কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী




 

(২৭)            

একদিন মেহুলীর কথাটাই হৃদয়কে ফিরিয়ে দেয় বিশ্রুত। বলে, তুই আমার চেয়ে অনেক ভাগ্যবান, বন্ধু।

তাই নাকি? একটু অবাক হয়েই জানতে চায় হৃদয়।

হ্যাঁ, বন্ধু হ্যাঁ। তোর অনেক আছে। তোকে দেওয়ারও অনেক লোক আছে। তুই ভেবে দ্যাখ ছোটোবেলা থেকেই কত সুবিধে পেয়ে এসেছিস তুই। তোর টাকা-পয়সা আছে, নিজের বাড়ি আছে, নিজেকে তোর কিছুই করতে হয়নি। আর আমার কিছুই নেই। আমার নিজেরটা সবটাই আমাকে করে নিতে হয়। হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে।

অন্য কেউ হলে ব্যাপারটাকে স্রেফ ঈর্ষা বলেই উড়িয়ে দিত হৃদয়। কিন্তু এযে বিশ্রুত। এভাবে তো সে কখনও কথা বলে না। এমন বেসুরো কেন শোনায় তার গলা। একজন একজন করে তাকে ছেড়ে গেছে, আর বিশ্রুতকে তত জোরে আঁকড়ে ধরেছে হৃদয়। গত দশবছরে বিশ্রুতই তার জীবনের সবচেয়ে বড় অবলম্বন। প্রতিবার বিপন্ন হয়েছে হৃদয়, প্রতিবার সে ছুটে গেছে বিশ্রুতর কাছে।

বিশ্রুত শুধু বলেছে, আমি আছি।

ব্যাস! আর কী চাই হৃদয়ের? এই একজনই তো একশোজনের সমান। তবু হৃদয় বলে উঠেছে, মন ভেঙে যাচ্ছে বিশ্রুত...

আমি তো আছি, বিশ্রুত আবার বলেছে। কেউ থাক বা না থাক আমি আছি।

হৃদয় আশ্বস্ত হয়েছে। কিন্তু বিশ্রুত বদলে গেছে। আবার সে আগের মতো মিথ্যা বলতে শুরু করেছে। অনেক সময়ে অকারণে। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা বুঝতে পারত না হৃদয়। তার জীবনে বিশ্রুত এক দেবদূত। সে কখনও মিথ্যে বলতে পারে না। আর কেনই বা বলবে? হৃদয় তো তার কাছে কিছু গোপন করে না। বিশ্রুতই বা কেন করবে?

বিশ্রুতর সঙ্গে মেহুলীর সম্পর্ক অনেকদূর গড়িয়েছে, হৃদয় তা জানত না। জানতে পারল একদিন। সেদিনও বিশ্রুত মিথ্যা বলেছিল। হৃদয় জানত, ওর একটা জরুরি ট্রেনিং আছে। কিন্তু লঞ্চেই অনির্বেদের সঙ্গে ওদের দেখা হয়ে গেছিল। বিশ্রুত আর মেহুলী তখন সমুদ্রঘেরা একটা উপবনে যাচ্ছে। অনির্বেদের কাছ থেকেই ব্যাপারটা জানতে পারল হৃদয়।

পরে অনির্বেদ হৃদয়কে বলেছিল, বিশ্রুত খাঁচায় থাকার লোক নয়। খাঁচার মধ্যে ও অবিরাম মিথ্যা বলে। ওর সত্যিগুলো আসে ওর স্বাধীনতা থেকে। স্বাধীনতার কাছে ও সব সময়ে খাঁটি থাকার চেষ্টা করে। ফুলের বাগানটা ওর কাছে একটা খাঁচাই হয়ে উঠেছিল। তুই সেটা বুঝতে পারিস নি।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হৃদয় বলেছিল, গোটা দেশটাই একটা খাঁচা হয়ে উঠেছে। সেটা থেকে মুক্তি পেতেই ফুলের বাগানের স্বপ্ন দেখেছিলাম আমি...

অনির্বেদের ধারণাটাও কিন্তু পুরোপুরি সঠিক ছিল না। বিশ্রুত একদিন বলেই ফেলল মেহুলীকে, যত দিন যাচ্ছে, মানুষ হিসাবে তত ছোটো হয়ে যাচ্ছি আমি। নষ্ট হয়ে যাচ্ছি।

তাই নাকি? চমকে উঠেছিল মেহুলী।

ঠিক তাই। ফুলের বাগানে যখন ছিলাম, রোজ একটু একটু করে মানুষ হিসাবে ক্রমেই বড়ো হয়ে উঠছিলাম আমি। নিজেই সেটা টের পেতাম।

না না এটা তোর ভুল। ওরা তোকে এভাবে বোঝাত।

ওরা? না মোটেই না। এটা আমার নিজের অনুভূতি। নিজেই টের পেতাম। কতো বড়ো হয়ে উঠেছিলাম আমি! কোনওদিন ভাবিওনি নিজের সমস্ত ক্ষুদ্রতা, সঙ্কীর্ণতাকে চাড়িয়ে ক্রমশঃ আমি এভাবে বাড়তে থাকব আর নিজের ভেতরে একটা প্রচণ্ড শক্তি অনুভব করব। সেই শক্তিই আমাকে ঠেলে নিয়ে গেছে, আমাকে প্রেরণা দিয়েছে, নিজেকে আশ্চর্য করে আমি নিজের চোখের সামনেই আমি অন্য এক মানুষ হয়ে উঠেছি যাকে আমি জানতাম না। অন্যরা তার প্রশস্তি করত আর আমি মনে মনে তাকে শ্রদ্ধা করতাম। আঃ সেই মানুষটা ঠিকমতো গড়ে ওঠার আগেই তুই তাকে ভেঙে দিলি! নষ্ট করে দিলি! কোথায় গেল সেই মানুষটা? কোথায় হারিয়ে গেল? তাকে আর কোথাও খুঁজে পাই না যে। এ তুই আমার কী করলি? মেহুলী?

কেস স্টাডি ৪

Life being a game in which the cleverest wins, it was a matter of reading her opponent’s cards and of not showing her own. (Romain Rolland)

অতলান্তের চেহারা ছিল খুবই সাদামাটা। কিন্তু ওর কথায় ছিল জাদু। একদিকে তাযেমন ক্ষুরধার আর বুদ্ধিদীপ্ত, অন্যদিকে তেমনই কাব্যিক ও মর্মস্পর্শী। প্রথম থেকেই অত্যন্ত বিনীত ওর হাবভাব। যেন সামান্য টোকা দিলেই মাটিতে মিশে যাবে। এমন মানুষকে কে আর টোকা দেবে? বিশেষ করে, লোকের মন বুঝে চলার স্বাভাবিক প্রতিভা যার আছে। যে মানুষটি ঠিক যে কথাটি শুনতে চায়, তাকে ঠিক সেটাই বলতে ওর কোনও জুড়ি নেই। ও যেন লোকের মন পড়তে পারে। আর সেই অনুযায়ী যে যেমন তার জন্য ঠিক তারই উপযোগী করে স্ক্রিপ্ট লিখতে থাকে নিজের ভেতরে। শুধু তাই নয়, উপযুক্ত মুহূর্তে সঠিক শব্দের ব্যবহারেও ও অদ্বিতীয়। কখন কোন তাস ফেলতে হবে, কখন কোন তাস লুকিয়ে রাখতে হবে ও জানে। ও চুপচাপ অপেক্ষা করত। তারপর ঠিক সময়মতো মোক্ষম চালটি দিত। আর তাতেই আউট। আউট করার বলটি দেওয়ার সঠিক মুহূর্তের অপেক্ষায় ও থাকত। তারপর সঠিক মুহূর্তকে চিনে নিত নির্ভুলভাবে। যে মানুষকে ও টার্গেট করবে, এইভাবেই তাকে ও জিতে নিত। সেই লোকটির কিছুই করার থাকত না। যেন ঘোর লেগে যেত তার। এই মানুষের সাফল্য নিশ্চিত। এই মানুষের সাফল্যকে কে ঠেকাবে?

অতলান্তই ছিল হৃদয়ের জীবনের সবচেয়ে বড় গুগলি। কিছুই বুঝতে পারেনি সে। কিছুই টের পায় নি। নির্মাল্যর সঙ্গে এসেছিল অতলান্ত। নির্মাল্য খুব প্রশংসা করেছিল ওর। বলেছিল চমৎকার ছেলে। খুব প্রতিভাবান। তোর ভালো লাগবে।

অতলান্তের জন্য একরকম প্রতোক্ষাই করছিল হৃদয়। বুদ্ধি ও প্রতিভা আছে, এমন মানুষকে আবিষ্কার করার আনন্দই আলাদা। আর সত্যিই অতলান্তকে ভালো লেগে গেল হৃদয়ের। খুব বিনীত স্বভাব। বেশি কথা বলে না, আবার চুপচাপও থাকে না। যা বলে, বুঝেশুনেই বলে। যেটুকু বলে, লোকের শুনতে ভালো লাগে। বুদ্ধিদীপ্ত, আকর্ষণীয় সেইসব কথা। নিজেকে হিসেব করে খরচ করতে জানে এই ছেলে। শুধু শব্দের ব্যাপারে নয়, সমস্ত ব্যাপারেই। সামান্য খরচ করতে গেলেও প্রতিটা পয়সা গুনে গুনে বেশ কয়েকবার দেখে নিত অতলান্ত। তারপর সেটা খরচ করত। এই ব্যাপারটা হৃদয়ের চোখে লাগত। অভাব অনির্বেদেরও ছিল। কিন্তু সে কখনও এরকম করত না। কোনও খরচের ব্যাপার থাকলে সবার আগে সে-ই নিজের ভাগটুকু দিয়ে দিত। কাউকে বুঝতে দিতে চাইত না, তার কোনও অভাব আছে। তার আত্মসম্মানবোধ ছিল অত্যন্ত প্রখর। অতলান্ত ছিল ঠিক উলটো। সে সব সময়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চাইত তার কত অভাব। সে নিজের ভাগটুকু দিত সবার শেষে। সবাইকে অপেক্ষা করিয়ে। সবার সামনে সেটা বেশ কয়েকবার গুনে তবেই দিত। এমনভাবে দিত যাতে লোকের চোখে লাগে। তার অভাবটা সবাই টের পায়।

গোড়ার দিকে অতলান্ত একটু অনিয়মিতই ছিল। কিন্তু নির্মাল্যের কাছ থেকে সব খবরই সে পেত। আর তখনই সে একটু একটু করে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। নির্মাল্য সরে গেলেও সে ফিরে এল। আর আসতেও লাগল ঘনঘন। হয়ে উঠল নিয়মিত। হৃদয়কে সঙ্গে নিয়ে একদিন নিজের বাড়িতেও গেল অতলান্ত। খুব খাতির করলেন ওর মা আর বাবা। দোতলা বাড়ি। একতলায় একটাই ঘর। তবে ঘরটা খুব বড়ো। সেখানেই ওর মা ছবি আঁকা শেখান। ঘরের ভিতর দিয়েই সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। দোতলায় একটা ডাইনিং স্পেস, দুটো শোবার ঘর। একটা ওর মা-বাবার, একটা ওর নিজের। আর একটাই বাথরুম। প্রাচুর্যের চিহ্ন নেই ঠিকই, কিন্তু অভাবেরও তেমন চিহ্ন নেই। অন্তত ঠিক যেমন করে অনির্বেদদের বাড়িতে গেলে টের পাওয়া যায়। অথচ ওদের সবার মুখেই অভাবের কথা। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সবাই একই কথা বলে যায়। বিশেষত অতলান্তের বাবা চাকরি করেন না। এটা যেন কিছুতেই ভুলতে পারে না ওরা। নানা প্রসঙ্গে উল্লেখ করে।

(ক্রমশঃ) 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন