কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

শান্তিরঞ্জন চক্রবর্তী

 

সমকালীন ছোটগল্প


অপ্রকাশ্য

দেবদূত? সেটা আবার কে?

আরে বরোদা কন্ট্রাক্টরের খাদানে যে হি-ম্যান চেহারার ছেলেটা নতুন কাজে লেগেছে

আচ্ছা আচ্ছা, ধরণী ধরের পেয়িংগেস্ট তো?

হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ তুমি তো ধরনীর পাড়াতেই থাকো, চেনো না দেবদূতকে?

না, পরিচয় হয়নি এখনো, এই তো মাত্র কদিন হল এসেছেতবে হ্যাঁ, তুমি যে কথাটা বললে, যে হি-ম্যান চেহারা, এটা মানতে আমার একবিন্দু দ্বিধা নেইসত্যি ছেলেটা হ্যান্ডসাম, যে কোন মেয়ে প্রথম দর্শনেই ওর প্রেমে পড়ে যাবে

এই কথোপকথনের মধ্যেই জুটে গেল আর একজন এতক্ষণ কথা হচ্ছিল দিলীপ দে আর রথীন দাশের মধ্যে অতুল বিশ্বাস এসে জুটলো তাদের আড্ডায় বড়ই ছোট্ট শহরটা সন্ধ্যা হতেই বঙ্গতনয়দের আড্ডা জমে যায় কারো বসার ঘরে কিম্বা কোন দোকানের বেঞ্চে হ্যাঁ, তারা সংস্কৃতি চর্চাও করে তবে আড্ডাটা চাইই তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে আড্ডা বঙ্গ সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, আর আড্ডা হবে অথচ পরচর্চা হবে না তা আবার হয় নাকিঅতুল আবার হাঁড়ির খবর সংগ্রহ করার কর্মে অতুলনীয়পরিবেশন করার সময় যেমন হয় আর কি, একটু রঙের মিশেল তো দিতেই হয়তা সেই অতুল রসে ডুবিয়েই পরিবেশন করল খবরটিজানো কিনা তোমরা, ওই পেয়িং গেস্ট ছোকড়া আর গেস্ট হয়ে নেই, পরিবারের একজন হয়ে গেছেএই তো সেদিন শুনলাম, দেবদূত ধরণী আর তার বৌকে নিয়ে স্টিল সিটিতে গেছে ডাক্তার দেখাতে’, দিলীপ আর রথীন একযোগে প্রশ্নটা করল, ‘কেন, কি হয়েছে ধরণী ধরের যে একেবারে কোম্পানির হাসপাতাল ছেড়ে স্টিল সিটিতে যেতে হল’? শুনেছি কোন গাইনিকের  কাছে গেছে আবার দিলীপ আর রথীন চোখ কপালে তুলে বিস্ময়ের ঢেউ তুলল,‘গাইনিকের কাছে, তা আবার এ বয়সে! তা সে তো ফিমেলরা যায়, ধরণী কেন’? অতুল সবজান্তার মত বলল, ‘এইতো তোমাদের দোষ, বইপত্র পড়বেনা, জানবে কি করে, আগের দিনে সন্তান না হলে কেবল বৌদেরই হাড়িকাঠে চড়ানো হত, এখন আর সে দিন নেই, এখন এ ব্যাপারে কেবল স্ত্রী নয়, স্বামীর অক্ষমতাও কারণ হতে পারে দেবদূত, শুনেছি ইন্টার পাশ, তা ছাড়া কলকাতার ছেলে, জানে অনেক কিছু -ই নাকি ধরে বেঁধে ধরণীকে নিয়ে গেছে ডাক্তারের কাছে, বলেছে, ছেলেদের পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বয়স কোন ব্যাপারই নয় রথীন দাশ বলল,‘আরে সন্তান না হওয়া  নিয়ে রোজ দুজনের মধ্যে কথা কাটাকাটি, এ বলে তুমি দায়ী, ও বলে, তুমি দিলীপের প্রশ্ন,‘তা এতদিন ওরা কি করেছে তবে’? রথীনের জবাব,‘কি আর করবে, ধরণীকে তো জানই, সোজা সরল রোগাপটকা গোবেচারা মানুষ, ওই জড়িবুটি,তাবিজ কবচ করেই দিন কাটিয়েছে ওর বৌটার যে চেহারা, ধরণীকে পিষে ফেলে দিতে পারে তবে হ্যাঁ, মুখচোখে একটা পুরুষটানা ভাব আছে, দেখলেই মনে হয় দুটো কথা বলি,সেই অহংকারে বুঝি মেজাজটাও তেমনি রুক্ষ -ই ধরণীকে হাজার বার বলেছে দুজন মিলে চল ডাক্তারের কাছে যাই কিন্তু ধরণী বিশ্বাস্ করে না ডাক্তার কিছু করতে পারবে বলেরথীন দাশের কৌতূহলটা একটু বেশীমাত্রারজানতে চাইল, ডাক্তার কি বলেছেঅতুল ছদ্মরোষে চোখ পাকিয়ে বলল,‘খুব যে শখ জানার, তা যাওনা ওই দেবদূত কিংবা ধরণীকে জিজ্ঞেস করে জেনে নাও’! এবার একটু রহস্যের হাসি হেসে বলে,‘এসব গোপন কথা কেউ ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে বলে নাকি? কৌশলে কথা বের করতে হয়দিন যাক, এই অতুল বোসই তোমাদের সমস্ত খবর এনে দেবে

নাঅতুল বোসের অপেক্ষায় আর থাকতে হল নাএমন রসালো খবর পাঁচ কান হতে সময় নিল মাত্র দুদিনমেয়েমহলে খবরটা পড়তেই আর যায় কোথায়মেয়েদের আড্ডায় ধর দম্পতি আর তাদের পেয়িংগেস্ট দেবদূত এখন মুখ্য আলোচনার বিষয়ধরণী ধরের বৌয়ের খুব কাছের মানুষ নিশীথ পাকড়াশির মিসেসসে- কথায় কথায় একদিন উদ্ধার করল রহস্যটাআসলে ধরণীর কোন রকম অক্ষমতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, ডাক্তার বলেছে কিছু ভিটামিনের অভাবমাস  খানেক  ওষুধ  খেলেই ঠিক হয়ে যাবে আর মানে ধরগিন্নী তো পুরোপুরি সুস্থ এবং সন্তানধারণে সক্ষমআড্ডার এক মহিলা সদস্য বলে উঠলেন, ‘যাক বাবা, যে বয়সেই হোক, একটা সন্তান হলেই হলআর একজন আর এক ধাপ এগিয়ে গেলেন, ‘তা যা বলেছ,‘সন্তান সন্তান করে ওদের দুজনের মধ্যে রোজকার খেয়োখেয়িটা তো বন্ধ হবে! ওদের পাশের কোয়ার্টারের প্রমিলা বলছিল, এটা ওদের রুটিন ঝগড়া, রাত এগারোটা বাজল কি ঝগড়া শুরু যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়ছেরসবড়ার মত এমন রসভরা বিষয়ে দুটো কথা না বলতে পারলে রাতে ঘুমই আসবেনা এমন একজন যেন কত দামী কথা বলছে  একটা এহেন ভাব করে বলল, ‘ঝোগড়া হোবে না কেনো, ওদের দুজোনার উমরের ওন্তোর জানো  তোমরা? করীব পন্দর সালকা ধরণী বাবুকে তো বুঢঢা মোতন লাগে লেকিন উয়ার মিসেসকে দেখো, লাগতা হ্যায় বিশ সালকি লড়কি ধরণী আর তার স্ত্রীকে নিয়ে যত কথা আঁচলের খুঁটে বাঁধা ছিল সব  উজার করে দিয়ে যেন ভারমুক্ত হল কজনা তবে সেদিনের মহিলামহল শেষ হল কিন্তু  হি ম্যান চেহারার দেবদূত দত্তের গুণগাণ দিয়েসবাই একবাক্যে মেনে নিল, ‘ভাগ্যিস ছেলেটা চাকরির খোঁজে শহরে এসেছিল’!

ধরণী ধরের ঘরে এখন আনন্দ উপছে পড়ছে যেনধরণী কতবার যে দেবদূতকে ধন্যবাদ জানালো! বলল, ‘বয়সে তুমি আমার অনেক ছোট, তোমাকে বন্ধু না বলে ভাই বলব,

অবশ্য তুমি যা করলে আজ কোন ভাইও তেমন করে নাদেবদূত বিনয়ের হাসি হেসে বলল, ‘ কি যে বলেন দাদা! আমি আর কি করলাম, যা কিছু সে তো ওই ডাক্তার করেছেকৃতজ্ঞতা প্রকাশে এককাঠি এগিয়ে ধরণীবলল, ‘আর যা- হোক, এতদিনকার একটা ভয় আর অবিশ্বাস কাটিয়ে দিয়ে তুমি যে উপকারটা আমাদের করলে না, এজন্য আমরা দুজন তোমার কাছে সারা জীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আর শোন, আজ থেকে তুমি আর আমাদের গেস্ট ফেস্ট নও, আমাদের পরিবারেরই একজনআমি  আর তোমার বৌদি মিলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তুমি যে টাকাটা আমাদের দিচ্ছিলে এখন থেকে তার অদ্দেক করে দেবে, বাকীটা তুমি ব্যাঙ্কে জমাবেদেবদূত আপত্তি জানাতে গেলে মিসেস ধর যুক্তি দেখালো,  আহা , আপত্তি করছো কেন? নতুন কাজে ঢুকেছ, মাইনে তো খুব একটা বেশী কিছু নয়, তোমার তো কিছু সঞ্চয়ও দরকার’! দেবদূত ভাবল, তো খাসা প্রস্তাব,‌ তবে এত সহজেহ্যাঁবলে দিলে কি জানি কি ভেবে বসবেএত সহজেই যে ওদের চোখে এতখানি বিশ্বাসের পাত্র হয়ে উঠবে সে ধারণা ছিল না দেবদূতেরদুএকবার ছদ্ম অসম্মতি জানালো দেবদূতধরগিন্নি নাছোড়বান্দানাঃ, বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে গেলে এমন সোনার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে ভাবল দেবদূত, তবে  এবারও একটু ইতস্তত ভাব দেখিয়ে শেষমেশ বলেই ফেলল স্বভাবোচিত চাতুর্যে,‘না, ভেবে দেখলাম, তোমাদের কথা না মানলে তোমাদের ঈচ্ছাকে অসম্মান করা হবে তাই তোমরা যেমন বলেছ, তেমনই হবে

পঞ্চাশ পেরনো ধরণী ধরের কথাবার্তা ভাবভঙ্গী সব কিছুতেই এখন এক অদ্ভূত পরিবর্তন ধরা পড়ছে সকলের চোখেআপন পৌরুষের গর্বে সে যেন এক সদ্য বিবাহিত পঁচিশের যুবক  সে যে সন্তানের জন্মদানে সক্ষম এই ভাবনাটাই উজ্জীবিত করে তুলেছে তাকেতাদের রাত্রিকালীন বাগবিতন্ডা নিয়েও আর কোন অভিযোগ নেই কারও মুখেদেবদূতকে প্রশংসায় ভরিয়ে দিচ্ছে সকলেদেবদূতের বিনীত জবাব, ‘কি আর এমন করেছি আমিএকটা সন্তানের অভাবে দুজনের মধ্যে প্রতিদিনের মনোমালিন্য ঘুচে গেছে, এটুকুই তো’! ধন্য ধন্য করছে সকলে, ‘আহা! যেমন দেখতে, তেমন তার কথাবার্তা, সার্থক ওর দেবদূত নামটা

ধরণী, কলাবতী আর দেবদূত, এই তিনে মিলে একটি সুখের সংসার এখনএই সুখের সঙ্গে জুড়ে গেল আনন্দোল্লাস যখন কলাবতীর শরীরে প্রকট হল সন্তান সম্ভাবনার লক্ষণধরণী প্রতিদিন আধলিটার করে দুধের ব্যবস্থা করল কলাবতীর জন্য দেবদূত বলল, বৌদির জন্য ফলটা আমিই আনব ধরণী আপত্তি জানালে যুক্তি দেখায় দেবদূত, দেওর হিসাবে তারও তো একট কর্তব্য আছে বৌদির প্রতি! এ কথার ওপর আর কোন কথা খাটে না ফলে দুধে কলাবতী যেন আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছে দিন কে দিন পড়শিদের আনাগোনায় ধরণী ধরের কোয়ার্টার এখন সরগরম নিকট আত্মীয়রা খবর পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, কেউ কেউ মন্তব্য করল, যাক এতদিনে খরা কাটলো তবে

ধরণী ধর অতশত বোঝে নাসপ্তম শ্রেণীর বিদ্যা সম্বল নিয়ে কাজে ঢুকেছিল সে  ঘষতে ঘষতে যতটুকু হয়েছে তাতে আধুনিক চিকিৎসার খুঁটিনাটি বোঝা তার ক্ষমতায় কুলোবে না একথা সে অকপটে স্বীকার করে, তাই চেক আপের জন্য ডাক্তারের কাছে কলাবতীকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব  দেবদূতের উপর ন্যস্ত  করেই সে নিশ্চিন্তে আছেএই দায়িত্বটি পেয়ে রাম-দোসর লক্ষ্মণের মত দেবদূতও  যেন কৃতার্থ বোধ করছেকলাবতীরও চতুর দেবরটির উপর অসীম ভরসাডাক্তারের রিপোর্ট অনুযায়ী কলাবতী যথাসময়ে একটি সুস্থ সন্তানের জন্ম দিতে চলেছে এই খবরটি পেয়েই আনন্দে ডগমগ হয়ে উঠেছে ধরণীর মন

আর কয়েকদিনের মধ্যেই ঘর আলো করে আবির্ভাব ঘটবে সেই আকাঙ্ক্ষিত মানবকের যার প্রতীক্ষায় প্রতিটি মুহূর্ত রঙিন হয়ে উঠছে তারহ্যাঁ, ধরণী সমগ্র মনপ্রাণ দিয়ে চাইছে একটি পুত্রসন্তানএতে দুটো কাজ হবেএক, বংশরক্ষা আর দ্বিতীয়তঃ মৃত্যুর পর ছেলের হাতের আগুণ।  দেবদূতকে দিয়ে আগেভাগে একটি নামও ঠিক করে রেখেছে ধরণী, দেবপ্রিয়যদি সন্তান ছেলে না হয়ে মেয়ে হয়? চিন্তা কি? দেবপ্রিয় নামটাই এমন যে প্রিয় জায়গায় প্রিয়া লিখে দিলেই হয়ে গেল মেয়ের নামবাঃ! বাঃ’! চমৎকৃত ধরণীর কন্ঠে ঝরে পড়ে একরাশ বিস্ময়কত কি যে জানে দেবদূত! এই আনন্দঘন দিনগুলি সহসাই ছেয়ে গেল বিষাদের অন্ধকারে দেবপ্রিয় যেদিন খবরটি দিল যে তার অন্য একটি সংস্থায় ভাল মাইনের একটি চাকরী জুটে গেছেদেবপ্রিয় অবশ্য ধরণীকে এই বলে আশ্বস্ত করল যে, কলাবতীর ডেলিভারির পরই সে নতুন চাকরীতে যোগদান করবেশিশুটির মুখ দেখেই সে  ছাড়বে শহর

()

ডাক্তারের দেওয়া নির্ধারিত দিনের দুদিন আগেই প্রসববেদনা শুরু হল কলাবতীরশরীর ঠিক লাগছে না বলে ধরণীকে ছুটি নিতে বলেছে সেছুটি তো নিয়েছে ধরণী কিন্তু তার যে কোন অভিজ্ঞতাই নেই, একা সে কি করে সামলায় সব দিক! দেবদূত গেছে নতুন কাজের জায়গায় থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতেআশেপাশে এমন বিশ্বাসী কেউ নেই যার উপর পুরোপুরি ভরসা করা যায়দেবদূতের অভাব আজ বড় বেশী করে অনুভব করছে ধরণীএতদিন তার উপর সমস্ত দায়িত্ব চাপিয়ে নিজের অকর্মন্যতা কয়েকগুণ বাড়িয়ে নিয়েছে সেকি করবে ভেবে যখন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল, তখন কলাবতীই পথ দেখালবলল,দেবদূতকে ফোন করো না একটা, বড় দায়িত্ববান ছেলে, আমার অবস্থার কথা জানলে যেখানে যে অবস্থায় থাকুক, না এসে পারবে নাহলও তাইধরণীর ফোন পেয়েই ট্রেন ধরল দেবদূতপৌঁছেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া থেকে সব ঝক্কি বলতে গেলে একাই সামলালো কলাবতীর লক্ষ্মণ দেবরটিবয়সের বিবেচনায় সিজারিয়ান করেই প্রসব করানো হলনার্সের মুখে খবর এলো, পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছে কলাবতীধরণী আনন্দে পাগলপারা।  সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আশ মেটে না কলাবতীরপুত্রসমেত কলাবতী ঘরে ফিরে এলে একটি সোনার চেইন তার গলায় পরিয়ে দিল দেবদূতছোট্ট লকেটটায় মিনা করে লেখা দেবপ্রিয়ধরণী এক হাঁড়ি রসগোল্লা আগেভাগেই এনে মজুত রেখেছিল ঘরেএকের পর এক আসছেই পাড়ার লোকজনকি সুন্দরই না হয়েছে দেখতে, কতজন যে বলে গেল তার হিসেব নেইআনন্দে গদগগদ ধরণী ডায়াবেটিকের মুখে  পর্যন্ত একটি করে মিষ্টি গুঁজে দিয়ে তবে ছাড়ল

দিন চারেকের মাথায় দেবদূত জানাল, এবার তাকে জয়েন করতে হবে নতুন কোম্পানিতেধরণীকে কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ আর দেবপ্রিয়র কপালে একটি চুমু দিয়ে বিদায় নিল কলাবতীর কাছেযাবার সময় বিশেষ করে বলে গেল ধরণীকে, সে এখন সন্তানের পিতা, তাকে সন্তান এবং তার মা দুজনের ব্যাপারেই যথেষ্ট দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে হবেধরণী দেবদূতের হাত দুটি জড়িয়ে ধরে বলল, ‘নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে দেবদূত, অবশ্য আমার জন্য তো তুমি নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করতে পার না’! দেবদূত বাই-রোড যাবে কর্মস্থলেভাড়া গাড়ি গেটের বাইরে  দাঁড়িয়েড্রাইভার হর্ণ বাজাচ্ছে দেরী দেখেদেবদূত আশ্বস্ত করল ধরণীকে, ‘চিন্তা করো না দাদা, অসুবিধে হলে একটা ফোন মেরে দেবে, ব্যস, দেখবে ভাই লক্ষ্মণ হাজিরচোখে জল নিয়ে কলাবতী অনুরোধ রাখল, ‘আসবে কিন্তুধরণী দেখল একরাশ ধূলো উড়িয়ে তার দৃষ্টিপথ আচ্ছন্ন করে দেবদূতকে নিয়ে ছুটে চলে গেল গাড়িটা

()

দেবদূত চলে যাবার পর দুএক মাস যোগাযোগ রেখেছিল ফোন মারফৎতারপর নীরব হয়ে গিয়েছিল তার ফোন, আসা তো দূরের কথাকথায় বলে চাপের নাম বাবাজীধরণী ওই চাপের মুখেই ধাতস্থ হয়ে উঠেছে অনেকটাইদেখতে দেখতে কেটে গেল পাঁচটি মাসছেলের অন্নপ্রাশনের দিনও ধার্য হয়ে গেলসেই পুরানো নাম্বারে কতবার যে ধরণী চেষ্টা করলো দেবদূতকে ধরতে! না, ধরা দিল না দেবদূতধরণীর দিক থেকে কোনরকম ত্রুটি? ভেবে দেখল ধরণীনা, তেমন তো কিছু খুঁজে পেল না সে! তবে? প্রশ্নেরও জবাব নেই কোন

ফোন করেই ধরণী আমন্ত্রণ জানালো আত্মীয় পরিজন, বন্ধু বান্ধব সকলকেপাড়ার কোন একজনও বাকী পড়েনি নিমন্ত্রিতের তালিকায়ধরণীর আত্মীয়স্বজন বলতে গণাগুনতি কয়েকজনপ্রায় সকলেই উপস্থিত তাদের মধ্যে যে একজনকে পেয়ে ধরণী আহ্লাদে আটখানা সে আর কেউ নয়, ধরণীর মাসতুতো ভাই পলাশ, এক নামী গায়নেকোলজিস্টের আপ্ত-সহায়কধরণী যেন অকূল পাথারে কূল খুঁজে পেলবড় করিতকর্মা ভাইটিএসেই সমস্ত দায়িত্ব মাথায় তুলে নিল। ধরণী নৈশভোজনের আয়োজন করেছিলঅতিথিরা এল একে একেআপ্যায়নে বিন্দুমাত্র ত্রুটি রাখল না মাসতুতো ভাইটিদেখেশুনে সকলকে খাওয়ানো থেকে শুরু করে হাসিমুখে অতিথিদের বিদায় জানানো পর্যন্ত এতটাই নিখুঁত যে মনে হল যেন হসপিটালিটির কোর্স নিয়ে পড়াশোনা করে এসেছে সেদেবদূতের অভাব টেরই পেলো না ধরণী

শেষ ব্যাচটির ভোজনপর্ব শেষতাদের বিদায় জানিয়ে এবার ঘরের সকলের বসে পড়ার পালাকথা বলতে বলতে বেরিয়ে আসছে জনতাদের মধ্যে একজন, ওই খবর কুড়ানো অতুল আর কি, নীচু গলায় বলল বাকী সকলের উদ্দেশে। ‘এই তোমরা বাচ্চাটার চোখমুখ লক্ষ্য করে দেখেছ’? একজন বলল, ‘হ্যাঁ দেখেছি তো, খুব সুন্দর না’? প্রথমজন বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, ‘আরে ভাই, সুন্দর, সে কথা তো সবাই বলছে, আমি বলছি অন্য কথা’। একে তো অতুল, তাতে আবার অন্য কথাসকলের কান খাড়া তখন, কোন রহস্যের কথা শুনবে তারাভিতর থেকে ডাক পাড়ছে ধরণী মাসতুতো ভাইয়ের নাম ধরে, কিন্তু পুরো কথাটা শোনার জন্য সেও যে উৎকর্ণ হয়ে আছেরহস্যের বোমটি ফাটিয়ে সকলকে অবাক করে দেবে এই উত্তেজনায় কথাগুলো একটু জোরেই বলে ফেলল অতুল

আরে দেখনি বাচ্চাটার নাকচোখ আর মুখের গঠন! এমন কি চুলের কোঁকড়ানো ভাবটাও। দেবদূতের মুখখানা যেন কেটেবসানো’! খিক খিক কিছুহাসির আওয়াজ ভেসে এল। সন্দেহ দানা বাঁধল মাসতুতোর মনে

পরদিন আত্মীয়স্বজন সব একে একে বিদায় নিচ্ছেমাসতুতো ভাইয়েরও রিটার্ন টিকেট আজকের তারিখেইবাদ সাধলো ধরণী, ‘আবার কবে আসবি, আর দেখা হবে কিনা তার ঠিকানা নেই, দুটোদিন থেকে যেতেই হবে তোকে, আর ভাই তুই যা করলি আমার জন্য, একমাত্র দেবদূতের সঙ্গেই তার তুলনা চলে’। হ্যাঁ, আসার পর থেকে কতবার যে ওই নামটি ধরণীর মুখে শুনেছে মাসতুতো ভাই পলাশ তা গুণে শেষ করা যায় না, ব্যক্তির প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতার প্রকাশ দখতে পেয়েছে ধরণীর কথায়বলেছে, ‘জানিস পলাশ, দেবদূত দেবদূতের মতই এসেছিল আমার ঘরে পেয়িং গেস্ট হয়ে, তা না হলে তো আমার বাবা হওয়াটাই হত না জীবনে’।

ধরণীর আবদার আর নিজের সত্যটা জানার তাগিদে টিকেট ক্যান্সেল করিয়ে আবার দুদিন পরের বুকিং করে ফেলল পলাশসুযোগ খুঁজছিল, কখন ধরণী ঘরের বাইরে যাবেএল সে সুযোগ পরদিন, সকাল আটটায় ধরণী ডিউটিতে চলে গেলেবৌদি কলাবতী ধরণীর টিফিনের গোছগাছ করে দিয়ে এখন ছেলেকে নিয়ে ব্যস্তপলাশের দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই ফাইলটি যার মধ্যে জমা রয়েছে ধরণী আর কলাবতীর সমস্ত মেডিকেল রিপোর্টসন্ধানী চোখ আটকে গেল কাচের পাল্লা লাগানো একটি শেল্ফের উপরঅন্যকিছু কাগজপত্রের সাথে একটি ফাইল তো আছে সেখানে! অতি সন্তর্পনে পলাশ বের করে আনল ফাইলটিঅবাক হল পলাশমাত্র দুটি কাগজএকটি ধরণীর পুরুষত্ব পরীক্ষার রিপোর্ট আর অন্যটি একটি প্রেসক্রিপশন যাতে মামুলী কিছু ভিটামিন ট্যাবলেটের নাম লেখারিপোর্টটির উপর নজর বোলাতেই এক বিষম ধাক্কায় যেন অবশ হয়ে গেল সারা শরীর, কি দেখছে সে! তার দাদা ধরণী যে ডাক্তারি ভাষায় একজন ইম্পোটেন্ট পেশেন্ট অফ অলিগস্পারমিয়া, যার স্পার্ম কাউন্ট পনের  মিলিয়নের অনেক নীচেকি করবে পলাশ এখন, সত্যটা প্রকাশ করে দিলে ধরণী যে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবেনস্যাৎ হয়ে যাবে স্বামীস্ত্রী বিশ্বাসের ভিতজীবনটা হয়ে যাবে নরকতুল্যকিন্তু এই অপ্রকাশ্য সত্যের ভার নিয়ে কি করে সে মুখোমুখি হবে ধরণীর! এর চেয়ে ভাল, কোন এক অজুহাতে পালিয়ে যাওয়া, এবং তা ধরণী ফেরার আগেইবসের ফোন এসেছে, জরুরী দরকার, ঠিক সময়মত না পৌঁছতে পারলে চাকরীর ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে, এই কারণ দেখিয়ে বেরিয়ে পড়ল পলাশআর কলাবতী! না তার অনুরোধেও তেমন জোর ছিল না কোন। কে জানে সে কি চোখে দেখেছে সে পলাশকে!

ট্রেনে চাপার পর থেকে একটি ভাবনা বার বার ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে পলাশের মস্তিষ্কে-- অনৈতিকতার দায়ে দেবদূত আর কলাবতীকে কাঠগড়ায় একশবার দাঁড় করানো যায় ঠিকই কিন্তু তাদের সম্পর্কের জেরে ধরণীর মরুজীবনে  যে আনন্দময় এক মরুদ্যানের সৃষ্টি হয়েছে তাকেও কি অস্বীকার করা যায় কোনমতে?

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন