কোনো এক ঝড়ের রাতে
সোনালি বেগম
ভাগীরথীর তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছি। পড়ন্ত বিকেলে রক্তিম ভাগীরথীর জল স্বপ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছে। দূরে দূরে ভাসমান অসংখ্য নৌকা। নদীর ধারে হরিদাসমাটি গ্রামে পৌঁছে এক আশ্চর্য মায়াময় গাছগাছালি আলো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলাম বহুক্ষণ। কাছেই একটি কুঁড়েঘর। বাঁশের বেড়া দেওয়া সুরক্ষিত এক চিলতে উঠোন। কয়েকটি মুরগি দিনের শেষে এদিক ওদিক খুঁটে নিচ্ছে দানা। মাটির দাওয়ায় বসেছিলেন সাদা শাড়ি পরিহিত বৃদ্ধা, কলমিলতা দেবী, যাঁকে ছেলেবেলায় ‘মা’ বলতাম।
একটু এগিয়ে গেলাম, ‘মা, কেমন আছো, গো?’
‘কে, কে ওখানে?’
‘আমি পারুল, তোমাদের গ্রামের মেয়ে’।
‘ওঃ, কবে এলি?’
‘এই তো, কত বছর পর এলাম, জন্মমাটি গায়ে মাখতে---’
‘আয় আমার কাছে এসে বোস্, মা’, বৃদ্ধার চোখ থেকে ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল। আমি ওঁর খুব কাছে গিয়ে বসলাম। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বার বার তাঁর পারুলকে খুঁজতে থাকলেন।
‘এই হরিদাসমাটিতে একা একা পড়ে আছো কেন গো? তোমার জন্য খুব কষ্ট হয়, মা!’
‘একা হবো কেন রে পাগলি! এখানের মাটি জল আর হাওয়ায় কত স্বাদ কত গন্ধ.., তা, তুই বুঝি একা এসেছিস?’
‘একা তো আমরা সবাই, মা! তোমার ছেলেমেয়েদের খবর কি, মা?’ আমি উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করি।
হঠাৎ সন্ধ্যের আলোছায়ায় কালবৈশাখি ঝড় শুরু হয়ে যায়। আমি আর মা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ি।
‘তুমি চোখে আর দেখতে পাও না?’
‘ও তো, চালসে পড়েছে রে। আন্দাজে সব দেখতে পাই। এই যে তুই এলি, দেখলাম!’ চোখেমুখে বলিরেখায় স্পষ্ট স্মৃতির বালুচর।
‘জানো তো, মা, আমার সুগার হয়েছে, খাবার বুঝে বুঝে খেতে হয়’।
‘দুশ্চিন্তা করিস না, মেথিদানার পাউডার সকাল সন্ধ্যে খাস’।
‘মেথিতে থাকা ট্রাইগোনেলিন ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।’
‘আমি অতো-শত জানি না, বাপু। বলি, তুই তো আগের থেকে বেশ কালো হয়ে গেছিস!’
‘চোখে দেখতে পাও না ঠিক করে, আর...’ আমি কৌতুক করে হাসতে থাকলাম।
‘শুকনো জবাফুল দুধের সরের সঙ্গে বেঁটে মুখে মাখিস, ফর্সা হয়ে যাবি।’
‘বাব্বা! লতাপাতার কত টোটকাই তুমি জানো, মা’!
কয়েকটি ইঁদুর ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণে দ্রুত চিঁচিঁ শব্দ করে লুকিয়ে পড়ছে। লন্ঠনের ক্ষীণ আলোয় আমরা দুই মানবী পরষ্পরকে জন্মান্তরের প্রকৃতি চেতনায় ঋদ্ধ করছি। লুকোনো দীর্ঘশ্বাস বুকের গভীরে কবরস্থ করে কোনো এক ঝড়ের রাতে ছেলেবেলায় ফেলে আসা দিনগুলি সলতেপোড়া দিয়ে ক্ষতের জায়গাটাকে সারিয়ে তুলতে থাকলাম...
ভাগীরথীর তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছি। পড়ন্ত বিকেলে রক্তিম ভাগীরথীর জল স্বপ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছে। দূরে দূরে ভাসমান অসংখ্য নৌকা। নদীর ধারে হরিদাসমাটি গ্রামে পৌঁছে এক আশ্চর্য মায়াময় গাছগাছালি আলো-অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকলাম বহুক্ষণ। কাছেই একটি কুঁড়েঘর। বাঁশের বেড়া দেওয়া সুরক্ষিত এক চিলতে উঠোন। কয়েকটি মুরগি দিনের শেষে এদিক ওদিক খুঁটে নিচ্ছে দানা। মাটির দাওয়ায় বসেছিলেন সাদা শাড়ি পরিহিত বৃদ্ধা, কলমিলতা দেবী, যাঁকে ছেলেবেলায় ‘মা’ বলতাম।
একটু এগিয়ে গেলাম, ‘মা, কেমন আছো, গো?’
‘কে, কে ওখানে?’
‘আমি পারুল, তোমাদের গ্রামের মেয়ে’।
‘ওঃ, কবে এলি?’
‘এই তো, কত বছর পর এলাম, জন্মমাটি গায়ে মাখতে---’
‘আয় আমার কাছে এসে বোস্, মা’, বৃদ্ধার চোখ থেকে ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল। আমি ওঁর খুব কাছে গিয়ে বসলাম। গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বার বার তাঁর পারুলকে খুঁজতে থাকলেন।
‘এই হরিদাসমাটিতে একা একা পড়ে আছো কেন গো? তোমার জন্য খুব কষ্ট হয়, মা!’
‘একা হবো কেন রে পাগলি! এখানের মাটি জল আর হাওয়ায় কত স্বাদ কত গন্ধ.., তা, তুই বুঝি একা এসেছিস?’
‘একা তো আমরা সবাই, মা! তোমার ছেলেমেয়েদের খবর কি, মা?’ আমি উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করি।
হঠাৎ সন্ধ্যের আলোছায়ায় কালবৈশাখি ঝড় শুরু হয়ে যায়। আমি আর মা ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ি।
‘তুমি চোখে আর দেখতে পাও না?’
‘ও তো, চালসে পড়েছে রে। আন্দাজে সব দেখতে পাই। এই যে তুই এলি, দেখলাম!’ চোখেমুখে বলিরেখায় স্পষ্ট স্মৃতির বালুচর।
‘জানো তো, মা, আমার সুগার হয়েছে, খাবার বুঝে বুঝে খেতে হয়’।
‘দুশ্চিন্তা করিস না, মেথিদানার পাউডার সকাল সন্ধ্যে খাস’।
‘মেথিতে থাকা ট্রাইগোনেলিন ডায়াবেটিস রোগীর রক্তের সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।’
‘আমি অতো-শত জানি না, বাপু। বলি, তুই তো আগের থেকে বেশ কালো হয়ে গেছিস!’
‘চোখে দেখতে পাও না ঠিক করে, আর...’ আমি কৌতুক করে হাসতে থাকলাম।
‘শুকনো জবাফুল দুধের সরের সঙ্গে বেঁটে মুখে মাখিস, ফর্সা হয়ে যাবি।’
‘বাব্বা! লতাপাতার কত টোটকাই তুমি জানো, মা’!
কয়েকটি ইঁদুর ঘরের এক কোণ থেকে অন্য কোণে দ্রুত চিঁচিঁ শব্দ করে লুকিয়ে পড়ছে। লন্ঠনের ক্ষীণ আলোয় আমরা দুই মানবী পরষ্পরকে জন্মান্তরের প্রকৃতি চেতনায় ঋদ্ধ করছি। লুকোনো দীর্ঘশ্বাস বুকের গভীরে কবরস্থ করে কোনো এক ঝড়ের রাতে ছেলেবেলায় ফেলে আসা দিনগুলি সলতেপোড়া দিয়ে ক্ষতের জায়গাটাকে সারিয়ে তুলতে থাকলাম...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন