্ছেন সন্তানদের। ‘বাহে গুরু দা খালসা বাহে গুরু দা ফতে’ রব তুলে গোটাকয় বেলি-রজনীগন্ধা-গোলাপ গাছের মাথা কেটে তিরঙ্গাবেদীর তলায়, নেতাজীর পাদদেশে কৃপাণ হস্তে সর্দার ধরাশায়ী হলেন। নিশ্চুপ। নিমেষে ঘটে গেল ঘটনাটা। ধাতস্থ হতে দেখি, সর্দারিনী সুখবিন্দার কৌর উর্ফ সুখী আন্টি বিলাপ করতে করতে সর্দারের জ্ঞানশূন্য দেহ পরম যত্নে তুলে ধরার চেস্টা করছেন – ‘বস কর সর্দ্দার তুসি বস কর! যো ইনসান মরযাওন্দা ওহো কদি ওয়াপিস নহি আউন্দা… ভুল যা… তুসি বস কর…!’
আমরা স্থানুবৎ।
দশ নম্বর স্বাধীনতা দিবস। ১৫ আগষ্ট ১৯৫৭-র প্রাতঃকালে গানের সুরে, ব্যান্ডের তালে তালে, ভোরের আলোয়, ট্রাক আমাদের পাড়ায় এসে থামলো। টুল নামিয়ে দিতে তাতে পা রেখে চড়ে বসতেই কোলে করে ডালার ওপরে। আমার পিছনেই মুর্শিদাবাদ নিবাসী রেল সিগনালার হাকিম সাহেবের দুই ছেলে আরিফ আর শরিফ। শরিফের আবার সর্বক্ষেত্রে বীররসের প্রাবল্য। সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে এক হাত মুঠো করে আকাশের দিকে তুলে অন্য হাত মুখের কাছে নিয়ে সদ্য দেখা ‘টার্জান দ্য এপম্যানের’ কায়দায় খুশির প্রকাশ ‘ও…ও... ও... ও’! তাই শুনে পিছন থেকে নীলুর প্রতিক্রিয়া, ‘পাকিস্তানি পাকিস্তানি’! চরম অপমানে শরিফ – ‘কী বললি?’ বলেই নীলুর উপর ঝাঁপ। জড়াজড়ি হুটোপাটি। অতর্কিতে ‘ও আমার দেশের মাটি’ বিপন্ন। দিদিরা দুজনকে তুলে ট্রাকের দু’কোণায় বসিয়ে দিলেন। ‘দেশের মাটি’ জোড়া লেগে গেল। শান্তি।
বুদবুদের মতো ঘটনাটি মিলিয়ে গেলেও, শিশুমহলে বিকেল বেলার খেলার মাঠে তা ছিল হেডলাইন। নীলুর মুখে বৃত্তান্ত শুনে প্রেমপুত্র জিড্ডু উর্ফ গুরদয়ালের দেশপ্রেম টগবগিয়ে উঠল। শরিফের প্রসিনিয়মে প্রবেশ হতে না হতেই জিড্ডু ‘পাকিস্তানি’-র চুল খামচে ধরে ঝুলে পড়ল। ভাইয়ের দুর্দশা দেখে আরিফ জিড্ডুর কোমর ধরে প্রবল টানাটানি শুরু করলো। নীলু ওদিকে শরিফের ঠ্যাং ধরে টানছে। প্রবল আলোড়ন। অশ্বক্ষুরের দাপটে রণক্ষেত্রে ধূলো উড়ছে। আমরা ক’জন কিংকর্তব্যবিমূঢ় দর্শক। পানিপথের যুদ্ধে কী হয় কী হয় অবস্থা! হঠাৎই একটা সাদা পায়রা শান্তির ধড়াচূড়ো ছেড়ে তড়িৎ গতিতে জিড্ডুর পেটে ঢুঁ, তারপর দু’হাতের ধাক্কায় শরিফকে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিয়ে মাঝখানে বীরাঙ্গনার মতো দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। ‘--- ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- মাই ফুট--- ইউ বাডি কাওয়ার্ড --- থুঃ--- তুমলোগ জানতা ম্যান--- হমলোগ সব অস্ট্রেলিয়া চলা যায়গা--- ড্যাডি টোল্ড মি--- স্টে উইথ ইয়োর বেগার ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- থুঃ---
হায়রে---
‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়...’
স্বাধীনতার বয়স যখন সবে দশ, আমার তখন ছয়। নেহরুজী দেশের প্রধানমন্ত্রী। দশ নম্বর স্বাধীনতা দিবস মর্যাদার সাথে পালন করতে দেশজুড়ে সাজো সাজো রব তুলেছেন তিনি। তার আঁচ লেগেছে আমাদের পাঁচমিশালী রেলশহরেও। অন্যান্যদের মতো রেল কলোনীর বাংলা মিডিয়াম স্কুলে চলছে উৎসবের মহড়া। প্রভাত ফেরীর তোড়জোড়। ভোরের আলোয় ট্রাকবাহিত দিদিরা গাইবেন – ‘ধন ধান্যে পুষ্পেভরা…’ থেকে ‘ও আমার দেশের মাটি…’, সব দেশাত্মবোধক গান। আর দাদারা ট্রাকের সামনে ড্রাম বিউগল বাজিয়ে, ‘চল চল চল ঊর্দ্ধ গগনে বাজে মাদল…’এর তালে তালে মার্চ্চ। আমরা কিছু কুচোকাঁচা ট্রাকের উপর শূন্যস্থান পূরণ। কলোনী ঘুরে স্কুলে পৌঁছে প্রভাত ফেরী শেষ হবে, তারপর বড়দিদিমণির বক্তৃতা, পরিশেষে সাদা পায়রা উড়ানো এবং বালক-বালিকাদের পাউডার গোলা দুধ, লজেন্স, কলা, সেও-বঁদিয়া বন্টন। ছুটি।
তখন ইংরেজ কাগজে কলমে চলে গেলেও ফেলে গেছে ভগ্নাংশ। ডড, রড্রিগস, কুক, স্যামপায়োরা আমাদের পাশের পাড়ায় থাকে। তাদের কচিকাঁচা টাইগার, ফ্রেড, ডরোথি, লিলিরা বিভেদের বেড়া ডিঙিয়ে সাহেবপাড়া থেকে নেটিভ পাড়ায় খেলতে আসে। তাদের মধ্যে সেরা লোকো ড্রাইভার ডডের কন্যা ডরোথি। অনর্গল কথার খই ফুটছে, ছটফটে জীবন্ত। এক এক দিন বেবী সাইকেল চালিয়ে বোঁ করে আমাদের চমকে দিয়ে, ঘুরপাক খেয়ে, সোঁ করে অদৃশ্য হয়ে যায়। অন্যদিন লাল রঙের গোটা তিনেক বড় বড় রিং এক এক করে মাথা গলিয়ে অসীম দক্ষতায় কোমরে ঘোরাতে থাকে বন বন বন বন। সে মেরীর ঘর বানাতে শেখায়, বড়দের দেখাদেখি গানের তালে তালে রক এন্ড রোলের স্টেপিং শেখায়। এহেন ডরোথিকে ওর মা একবার, য়ুরোপিয়ান ইনিস্টিটিউটে ম্যাটিনি শো’তে ‘উড়ান খাটোলা’ চলচ্চিত্র দেখতে যাবেন বল্ আমার মা’এর জিম্মায় রেখে গিয়েছিলেন। সেই দুপুরে নাচে গানে বহুমুখি প্রতিভায় আমার মা’কে সে এমন মোহিত করে যে, ভবিষ্যৎ-এ আমাদের দু’ভাই-এর একজনকে মা ডরোথি নিমিত্ত সমর্পিত করে রাখেন। অথচ স্বাধীনতা উৎসবে ডরোথির পাড়া একেবারে নিঝুম।
আর ছিলেন আমাদের প্রতিবেশী প্রেম সিং হোড়া। রেলকোম্পানীর টিকিট চেকার, প্রাক্তন লাহোরী, শিখ সর্দার। স্বাধীনতার নামে তাঁর মাথায় আগুন জ্বলত। এমনিতে গোটা বছর সর্দারজী সাত চড়ে রা কাড়তেন না। লাইন ফেরতা সাদা প্যান্ট, কালো কোট পরা বেঁটেখাটো স্থূলকায় সিংজীকে, টিফিন ক্যারিয়র দুলিয়ে, স্টেশন থেকে মন্থর পায়ে ঘরে ফিরতে দেখা যেত। ঘরে ফিরেই হাঁক দিতেন – অয় জিড্ডু কি মা... সুখী ওয়ে… ইত্থে আ…! সর্দারের ডাক শুনেই সর্দরিনী সুখবিন্দার কাউর উর্ফ সুখী আন্টি শশব্যস্ত হয়ে একটি থালা হাতে নিয়ে সর্দারের সামনে দাঁড়াতেন। সর্দার প্রথমে ডান প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকাতেন, তারপর বাঁ পকেটে, কোটের ডান তারপর বাঁ, কোটের বুক পকেট ডান-বাঁ, একে একে সব পকেট থেকে মুঠো মুঠো এক আনি, দু আনি, সিকি, আধুলির খুচরো বের করে থালার ওপর ঢেলে জড়ো করতেন। তারপর দিন দুই ছুটি। দেওয়ালে টাঙানো গুরু গোবিন্দ সিং-এর বিশাল ছবিতে দু’ফুট লম্বা কৃপাণ ছুঁইয়ে, চামর দুলিয়ে গুরুগ্রন্থ পাঠ। বাকি সময় উঠোনে খাটিয়া ফেলে চিৎপাত। ক্বচিৎ কদাচিৎ নীল ডোরাকাটা আন্ডারপ্যান্ট এবং স্যান্ডো গেঞ্জী পরিহিত সিংজীকে খোলাচুলে বাগান পরিচর্যারত দেখা যেত। সন্ধ্যাবেলায় সোডা এবং জনি ওয়াকারের বোতল নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়তেন সিংজী। ঢুকু ঢুকু পর্ব শেষ হতো মাঝরাতে নিস্তব্ধতা চেরা হাহাকার মেশা কান্নায়। সুখী আন্টি আমার মা’কে বলতেন, পার্টিসনের দাঙ্গায় বাপ-মা-ভাই-বোন খুইয়ে নাকি সর্দারের এই অধগতি। আমার মা কপালে হাত ঠেকিয়ে বলতেন, আহা রে! ঠাকুর! ঠাকুর!
“ফাঁসীর মঞ্চে গেয়ে গেল যাঁরা জীবনের জয়গান” তাঁদের প্রতি আমার মা’এর ছিল অচলা ভক্তি। মাস্টারদা সূর্য সেন, শহীদ ভগৎ সিং, বীর ক্ষুদিরামের আত্মবলিদানের কাহিনী আমাদের দু’ভাইকে পাখিপড়া করে মুখস্ত করিয়েছিলেন। নয় নম্বর স্বাধীনতা দিবসে মা কোয়ার্টারের সামনের বাগানে একটা বাঁশ পুতে তাতে তিরঙ্গা ঝান্ডা টাঙিয়ে দিয়েছিলেন। নিচে টেবিলের ওপর নেতাজীর গলায় মালা আর থালায় রাখা গুজিয়াবাতাসার স্তুপ। প্রেম সিং পুত্র জিড্ডু সমেত পাড়ার সব ক্ষুদেরা জড়ো হয়েছিল সমবেত কন্ঠে ‘জন গন’ গাইবে বলে, আর গুজিয়াবাতাসার লোভে লোভে । নীলুর পিসি ছিলেন মা’এর অন্তরঙ্গ বন্ধু। তাঁর বর অনিল পিসেমশাই, যাঁকে আমি দেখিনি, ছিলেন স্কুল শিক্ষক এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী। এক কালে জেল খেটেছেন, বোমা ছুঁড়েছেন। দেশভাগের পরে পরে স্ত্রীকে নিয়ে বেনাপোলের বর্ডার পার হতে গিয়ে, রাতের অন্ধকারে লুটপাট হানাহানির মাঝে তিনি যে কোথায় হারিয়ে গেলেন, কেউ জানে না। আজও তাঁর খবর নেই। সেই থেকে নীলুর পিসি ভাইয়ের পরিবারে অন্নভুক্ত। আজ স্বামীগরিমায় তিনি প্রধান অতিথি।
নবীন জাতীয় পতাকা পত পত করে উড়ছে, অনুষ্ঠান শুরু হব হব, এমন সময় ‘যো বোলে সো নিহাল’ হুঙ্কার দিয়ে মাথার ওপর বন বন করে কৃপাণ ঘোরাতে ঘোরাতে টলোমলো পায়ে আকন্ঠ জনি ওয়াকারে নিমজ্জিত প্রেম সিং হোড়া ঝাঁপ দিলেন। শিশুরা আতঙ্কে চীৎকার করে উঠল, হুটোপাটি শুরু। মা’এরা প্রাণপণে সামলাচ্ছেন সন্তানদের। ‘বাহে গুরু দা খালসা বাহে গুরু দা ফতে’ রব তুলে গোটাকয় বেলি-রজনীগন্ধা-গোলাপ গাছের মাথা কেটে তিরঙ্গাবেদীর তলায়, নেতাজীর পাদদেশে কৃপাণ হস্তে সর্দার ধরাশায়ী হলেন। নিশ্চুপ। নিমেষে ঘটে গেল ঘটনাটা। ধাতস্থ হতে দেখি, সর্দারিনী সুখবিন্দার কৌর উর্ফ সুখী আন্টি বিলাপ করতে করতে সর্দারের জ্ঞানশূন্য দেহ পরম যত্নে তুলে ধরার চেস্টা করছেন – ‘বস কর সর্দ্দার তুসি বস কর! যো ইনসান মরযাওন্দা ওহো কদি ওয়াপিস নহি আউন্দা… ভুল যা… তুসি বস কর…!’
আমরা স্থানুবৎ।
দশ নম্বর স্বাধীনতা দিবস। ১৫ আগষ্ট ১৯৫৭-র প্রাতঃকালে গানের সুরে, ব্যান্ডের তালে তালে, ভোরের আলোয়, ট্রাক আমাদের পাড়ায় এসে থামলো। টুল নামিয়ে দিতে তাতে পা রেখে চড়ে বসতেই কোলে করে ডালার ওপরে। আমার পিছনেই মুর্শিদাবাদ নিবাসী রেল সিগনালার হাকিম সাহেবের দুই ছেলে আরিফ আর শরিফ। শরিফের আবার সর্বক্ষেত্রে বীররসের প্রাবল্য। সোজা হয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে এক হাত মুঠো করে আকাশের দিকে তুলে অন্য হাত মুখের কাছে নিয়ে সদ্য দেখা ‘টার্জান দ্য এপম্যানের’ কায়দায় খুশির প্রকাশ ‘ও…ও... ও... ও’! তাই শুনে পিছন থেকে নীলুর প্রতিক্রিয়া, ‘পাকিস্তানি পাকিস্তানি’! চরম অপমানে শরিফ – ‘কী বললি?’ বলেই নীলুর উপর ঝাঁপ। জড়াজড়ি হুটোপাটি। অতর্কিতে ‘ও আমার দেশের মাটি’ বিপন্ন। দিদিরা দুজনকে তুলে ট্রাকের দু’কোণায় বসিয়ে দিলেন। ‘দেশের মাটি’ জোড়া লেগে গেল। শান্তি।
বুদবুদের মতো ঘটনাটি মিলিয়ে গেলেও, শিশুমহলে বিকেল বেলার খেলার মাঠে তা ছিল হেডলাইন। নীলুর মুখে বৃত্তান্ত শুনে প্রেমপুত্র জিড্ডু উর্ফ গুরদয়ালের দেশপ্রেম টগবগিয়ে উঠল। শরিফের প্রসিনিয়মে প্রবেশ হতে না হতেই জিড্ডু ‘পাকিস্তানি’-র চুল খামচে ধরে ঝুলে পড়ল। ভাইয়ের দুর্দশা দেখে আরিফ জিড্ডুর কোমর ধরে প্রবল টানাটানি শুরু করলো। নীলু ওদিকে শরিফের ঠ্যাং ধরে টানছে। প্রবল আলোড়ন। অশ্বক্ষুরের দাপটে রণক্ষেত্রে ধূলো উড়ছে। আমরা ক’জন কিংকর্তব্যবিমূঢ় দর্শক। পানিপথের যুদ্ধে কী হয় কী হয় অবস্থা! হঠাৎই একটা সাদা পায়রা শান্তির ধড়াচূড়ো ছেড়ে তড়িৎ গতিতে জিড্ডুর পেটে ঢুঁ, তারপর দু’হাতের ধাক্কায় শরিফকে এক ঝটকায় মাটিতে ফেলে দিয়ে মাঝখানে বীরাঙ্গনার মতো দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল। ‘--- ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- মাই ফুট--- ইউ বাডি কাওয়ার্ড --- থুঃ--- তুমলোগ জানতা ম্যান--- হমলোগ সব অস্ট্রেলিয়া চলা যায়গা--- ড্যাডি টোল্ড মি--- স্টে উইথ ইয়োর বেগার ইন্ডিপেন্ডেন্ট--- থুঃ---
হায়রে---
‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে কে বাঁচিতে চায়...’
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন