নীল মাঠ
লিপিকা ঘোষ
‘মুনিয়া, আমাদের মুনিয়া পাখি–ই, যা তো এক দৌড়ে ঐ উঁচু ঢিপিটা ছুঁয়ে ফিরে আয় তো; যে আগে আসবে সে পাবে এক আশ্চর্য জিনিস’
সোনা মাসির বর তাল-ঢ্যাঙা অমলকান্তি কাকু। মেসো না হয়ে কেন কাকু হলো, তা বুঝে পায় না ছোট্ট মুনিয়া। সেই অমলকাকু আর মুনিয়া দৌড় দৌড়... পিনুমাসি হাততালি দিচ্ছে, ‘আরও জোরে মুনিয়া...’। সোনা মাসির সদ্য বিয়ে হয়েছে। অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি এসে এদিক ওদিক ঘুরতে বেড়িয়েছে। বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো জায়গা নীলকুঠির মাঠ। কাছেই ওয়ারেন হেস্ট্রিংস-এর বউ মেয়ের কবরখানা। মুনিয়ার এক কবর থেকে আর এক কবরে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করার জায়গা। বাবা গোখরো সাপের ভয় দেখান। মা বলেন ‘গায়ে কোন্ হাওয়া বাতাস যে লাগবে মেয়েটার! মুনিয়া ভাবে, গোখরোটা যদি মণি মাথায় করে বেরিয়ে আসে আর ফণা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে ও ঠিক মণিটা তুলে নিয়ে দৌড় লাগাবে।
মুনিয়া দৌড়চ্ছে, ঢ্যাঙা অমলকাকু লম্বা লম্বা পা ফেলে পাল্লা দিচ্ছে। মুনিয়ার কমলা ফ্রক উড়ছেণ। সব ফ্রক ও’র মা নিজের হাতে তৈরি করেন। সেলাই মেশিন ছাড়াই। এ নিয়ে মুনিয়ার অহংকারের শেষ নেই। ‘আমার মায়ের হাতে তৈরি করা জামা, জানিস!’ বন্ধুদের হেরে যাওয়া মুখগুলো দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। হাওয়ায় ভাসছে মুনিয়া। নীল কুঠির মাঠ। লোকের মুখে ‘নীল মাঠ’। নীলকর সাহেবদের না কি বাস ছিল হেথায়। তারও আগে না কি এটা-ই ছিল জাহাজ ঘাটা। বন্দর। জাহাজ ভিড়ত এসে। তারপর সাহেবরা গঙ্গা কেটে এখানে ‘কাটিগঙ্গা’ ফেলে রেখে যায়। জাহাজঘাটা শুকিয়ে মাঠ হয়। ঐ যে আমবাগান! ওখানে নীল সাহেবদের কুঠি ছিল। মাটি খুঁড়লেই ভাঙা দেওয়ালের সারি। পরশুর আগের দিনই, কিছু দূরের ধ্বসে পড়া জৈন মন্দির-এর চূড়োয় বসানো ঘটটা না কি নিরেট সোনার! কিছু আবিষ্কার করে ইতিহাস বই লেখেন, এমন এক মস্ত কেউ অনেক পুলিশ সঙ্গে করে এসেছিলেন। ওমা, মন্দিরের ঐ জৈন ঠাকুরের চেয়েও দামি না কি ওই ঘট! ‘ওদের তুমি ক্ষমা করে দিও শিবঠাকুর, ওরা কিচ্ছু বোঝে না’।যেন সব বোঝার দায় একা মুনিয়ার।
কাছেই ভাঙা মাথার এক শিব মন্দির, সতীদাহ ঘাট। ওর দিদান সব গল্প বলে। সতী মানে তো খুব ভালো মেয়ে, যারা একটুও দুষ্টুমি করে না। তা হলে! মুনিয়ার মাথায় কিচ্ছু ঢোকে না। ভয় করে খুব। ও কক্ষনো ভালো মেয়ে হবে না, ঠিক করেছে।
‘মুনিয়া, মুনিয়া পাখি আরো জোরে...এ এ...’ সোনামাসি পিনুমাসি দুজনেই হাত তালি দিয়ে বলছে।। ‘ঐ ঢিপির ওপারে কখনো যাবে না মুনিয়া’! ‘কেন’? ‘ওখানে গেলেই ...’, ওপারে গেলে যে ঠিক কি, তা আর বাবা বলেন না। মুনিয়াও বন্ধুদের বলে, ‘ওপারে কক্ষনো যাবি না...’। -- রিনা বলে, ‘ভিতু, ভিতু। ভিতুর ডিম’। নূপুর শুধু সঙ্গে থাকে, ‘না মুনিয়া কক্ষনো যাবো না’। ‘শিবঠাকুর, রিনা নূপুরকে ভালো রেখো, ওরা কিচ্ছু বোঝে না’। সব বোঝে একা মুনিয়া।
মুনিয়া ঢিপি ছুঁয়ে ফিরে আসছে। নীলমাঠের ওপ্রান্ত থেকে। অমলকাকুও প্রায় কাছাকাছি। আরো জোরে... সোনা মাসির সেই আশ্চর্য জিনিসটা পেতেই হবে।
সেই মুনিয়া, বছর বাইশ পরে নীলমাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে চশমা, লম্বা বেণী পিঠে। সাদা শাড়ির কালো পাড়ে বিকেল ডুবছে। নূপুর ক্লাশ এইটেই এক বিদঘুটে জ্বরে মারা যায়, রিনা ক’দিন আগে ক্যান্সারে ভুগে। মুনিয়া স্কুলে পড়ায়। ফিরতি পথে আজ হঠাৎ মন হলো নীলমাঠে এসে দাঁড়াতে। এ অবস্থায় না কি অদ্ভুত সব ইচ্ছে জাগে, দিদান বলেছিল। রঙ্গনকে কখনো এখানে নিয়ে আসা হয়নি। এত সময় কোথায় ওর! কোথায় কোন্ সেমিনারে নৃতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশনে ব্যস্ত। মুনিয়ার খুব দৌড়তে ইচ্ছে করছ। ঢিপিটা আর নেই। উর্বর পলি ভেঙে ভেঙে ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে গেছে। ঢিপির ওপার বলে আর কিছু নেইণ। আমবাগান নেই। কবরখানার গেটে এখন সরকারি পাহারাওয়ালা। টুরিস্ট স্পট হিসেবে না কি গড়ে তোলা হবে জায়গাটা। মুনিয়া পায়ের চপ্পল খুলে ঘাসে পা রাখে। ‘এ সময়ে ভর সন্ধে মাথায় নিয়ে যেখানে সেখানে যেতে নেই মুনিয়া’, মা বলেছেন। একটি বার ও দৌড়তে চায়। সোনামাসি পিনুমাসি অমলকাকুরা কোথায়, কে জানে! কিন্তু দৌড়ে ফিরে আসতে পারলেই যেন ও পেয়ে যাবে কোনো আশ্চর্য জিনিস। মুনিয়া বেড় দিয়ে কোমরে আঁচলটা জড়ায়। বেশ অসুবিধে হচ্ছে। আর হয়তো দুটো মাস।
‘মুনিয়া, মুনিয়া পাখি, দৌড়ে ঐ মাঠ পেরিয়ে ঘাট পেরিয়ে উড়ে যা...’, কারা যেন বলছে। কাঁধের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ নামিয়ে রাখে ঘাসের ওপর। ডানা মেলে উড়ান দেবে এবার। পিনুমাসি যেন বলছে ‘রেডি ...গো’। আহ্। একটা ছোট্ট পায়ের ধাক্কা, পর পর দু’বার। আরেকটা ছোট্ট মুনিয়া ডানা ঝাপটাচ্ছে, ভেতর থেকে ছোট্ট পায়ে লাথি মারছে। বসে পড়ল মুনিয়া। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। দেখতে পাচ্ছে – ও দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, ওর হাতে তৈরি করা ফ্রক পরে আরেকটা মুনিয়া দৌড়ে পার করে ফেলছে নীলকুঠির মাঠ। তার সামনে কোনো উঁচু ঢিপি নেই। সব পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে আরেকটা মুনিয়া পাখি...
লিপিকা ঘোষ
‘মুনিয়া, আমাদের মুনিয়া পাখি–ই, যা তো এক দৌড়ে ঐ উঁচু ঢিপিটা ছুঁয়ে ফিরে আয় তো; যে আগে আসবে সে পাবে এক আশ্চর্য জিনিস’
সোনা মাসির বর তাল-ঢ্যাঙা অমলকান্তি কাকু। মেসো না হয়ে কেন কাকু হলো, তা বুঝে পায় না ছোট্ট মুনিয়া। সেই অমলকাকু আর মুনিয়া দৌড় দৌড়... পিনুমাসি হাততালি দিচ্ছে, ‘আরও জোরে মুনিয়া...’। সোনা মাসির সদ্য বিয়ে হয়েছে। অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি এসে এদিক ওদিক ঘুরতে বেড়িয়েছে। বেড়ানোর সবচেয়ে ভালো জায়গা নীলকুঠির মাঠ। কাছেই ওয়ারেন হেস্ট্রিংস-এর বউ মেয়ের কবরখানা। মুনিয়ার এক কবর থেকে আর এক কবরে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা করার জায়গা। বাবা গোখরো সাপের ভয় দেখান। মা বলেন ‘গায়ে কোন্ হাওয়া বাতাস যে লাগবে মেয়েটার! মুনিয়া ভাবে, গোখরোটা যদি মণি মাথায় করে বেরিয়ে আসে আর ফণা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে ও ঠিক মণিটা তুলে নিয়ে দৌড় লাগাবে।
মুনিয়া দৌড়চ্ছে, ঢ্যাঙা অমলকাকু লম্বা লম্বা পা ফেলে পাল্লা দিচ্ছে। মুনিয়ার কমলা ফ্রক উড়ছেণ। সব ফ্রক ও’র মা নিজের হাতে তৈরি করেন। সেলাই মেশিন ছাড়াই। এ নিয়ে মুনিয়ার অহংকারের শেষ নেই। ‘আমার মায়ের হাতে তৈরি করা জামা, জানিস!’ বন্ধুদের হেরে যাওয়া মুখগুলো দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। হাওয়ায় ভাসছে মুনিয়া। নীল কুঠির মাঠ। লোকের মুখে ‘নীল মাঠ’। নীলকর সাহেবদের না কি বাস ছিল হেথায়। তারও আগে না কি এটা-ই ছিল জাহাজ ঘাটা। বন্দর। জাহাজ ভিড়ত এসে। তারপর সাহেবরা গঙ্গা কেটে এখানে ‘কাটিগঙ্গা’ ফেলে রেখে যায়। জাহাজঘাটা শুকিয়ে মাঠ হয়। ঐ যে আমবাগান! ওখানে নীল সাহেবদের কুঠি ছিল। মাটি খুঁড়লেই ভাঙা দেওয়ালের সারি। পরশুর আগের দিনই, কিছু দূরের ধ্বসে পড়া জৈন মন্দির-এর চূড়োয় বসানো ঘটটা না কি নিরেট সোনার! কিছু আবিষ্কার করে ইতিহাস বই লেখেন, এমন এক মস্ত কেউ অনেক পুলিশ সঙ্গে করে এসেছিলেন। ওমা, মন্দিরের ঐ জৈন ঠাকুরের চেয়েও দামি না কি ওই ঘট! ‘ওদের তুমি ক্ষমা করে দিও শিবঠাকুর, ওরা কিচ্ছু বোঝে না’।যেন সব বোঝার দায় একা মুনিয়ার।
কাছেই ভাঙা মাথার এক শিব মন্দির, সতীদাহ ঘাট। ওর দিদান সব গল্প বলে। সতী মানে তো খুব ভালো মেয়ে, যারা একটুও দুষ্টুমি করে না। তা হলে! মুনিয়ার মাথায় কিচ্ছু ঢোকে না। ভয় করে খুব। ও কক্ষনো ভালো মেয়ে হবে না, ঠিক করেছে।
‘মুনিয়া, মুনিয়া পাখি আরো জোরে...এ এ...’ সোনামাসি পিনুমাসি দুজনেই হাত তালি দিয়ে বলছে।। ‘ঐ ঢিপির ওপারে কখনো যাবে না মুনিয়া’! ‘কেন’? ‘ওখানে গেলেই ...’, ওপারে গেলে যে ঠিক কি, তা আর বাবা বলেন না। মুনিয়াও বন্ধুদের বলে, ‘ওপারে কক্ষনো যাবি না...’। -- রিনা বলে, ‘ভিতু, ভিতু। ভিতুর ডিম’। নূপুর শুধু সঙ্গে থাকে, ‘না মুনিয়া কক্ষনো যাবো না’। ‘শিবঠাকুর, রিনা নূপুরকে ভালো রেখো, ওরা কিচ্ছু বোঝে না’। সব বোঝে একা মুনিয়া।
মুনিয়া ঢিপি ছুঁয়ে ফিরে আসছে। নীলমাঠের ওপ্রান্ত থেকে। অমলকাকুও প্রায় কাছাকাছি। আরো জোরে... সোনা মাসির সেই আশ্চর্য জিনিসটা পেতেই হবে।
সেই মুনিয়া, বছর বাইশ পরে নীলমাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখে চশমা, লম্বা বেণী পিঠে। সাদা শাড়ির কালো পাড়ে বিকেল ডুবছে। নূপুর ক্লাশ এইটেই এক বিদঘুটে জ্বরে মারা যায়, রিনা ক’দিন আগে ক্যান্সারে ভুগে। মুনিয়া স্কুলে পড়ায়। ফিরতি পথে আজ হঠাৎ মন হলো নীলমাঠে এসে দাঁড়াতে। এ অবস্থায় না কি অদ্ভুত সব ইচ্ছে জাগে, দিদান বলেছিল। রঙ্গনকে কখনো এখানে নিয়ে আসা হয়নি। এত সময় কোথায় ওর! কোথায় কোন্ সেমিনারে নৃতত্ত্ববিদ্যা নিয়ে গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রেজেন্টেশনে ব্যস্ত। মুনিয়ার খুব দৌড়তে ইচ্ছে করছ। ঢিপিটা আর নেই। উর্বর পলি ভেঙে ভেঙে ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে গেছে। ঢিপির ওপার বলে আর কিছু নেইণ। আমবাগান নেই। কবরখানার গেটে এখন সরকারি পাহারাওয়ালা। টুরিস্ট স্পট হিসেবে না কি গড়ে তোলা হবে জায়গাটা। মুনিয়া পায়ের চপ্পল খুলে ঘাসে পা রাখে। ‘এ সময়ে ভর সন্ধে মাথায় নিয়ে যেখানে সেখানে যেতে নেই মুনিয়া’, মা বলেছেন। একটি বার ও দৌড়তে চায়। সোনামাসি পিনুমাসি অমলকাকুরা কোথায়, কে জানে! কিন্তু দৌড়ে ফিরে আসতে পারলেই যেন ও পেয়ে যাবে কোনো আশ্চর্য জিনিস। মুনিয়া বেড় দিয়ে কোমরে আঁচলটা জড়ায়। বেশ অসুবিধে হচ্ছে। আর হয়তো দুটো মাস।
‘মুনিয়া, মুনিয়া পাখি, দৌড়ে ঐ মাঠ পেরিয়ে ঘাট পেরিয়ে উড়ে যা...’, কারা যেন বলছে। কাঁধের শান্তিনিকেতনি ব্যাগ নামিয়ে রাখে ঘাসের ওপর। ডানা মেলে উড়ান দেবে এবার। পিনুমাসি যেন বলছে ‘রেডি ...গো’। আহ্। একটা ছোট্ট পায়ের ধাক্কা, পর পর দু’বার। আরেকটা ছোট্ট মুনিয়া ডানা ঝাপটাচ্ছে, ভেতর থেকে ছোট্ট পায়ে লাথি মারছে। বসে পড়ল মুনিয়া। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। দেখতে পাচ্ছে – ও দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, ওর হাতে তৈরি করা ফ্রক পরে আরেকটা মুনিয়া দৌড়ে পার করে ফেলছে নীলকুঠির মাঠ। তার সামনে কোনো উঁচু ঢিপি নেই। সব পেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে আরেকটা মুনিয়া পাখি...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন