কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৩

সুবল দত্ত

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৭


ইশরা ডুব                          

দেরঙ্গ থেকে ধলভুমগড় প্রায় পাঁচমাইল। রোদ মাথায় রেখে খালি পায়ে কচি শিশু কোলে এতোটা পথ দেরঙ্গে আসা আর নদীতে ডুব দিয়ে ধলভূমগড়ে সাঁঝের আগে ফেরা, একি হাল বিয়ানো মায়ের সম্ভব? শুধু তাই নয়, ধলভূমগড়ের বিশাল কাঁকর ময়দান পেরিয়ে খাজরার কাছে দাপুনিয়াতে মাটির শিবমন্দিরে আসা আর বাচ্চাকে বটগাছের কোলে শোয়ানো। ওই বটগাছের নিচে ইশরাবুড়ির থান। বাসমতী অঝোরে কাঁদতে থাকে। পায়ের নিচে কাঁকর যেন ছুঁচ। শাশুড়ি গায়ে মাথায় হাত বোলায়। ‘কি করবিস গো। মা হয়েছিস, কষ্ট ত পোয়াতেই হব্যাক। ছা-এর মু জুঠি বলে কথা। একটুকু কষ্ট কর। তাও ত তুই উয়াকে গব্ভে ধারণ করিস নাই লো। কুড়াই পাওয়া ছেল্যা’।

বাসমতীর চোখের জল তত্ক্ষণাত্‍ শুকিয়ে যায়। গা গরম হয়ে ওঠে রাগে। শাশুড়ি সমবেদনা জানায়নি, উল্টে একটা শূল বিঁধে দিল বুকে। এমনিতেই বাসমতী ঠিক করেই রেখেছে ইশরাবুড়ির থানে দেবীকে অনুযোগ করবেই করবে। তুমি আমার সোয়ামিকে বাচ্চা পয়দা করার ক্ষমতা তো দিলে না, তবে ওর মায়ের মাথায় একটু সুবুদ্ধি দাও না কেনে? দিনরাত আমাকে বিনা দোষের দোষী করছে? আমার দোষ?

বাসমতীর বিয়ে হয়েছে ধলভূমগড়ের সরাক সম্প্রদায়ের পরিবারে। উড়িষ্যার এক গ্রামে থেকে বাপ খুঁজে খুঁজে এমন একটা পাত্রস্থ করেছে, যাদের সাথে জীবনযাপনের নিয়মকানুন মানতে প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে। শিশুকে অন্নপ্রাশনের আগে কংসাবতীর নদীতে ডোবাতেই হবে। একে বলে ইশরা ডুব।

বাসমতীর পা ফেটে রক্ত বেরচ্ছে। এতসব গঞ্জনা ঠোনা খাওয়ার পর ইশরা বুড়িমা জঙ্গলের ঝোড়ে ফেলে দেওয়া বাচ্চাটা উপহার তো দিয়েছে? আবেগে আপ্লুত বাসমতী দেখলো এত গরমে ঘাম ও ব্লাউজ ভেদ করে স্তনদুধ টপ টপ গড়াচ্ছে। দেবী থানে পৌঁছে বাসমতী সব কষ্ট ভুলে গেল। ইশরাবুড়ি ওদের কুলদেবতা। বটগাছের নিচে এক বড় শিলামূর্তি। তাতে তেল সিঁদুর কাজল আতপচাল মাখিয়ে পূজা হয়। পূজারী এক বাচ্চা বিয়ানোর ধাইমা। একটা খুঁটাতে মোরগ বেঁধে তাকে তেল হলুদ মাখিয়ে আতপচাল খই ও আটাভাজা খেতে দেওয়া হচ্ছে। বলি দেওয়া হবে। এবার বাচ্চাকে থানে শুইয়ে গড় করল বাসমতী। উঠে দাঁড়িয়েই বাচ্চা কোলে নিয়ে নদীর দিকে হাঁটা দিল। সধবা বাচ্চার মা পোয়াতি সবাই গান করতে করতে উলু দিতে দিতে তার পিছনে হাঁটতে লাগলো। ‘উলুকুটু ধুলুকুটু নলের বাঁশি/নল ভেঙ্গেছে একাদশী/আঁকবন ডাব বন/কুড়ি গুষ্টি বেড়া বন/কার পেটের দুয়ো/কার পেটের সুয়ো’।

বাসমতী নদীতে কোমর জলে নেমে বাচ্চাকে মাথার উপর উঠিয়ে ডুবকি লাগল। নদীতে খুব কম স্রোত। জলে দাঁড়ানো যায়। এবার বাচ্চার গা থেকে কাপড় সরিয়ে ওকে জলে ডোবানোর জন্যে তৈরি হল। নাক দিয়ে জল ঢুকে বাচ্চাটা যদি মরে যায়? যদি পিছলে পড়ে জলে তলিয়ে যায়? ভয়ে হাতদুটো অবশ হয়ে আসছে। পাড়ের উপর থেকে শাশুড়ির চিত্কার গালাগাল। বাসমতী চোখ বন্ধ করে বাচ্চাকে জলে চুবিয়ে সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিল। চোখ খুলে দেখল শিশুর মুখের আদল হুবহু তার স্বামীর।        

 

  

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন