নামমাহাত্ম্য
বছর পঞ্চাশের এক প্রৌঢ় প্রতিদিন
একই ট্রেনে একই কামরায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরেন। কামরাটি ফাঁকাই থাকে। কিছুদিন পর, পরের
স্টেশন থেকে গড় বয়স পঁচিশ এমন জনা পনের একটি দল রোজ উঠতে থাকে। তারা নিজেদের মধ্যে
হাসি গল্প তাস খেলা খাওয়া এইভাবেই বাড়ি ফেরে, যেমন নিত্য যাত্রীরা করে থাকে। প্রৌঢ়ের
একটু অসুবিধা যে হয় না তা নয়, কিন্তু ছেলেগুলি কোনওরকম অসভ্যতা করে না। আস্তে আস্তে
দু-পক্ষের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। এখন তারা খুবই ঘনিষ্ঠ। প্রৌঢ় ভদ্রলোক শুধু দলটির সবার
নাম খেয়াল করেছিলেন – সুকান্ত সমরেশ গোপাল বিশ্বজিৎ রবীন্দ্রনাথ উত্তম ইত্যাদি। সবকটিই
ছেলেগুলি যে প্রজন্মের প্রতিনিধি সেই প্রজন্মের সাধারণ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের
অভিভাবকদের দেওয়া নাম। অর্থাৎ প্রৌঢ়টি বুঝেছিলেন যে তিনি ও ছেলেগুলি একই সামাজিক বর্গে
অবস্থান করেন। সেই দলে একটি ছেলের নাম ছিল গদাই। সে-ই ছিল ঐ ছেলেগুলির মধ্যে প্রান্তিক
শ্রমজীবী বর্গের একমাত্র সদস্য।
আমাদের নাম শুধু ব্যক্তিগত পরিচয়ই তুলে ধরে না, আরও অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়। স্বাধীনতার কাছাকাছি সময়ে নেতাজীর স্মরণে ও সম্মানে অনেকেরই নাম রাখা হয়েছিল সুভাষ। সাম্প্রতিক কালে নবজাতকের নাম আমফান বা ইয়াস রাখাও একই অনুভব বা যুক্তিতে। রবীন্দ্রনাথের কাছে নামকরণের অনুরোধ ও তাঁর প্রদত্ত নামের অনেক কাহিনিই আমাদের সাংস্কৃতিক গাথার অংশ। আবার সংস্কৃতির আঞ্চলিক প্রভাবও দেখা যায়। বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় শোনা যায় টুসু বা ভাদু নাম।
আমাদের নামের পরিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস লক্ষ্য করলে আমাদের সামাজিক পরিবর্তনের এক চিত্রও বুঝে নেওয়া সম্ভব।
একদা খুব ভারী ভারী ঝংকারবহুল নাম রাখার প্রচলন ছিল – নারী ও পুরুষ উভয়েরই। নাম বেশ বড়ও হত। সরোজনলিনী জ্ঞানদানন্দিনী নলিনীপ্রভা সূর্যনারায়ণ তপেন্দ্রভূষণ ইত্যাদি। পুরুষদের তো বটেই মেয়েদের নামেও একটি মধ্যপদ জুড়ে দেওয়া হত। অনেক সময় সবার নামে একই মধ্যপদ জুড়ে দেওয়া হত একটা পরিবারের নিজস্ব রীতি হিসেবে। এই রীতি বজায় থাকলে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া একটি পরিবারের শাখা-প্রশাখা-উপশাখার সদস্যরা ভুবনগ্রামের অপর প্রান্তে হঠাৎ দেখা বা পরিচয় হলেও, নামের সাদৃশ্যের কারণে নিজেদের একই পরিবারের অংশ বলে চিনে নিতে পারত হয়তো। কিছু সুবিধাও কখনও কখনও হয়ে যেতে পারে। একটি ঘটনার কথা বলি। আচার্য পদবির একটি পরিবারের একটি প্রজন্মের পুরুষদের সবার নামের সঙ্গে ‘বরণ’ যুক্ত ছিল। সেই পরিবারের এক সদস্য একদিন শিয়ালদহ থেকে শেষ কৃষ্ণনগর লোকালে তার যাবতীয় সমস্ত মূল শংসাপত্র ভুলে ফেলে রেখে কল্যাণীতে নেমে যায়। সেই ট্রেন কৃষ্ণনগর পৌঁছলে হাতে গোণা যে ক’জন যাত্রী ছিলেন, তাঁরা ব্যাগটা খুলে কাগজপত্রগুলির গুরুত্ব বুঝতে পারেন। ঐ বরণ ও আচার্য দেখে একজন অনুমান করেন যে কৃষ্ণনগরে তাঁর পরিচিত ঐ ধরনের নামের এক ব্যক্তির কোনও আত্মীয় হলেও হতে পারে ছেলেটি। তাঁর অনুমান সঠিক ছিল। শুধু নামের সাদৃশ্যের কারণে ছেলেটি অনেক ঝামেলার থেকে মুক্তি পায়।
প্রসঙ্গত, বাঙালি পুরুষরা নামের মধ্যপদ আলাদা করে লেখে। এটাই প্রায় স্বাভাবিক রীতি। কিন্তু সেটা কি ঠিক? মধ্যপদটিকে কি মূল নামের সঙ্গে সমাসবদ্ধ করে একসঙ্গেই লেখা উচিত নয়? যদিও ব্যক্তিনামের ক্ষেত্রে ব্যাকরণের ভুল কোনও গ্রাহ্য যুক্তি নয় সেইভাবে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি নাম করছি – বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ (ও ঠাকুর পরিবারের সবাই), অন্নদাশঙ্কর রায়, অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ। বাংলায় এঁরা কেউই যথাক্রমে নাথ শঙ্কর কুমার আলাদা লিখতেন না। এইসব এবং আরও অজস্র উজ্জ্বল মান্য উদাহরণ সামনে থাকা সত্ত্বেও আমরা প্রজন্মান্তর ধরে নাথ, চন্দ্র বা কুমার আলাদা লিখে যাচ্ছি।
নামের পরিবর্তনের এই যে গতিপথ, তা স্পষ্ট হবে যদি আমরা আমাদের সাহিত্যের চরিত্রদের নাম একটু খেয়াল করি।
বঙ্কিমচন্দ্র: ইন্দিরা মৃণালিনী শৈবলিনী উপেন্দ্র হরমোহন হেমচন্দ্র নবকুমার। রবীন্দ্রনাথ: উদয়াদিত্য তারাপ্রসন্ন মহেন্দ্র বিনয়ভূষণ গৌরমোহন শচীশ শ্রীবিলাস বিনোদিনী দামিনী হেমনলিনী। শরৎচন্দ্র: রাসবিহারী জগদীশ শ্রীকান্ত দেবদাস অন্নদা বিজয়া রাজলক্ষ্মী। এরপরে আমরা ধীরে ধীরে দেখব অমর সমর বিমল দীপক কল্পনা আরতি ইত্যাদি আমাদের ব্যক্তিনামে উঠে আসছে। হয়ে উঠছে সাহিত্যের চরিত্রও। চলাচলটি উভয়ত। দিলীপ তাপস অলোক প্রদীপ কৃষ্ণা রীতা – এইসব নামের সমারোহ আমরা দেখতে পাই এখনও আমাদের চারধারে। তারপরে, গত চল্লিশ বছরে একটা নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটে গেল আমাদের সমাজ-অর্থনৈতিক পরিসরে। নকশাল আন্দোলন, বামফ্রন্ট সরকারের সূচনা, টিভির ব্যাপক প্রসার। ঠিক তার অব্যবহিত পরেই মুক্ত অর্থনীতির হাত ধরে ও আরও কিছু সংযুক্ত কারণের যোগফলে মধ্যবিত্তের ক্রমেই উচ্চ থকে উচ্চত্তর বিত্তের সিঁড়িতে পদার্পণ; ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের (বহুবিধ কারণে) গজিয়ে ওঠা। সামাজিক বর্গের এক নতুন বিন্যাস গড়ে উঠল, হল শিক্ষার সার্বিক প্রসার। কম্প্যুটার খুলে দিল বিশ্বের দরজা, আমাদের জীবিকার যে আবহমান ব্যবস্থা ছিল, সেইখানে নিয়ে এল অনেকরকম বৈচিত্র্য। আমাদের ব্যবহারিক জীবনেও কিছু প্রভাব পড়ল। শিব নারায়ণ বিষ্ণু দুর্গা লক্ষ্মী এইসব দেবতাদের নামের বদলে আমাদের নাম অনেকটাই হয়ে উঠল ব্যতিক্রমী ও ভাষানান্দনিক। ফলে পিতামহ-প্রপিতামহের পাঁচ-ছয় অক্ষর থেকে বাবা-মায়ের তিন-চার এবং শেষ পর্যন্ত দুই, এমনকি এক অক্ষরের নাম নিয়েও এখনকার ছেলেমেয়েরা নার্সারি স্কুলে যাচ্ছে। তারা বড় হয়ে উঠছে ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর নাম নিয়ে। দুই বাংলার দুই নবীন কবির সন্তানের নাম যথাক্রমে আলপথ এবং শস্য। আহা! ধর্মের সংযোগহীন এইসব বাংলা শব্দ ক্রমেই নাম হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর সামাজিক তাৎপর্য নিয়ে ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই উপযুক্ত গবেষণা হবে। পিঠে ভারী ব্যাগের সঙ্গে অন্তত একটি ভারী নাম আর কচিকাঁচাদের বহন করতে হচ্ছে না। ১৯২৯ সালে প্রকাশিত ‘শেষের কবিতা’-য় রবীন্দ্রনাথ অবশ্য কেটির মাধ্যমে তার শুভসূচনাটি করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন