কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৫ জানুয়ারী, ২০২৪

ইরাকের আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ বদর শাকির আল-সাইয়াব (১৯২৬-৬৪)-এর কবিতা

 

প্রতিবেশী সাহিত্য

                 

ইরাকের আধুনিক কবিতার পথিকৃৎ বদর শাকির আল-সাইয়াব (১৯২৬-৬৪)-এর কবিতা

 

(অনুবাদ : পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়)




 

কবি পরিচিতি : সুকুমার রায় বেঁচেছিলেন ৩৬ বছর আর ইরাকের কবি বদর শাকির আল-সাইয়াব ৩৮ বছর। দুই দেশের দুই মহান কবির স্বল্পায়ু জীবন আমাদের ব্যথিত করে। ভাবি এরা স্বাভাবিক বয়সে মারা গেলে সাহিত্যকে কতই না সমৃদ্ধ করতে পারতেন! আল-সাইয়াবের জীবনী থেকে যা বেরিয়ে আসে তা হলো জীবনের হাতেই তিনি সর্বদা ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন। ছেলেবেলা থেকেই মায়ের মৃত্যু আর কম বয়সে বাবার হাতে পরিত্যক্ত হওয়ার ফলে তাঁকে সর্বদা ভালোবাসা আর নিরাপত্তার খোঁজে নিয়ত থাকতে হয়েছে। কৈশোরে অনুভূত দৈহিক কদর্যতা এবং উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে প্রেমে ব্যর্থতা আর সামাজিক নিপীড়নে তাঁর সংবেদনশীলতার কারণে তিনি কম্যুনিষ্ট পার্টিতে যোগ দেন। ইতিমধ্যেই তাঁর রচিত কবিতা রোমান্টিক এবং বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। ইরাকি কবিতায় তিনি মুক্ত পদ্য ব্যবহার শুরু করেন, যার ফলে আরবিক কবিতায় এক নতুন আন্দোলন সূচিত হয়।

সরকারের বিরুদ্ধে তাঁর সংগ্রামের ফলে তিনি কর্মহীন এবং কারারুদ্ধ হন অনেকবার। এক স্বল্পকালীন স্বেচ্ছা-নির্বাসনের পরে তিনি কম্যুনিজম পরিত্যাগ করে বাড়ি ফিরে আসেন। বিবাহের পরেও তিনি সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারি রাখেন। তিনি বাস্তববাদী কবিতার মাধ্যমে আরব সমাজের সমালোচনা করতে থাকেন। ফলে অচিরেই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।

রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবকে তিনি স্বাগত জানান। কিন্তু রাজতন্ত্র উচ্ছেদের পরে রিপাবলিকান জমানার কম্যুনিজমের প্রতি পক্ষপাতকে আক্রমণ করেন। মৃত্যু আর পুনর্জন্মের মিথকে তিনি কবিতায় ব্যবহার করে ইরাক এবং আরব দেশগুলির প্রতি তাঁর মোহভঙ্গকে প্রকাশ করেছেন।

তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হন। তিনি জীবনের শেষ তিনবছর রোগ নিরাময়ের জন্য দেশ এবং বিদেশে থেকেছেন। সমাগত মৃত্যুর করুণ বর্ণনা সেই সময়ের কবিতায় ফুটে উঠেছে। তাঁর কাব্য আরব দুনিয়ার অস্থিরতার প্রতিফলন এবং তিনি এক নতুন আরবি কবিতায় এক নবদিগন্ত খুলে দেন। তাঁর বেশির ভাগ কবিতাই বেশ দীর্ঘ। তার মধ্যে থেকে তিনটি কবিতার অনুবাদ নীচে পরিবেশন করলাম।

 

 

আমি ভিনদেশি বলে

 

আমি ভিনদেশি বলে

ভালোবেসেছি ইরাককে

সে অনেক দূরে আর আমি এখানে

চাইছি তাকে কারণ তার... ডাকিঃ ইরাক

চিৎকার এক বিলাপ হয়ে ফেরে

বিস্ফোরিত প্রতিধ্বনি

ভাবি আমি বিশাল প্রান্তর পেরিয়েছি

এক ধ্বংসকামী পৃথিবীর দিকে

যা আমার চিৎকারের উত্তর দেয় না

গাছের শাখা নাড়ালে

শুধু ক্ষয় নীচে পড়ে

পাথর

ফল নয়- পাথর

প্রস্রবণগুলোও

পাথর, সতেজ বাতাসও

পাথর রক্তমাথা

পাথর আমার চিৎকার, পাথর আমার মুখ

আমার পা জঞ্জালের ওপর বয়ে যাওয়া বাতাস

 

কর্মের উৎপত্তি

 

ধন্য ঈশ্বর! প্লেগ ছড়িয়ে গেছে।

ধন্য ঈশ্বর! বেদনা প্রশমিত হয়েছে।

ধন্য ঈশ্বর! কিছু বিপর্যয় আভিজাত্যে পরিণত।

ধন্য ঈশ্বর! কিছু সর্বনাশা কাহিনী উদারতার নমুনা।

তুমি কি এই অন্ধকার দিয়েছো?

তুমি কি এই সৌন্দর্য দিয়েছো?

পৃথিবী কি বৃষ্টির শিশিরকে ধন্যবাদ জানিয়েছে?

আর মেঘ আবার বৃষ্টি না দিলে কি রুষ্ট হয়েছে?

অনেক মাস, ক্ষতগুলির গুরুতর কষ্ট ছিল?

ওরা শাণিত ছুরির মতো আমার কোমরে বিঁধেছে।

রোদ ঝলমল সকালেও বেদনা সীমাহীন।

মৃত্যুর পথে রাতও বেদনা ছুঁড়ে ফেলতে পারেনি।

আমি যদি চিৎকার করে বলতাম, ‘ধর্ম’।

 

ধন্য ঈশ্বর! অগ্নিপরীক্ষাগুলো সদ্য সিক্ত।

ক্ষতগুলো যেন প্রিয়তমার উপহার।

সাধারণত ওদের বুকে আলিঙ্গন করে ধরে রাখি।

আমার হৃদয়ের ওপর তোমার উপহার সর্বদা হাজির।

আমি অস্বীকার করি না তোমার উপহার গ্রহণযোগ্য।

আমি ক্ষত নিয়ন্ত্রণ করি আর প্রত্যাগমনকারীদের প্রতি চিৎকার করি!

দেখো! আমি এখানে! যদি পারো ঈর্ষা কর...

এগুলি প্রিয়তমার উপহার...

আগুন যদি আমার কপাল স্পর্শ করে,

আমি মনে করি আগুন মেশানো চুম্বন।

নিদ্রাহীনের সুন্দর আনুকুল্য আছে...

কারণ নক্ষত্রেরা মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তোমার আকাশ দেখি।

তোমার মহিমা আমার জানালা স্পর্শ করে মাথা ছোঁয়।

রাত বেশ সুন্দর, পেঁচার ডাক শুনি।

আর দূর থেকে আসা এক গাড়ির হর্ন...

আর পাশের বিছানা থেকে অসুস্থ রোগির দীর্ঘশ্বাস।

নিশ্চিত বা নিশ্চিত নই, এক নারীর স্বর কি...

সে শিশুকে তার পিতামহ-পিতামহীর গল্প শোনাচ্ছে...

অন্তহীন রাগের বনগুলি হলো মেঘ।

আপাতভাবে, ওরা আকাশের সম্মুখ বেশকে ঢেকে দিয়েছে।

ওরা তাকে সরাসরি চাঁদের দিকে পাঠিয়েছে...

যদি ‘কর্ম’ চিৎকার করে, তার আবেদন হবেঃ

ধন্য ঈশ্বর! তুমি ভাগ্যনিয়ন্তা।

তুমি এখনো লেখোনি নিরাময়ের তারিখ।

 

মদিরার পাত্র আর স্বপ্ন

 

এখনো হাতে পাত্র ধরে আছি,

হে শর্বরি, পানের সাথীরা কোথার হারিয়ে গেল?

পান করে চলেছি,

আর পান করে যাবো, যতক্ষণ তোমার বিস্তৃত দিগন্ত

টলমল না করে।

পূব দিক কুয়াশাচ্ছন্ন,

আর দেখা যাচ্ছে না, তাই,

পশ্চিম, কোথায় তোমার আলো?

কেন নক্ষত্ররা ডুবে আছে, বিষণ্ণতায়

তাদের আলোয়, আর ধূমকেতুরাও প্রায় তাই?

এখনো হাতে পাত্র ধরে আছি,

হে শর্বরি, পানের সাথীরা কোথার হারিয়ে গেল?

 

****

 

ঝাঁকে ঝাঁকে কামনারা সরাইখানায়,

যতক্ষণ না উপচে পড়ে।

তার দুটি লন্ঠন, এমন রক্তিম লাল,

মনে হয় আমাকে দুই হাত বাড়ায় লজ্জায়।

দুই হাত? বরং, রক্তমাখা ঝোরার মতো

বিস্ফোরিত হওয়া দুই মুখ।

মদিরা ভর্তি দুটি পাত্র,

দুটি হৃদয় নিঃসারিত প্রেমে আলিঙ্গনাবদ্ধ।

কিমবা লাল ফেঁসো হাতে দুই থাবা,

হৃদয় নিঃসারিত বলে দাবি করে।

 

****

 

হে শর্বরি, পা আমাকে কোন পথে নিয়ে যায়?

অন্ধকার কোন পথের বাঁকে?

যেন চেনা আমার সেই পথ;

সদ্য আমার স্বপ্নকে অন্ধকার করেছে।

মনে হয় তোমার ভয়ংকর ছুরির খাপ,

যা তুমি বার করেছো,

আর আমার রক্ত তার থেকে মুছে নিয়েছো।

সেই পথের পাশে,

ভগ্ন পদক্ষেপগুলো।

দেহগুলো দীর্ঘশ্বাস ফেলে,

নেকড়ের মতো।

 

এক সৌন্দর্যের নগ্নতা আমার তৃষা বাড়িয়ে দেয়;

সেই নগ্নতা পুরো পান করি।

আর জগতের মতো দু’চোখ দিয়ে

তাকে ধ্বংস করে নিজে বিনাশ হয়ে যাই।

তার মুখে প্রোথিত জ্বরের বিকার

কোনো ঝোপ বা শিশিরের ফুল নয়;

নিজের উত্তাপ দিয়ে এক ক্ষুধার্ত ঠোঁট যদি তাকে খোলে,

তার ওপর ছড়িয়ে যাবে এক ক্ষত।

তার পাপড়ির ওপর শিখা নাচে

আর দোলনের সঙ্গে রঙ মুছে যায়।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন