কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

জয়িতা ভট্টাচার্য

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৫


মুখবন্ধ

অভিসারকাল শেষে বিরহের কালবেলা এলো। লেখা আসছে না। কলম শুকিয়ে কাঠ। মন মরুভূমি। সুচিত্রা শেষ করতে পারেন না উপন্যাস। খসখস করে পাতা উড়ে যায়। স্বপ্ন দেখেন আধখোলা বই উড়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। হ্যামলিনের বাঁশি শোনা যায়, সমস্ত চিন্তাসূত্র চলে যাচ্ছে সরোবরে। অন্ধমায়া জড়িয়ে ধরেছে বিরাট এনাকোণ্ডার মতো। গিলে নিচ্ছে সমস্ত নতুন শব্দ। সুচিত্রার মনে নেই কিছু। শনশন হাওয়ার রাতে নিঃসীম বসে আছেন। কে যেন এক নারী সপসপে গায়ে শরীর ছুঁয়ে চলে গেল। চমকে তাকান। শুনশান জাতীয় সড়কের মতো জীবন পড়ে আছে। খসখসে পাতার কথারা। একজন আগুন্তুক। সাধু কি? দাড়ি-গোঁফের আড়ালে তীক্ষ্ণ উজ্জ্বল চোখ। একটা অস্পষ্ট ঘর। মলিন নিয়ন আলো। একটা সরু তক্তপোষে এক-পা ঝুলিয়ে বসে আছেন । সুচিত্রা দেখলেন জীর্ণ সেই শরীর যেন কুহক। কোথা থেকে এসেছিলেন কেউ কখনও জানতে পারল না। ফকিরবাবা, লোকে বলত। তারপর হঠাৎ অন্তর্ধান। কেউ কেউ বলত খুব সৌভাগ্যবান দেখা পেয়েছে কখনও তাঁর। ফকিরবাবা। কিছু আশ্চর্য কথা বলেছিলেন। গোপন। অদ্ভুত। অলৌকিক নয়। সব ভুলে যাওয়াকে আগের দিনে বলত বেব্ভুল। এখন কী যেন বলে...। স্মৃতিরা ভীষণ চঞ্চল উচ্ছল হলে কি স্কিজোফ্রেনিক? মনে জলছবি! এমন রাত। একা সুচিত্রার কোলে দুধের শিশু। মাসকয়েক  বয়স। দেড়শো বছরের পুরনো চারমহলা প্রাসাদ। ভঙ্গুর। রান্নাঘর কলতলা গেলে শ্বশুর-শাশুড়ি এসে পাহারা দিত। দুছর আগের টাটকা মৃত দুজন। সুচিত্রার সঙ্গে জীবন আর মৃত্যু বাসন্তি আর রূপনারায়ণ হয়ে মিশে একাকার। একথা ঠিক সুচিত্রা তাঁদের উপস্থিতি, তাঁদের অদৃশ্য ঘেরাটোপে নিরাপদ ছিলেন তাঁর জীবন্ত স্বামীর চেয়ে বেশি আশ্বস্ত।

কী লিখবেন সুচিত্রা! এই বিস্মরণের অধিকাংশ সত্য অথবা সত্যের আবরণে প্রাচীন কোনো মিথ্যার কথা... সবই ছাপা হবে, সুচিত্রা জানেন। সুচিত্রা জানেন এসব লেখা, লেখা নয়। জীবনে যা কিছু হবে যা হয়েছে সব পূর্ব হতেই লেখা আছে। নতুন কিছুই লেখার সাধ্য নেই। গাঢ় উপন্যাসের মতো রাত। দিনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা রাত। ডিলিট ডিলিট ডিলিট। আটকে আছে কার্সর। মোছে না ছবিটা। নার্সিংহোমের বাথরুমে ঢুকে মেঝেতে কোণায় পড়ে আছে তোবড়ানো রক্তমাখা মাংসপিণ্ড, তাঁরই সদ্য প্রসবিত মৃতকন্যা। তাঁরই সামনে  দিয়ে তাকে নিয়ে গেল কাপড়ে মুড়ে হিন্দুসৎকার সমিতি। তিনি পাথরের মূর্তির মতো একঠায় বসে। পৃথিবী  স্তব্ধ এবং সমাপ্ত সেদিনও ভেবেছেন। তারপর, সংস্পর্শহীন সম্পর্কহীন অধ্যায়ের ভেতর এক পড়ন্ত দুপুর। মুহূর্তের জৈবিকতন্ত্রের মতো... কাশী বিশ্বনাথের গলিতে কাঁচের চুড়ি, মণিকর্নিকাঘাটে আগুন চিরপ্রজ্জল। কল্পকাহিনির মতো সুচিত্রার কোলজুড়ে পুত্র এসেছে, আলো এসেছে আচমকা আটমাস পর। আর আজ এই পশ্চিম অবকাশে লাল সূর্যের আলো এসেছে তাঁর শরীরময়। সারাজীবন শেষে আশ্চর্য প্রণয়। শেষবার জীবন বলেছে যা লিখেছেন সব ভুল। অন্ধকার আলোর উৎস। দ্যাখো সেই অতিবৃদ্ধ ফকির তোমাকে দিয়ে যাচ্ছে সান্তাক্লজের গিফ্ট। প্রণয় এসে পূর্ণ করে দিচ্ছে আজীবনের তৃষ্ণা। অনন্ত আলোকরেখা। এই বিরহ সেই মহামিলনের ডাক। এখন উপন্যাসের পরিশিষ্ট শুধু লিখবেন সুচিত্রা। আনন্দযাত্রার কথা।  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন