কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৩

০৩ দেবতোষ দাশ

ঋতুচক্র
দেবতোষ দাশ
কথায় কথায় যাঁরা রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করেন, তাঁদের বেশ বিরক্তিকর লাগে। শিল্পীর মৃত্যুর সত্তর বছর পরেও, তাঁর সম্পর্কে একটিও নতুন কথা না বলে, কেবল পুনরাবৃত্তি করাটা এক ধরনের মৌলবাদী অশ্লীলতাও বটে। আত্মজীবনী, দু-একটা চিঠি, গোটা তিনেক নাটক, খানকতক কবিতা, সাড়ে তিনখানা গপ্পো (মূলত যেগুলো সিনেমা হয়েছে), আর একগুচ্ছ গান (বড়জোর খানকুড়ি) –- রবিবাবুর বিপুল সৃষ্টি থেকে এইটুকুই তাঁদের মূলধনী ফুটানি। বেশ কিছু বাচাল বাঙালি এভাবেই অশ্লীলভাবে অথচ বিরাট আত্মগব্বে বেঁচেবর্তে আছে। তবে এই রবি-পাঁচালি পাঠে এমনও কেউ থাকেন, যিনি ভাবনার দ্যুতিময়তায় চমকে দিতে পারেন, পুনরাবৃত্তির থোড়-বড়িকে বাতিল করে নতুন কোনো অর্থের উদ্ভাস ঘটাতে পারেন –- যেমন এর অন্যতম নিদর্শন ঋতুপর্ণ ঘোষ।

বিশ বছর আগে ‘হীরের আংটি’ ও ‘উনিশে এপ্রিল’ দেখে কিঞ্চিৎ ইশারা ও ইঙ্গিত টের পেয়েছিলাম যে, এমন কেউ বাংলা সিনে-দুনিয়ায় আসতে চলেছেন, যিনি দুধে-ভাতে বং 'বই'-এর বাইরে সত্যিকারের আভাঁগার্দ ফিল্ম বানাতে পারবেন, আজ নয় কাল। সচেতনভাবে ন্যারেটিভ ভেঙে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে পারবেন দর্শককে। কালক্রমে আমার সে আশা ফুটিফাটা হয়েছে, আমার ব্যক্তিগত আশ হয়তো মেটেনি, কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে, ঋতুর কাজে তাঁর একটা সিগনেচার ছিল। বাক্স-অফিসের তোয়াক্কা না করে, গত বেশ কয়েক বছর অন্য-যৌনতাকে প্রশ্রয় দিয়ে ছবি বানিয়ে নিজেকে বিপন্ন করে তুলতেও যে ধক লাগে, ঋতুর তাও ছিল। তিনি নিজেও জানতেন, বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচশো ফিল্মের মধ্যে তাঁর কোনো ছবি জায়গা পাবে না, ফিল্মমেকার হিসেবে তিনি বিরাট কোনো সাফল্য পাবেন না; কিন্তু দুঃস্থ, আলুভাতে বাংলা ছবিকে সাবালক করার ইতিহাসে তাঁর নামটি থাকবে।

কিন্তু ঋতুর অনন্যতা অন্যত্র –- তিনি কেবল একজন চিত্রপরিচালক নন, তিনি মাত্র একজন খণ্ড বুদ্ধিজীবী নন, তিনি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির এক বিরল তার্কিক মেধা, এক সংবেদনশীল মানুষ, যাঁর সঙ্গে দু-দণ্ড ঝগড়াহীন আলোচনা করা যায়, তর্ক করা যায়। ঋতুর বিরল সাহিত্যবোধই তাঁকে সৃষ্টিশীল করেছে, মৃত্যুর পর সৌমিত্রবাবুর এই যথার্থ উপলব্ধিটাই বারবার কানে বাজছে। অবিরল ঋতু-পাঁচালির মাঝে দামি ঠেকেছে। রবীন্দ্রনাথ ও মহাভারত প্রায় যেন অবসেশন, এমনই মগ্ন পাঠক তিনি। কুরোশোওয়ার 'রান'-এর অতলান্ত খাদের দৃশ্যে তিনি খুঁজে পান রবীন্দ্রনাথ। গান্ধারী যখন ধৃতরাষ্ট্রের কাছে যান, পিটার ব্রুক কোনো অলৌকিক ব্যঞ্জনায় নেপথ্যে ব্যবহার করেন রবীন্দ্রনাথের ‘ফাল্গুনী’ নাটকের গান-- “ধীরে বন্ধু, গো, ধীরে ধীরে চলো তোমার বিজনমন্দিরে” –- আবিষ্কার করে তিনি মোহিত হন।

ঋতুচক্র সম্পূর্ণ হলো না, কারণ বিশ বছরের ক্রিয়েটিভ জীবন বৃত্তরচনার পক্ষে যথেষ্ট নয়, আরও বিশ বছর সৃষ্টিশীল থাকলে হয়তো আমার সাধ মিটতো, ঋতু বানিয়ে ফেললেও ফেলতে পারতেন ন্যারেটিভ তহেস-নহেসকারী বাংলা ছবি। ইঙ্গিত ছিল, সত্যিই ছিল। যে ভাবনার দ্যুতিময়তা দিয়ে নিবন্ধটি শুরু করেছিলাম, এদিক ওদিক সেই সব স্পার্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাঁর টুকরো লেখায়, সাক্ষাৎকারে। ২০০০ সালে মিলেনিয়াম-মাতামাতির কালে এক প্রশ্নের জবাবে ঋতুর উত্তর-স্ফুলিঙ্গ আমার পায়ের পাতা থেকে সেরিব্রাল-অর্ধগোলক পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিতে পেরেছিল। প্রশ্ন ছিল, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ভারতীয় নারী আপনার মতে কে? ঋতুর উত্তর ছিল –- রবীন্দ্রনাথ!

2 কমেন্টস্:

  1. সত্যি ই ঋতুচক্র সম্পূর্ণ হোলো না। ঋতুর মত মেধাসম্পন্ন শিল্পী মানুষটির কাছ থেকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়া বাকি রয়ে গেল। নীতা বিশ্বাস।

    উত্তরমুছুন
  2. সত্যিই ঋতুচক্র শেষ হল না। ঋতুর মত মেধাসম্পন্ন শিল্পীর কাছ থেকে আরও অনেক রত্নভান্ডার... নাঃ, আমাদের দূর্ভাগ্য, আমরা পেলাম না। দেখার ওপারে আরো অন্যতর বীক্ষণপ্রতিভাটিকে আমরা অকালে হারালাম। ধন্যবাদ শ্রী দেবতোষ দাশকে, এই বিষয়টিকে কথণবিশ্বে আনার জন্য।

    উত্তরমুছুন