দ্য হোয়াইট বেলুন: নৈর্ব্যক্তিক, প্রাপ্ত-বয়ষ্কদের পৃথিবীতে শৈশব
(অনুবাদ: অদিতি ফাল্গুনী)
শৈশব ও বড় হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা প্রাপ্তবয়ষ্ক শিল্পীদের সুযোগ করে দেয় পিছন ফিরে দেখার - একইসাথে শৈশবের অপাপবিদ্ধতা অথচ বড় হবার পথে প্রতিদিনের জীবনে স্বাধীনতা বা স্ব-শাসন ক্ষমতার অভাব কখনো কখনো তাই হয়ে ওঠে শিল্পের বিষয়বস্তÍ।
ইরাণী চলচ্চিত্রকার জাফর পানাহির প্রথম কাহিনী চিত্র ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ (বাদকোনাকে সেফিড- ফার্সি)-এ পানাহি একটি ছোট্ট বালিকার গল্প চিত্রায়িত করেন যে ইরাণের রাজধানী তেহরান শহরে একটি গোল্ডফিশ কেনার আশায় ঘুরছে এবং গোল্ডফিশ কেনার এই সংগ্রামে রাজধানীর পথে পথে বহু প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের সাথে তার দেখা হচ্ছে যারা হয় এই বাচ্চা মেয়েটিকে উপেক্ষা করছে অথবা তাকে সাহায্য করতে রাজি হচ্ছে না। পানাহির সিনেমায় এই ছোট্ট মেয়েটির একক দৃষ্টিকোণই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে একটি গোল্ডফিশ কেনার আশায় পার্থিব নানা ক্লেশে জড়িয়ে পড়ছে যেহেতু একটি শিশু ও তার চারপাশের ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরকার অসঙ্গতি এই ছবিটিতে বারবার পুনরুতপাদিত হয়।
ছবিটির প্রথম কয়েক মিনিটের ভেতরেই পানাহি তাঁর দর্শককে পারসিক বা ইরাণী বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ‘নওরোজ‘ বা নববর্ষের আগের তেহরানের প্রাণশক্তি ভরপুর রাস্তার আবহের ভেতর সফলভাবে স্থাপণ করেন। সিনেমার শুরুতে তাই পক্ষকাল ব্যপী এই পারসিক নববর্ষ বরণের অনুষ্ঠানের আগে ঘর-দোর সাজাতে ব্যস্ত ইরাণী জনতাকে দেখা যায় শহরের বাজার এলাকায় এলোমেলো ভাবে ঘুরতে, বিক্রেতারা চেঁচিয়ে কথা বলছে এবং নববর্ষ বরণের আবেগে উদ্দীপ্ত মানুষেরা শহরের পথে আবহ সঙ্গীতের সাথে সাথে হেঁটে চলেছে যতক্ষণ না আর পানাহির ক্যামেরা একজন তরুণী মা (এই চরিত্রে অভিনয় করেছেন ফেরেশতেহ সাদরে ওরাফেই) এবং তাঁর শিশুকন্যা রাজিয়েহ (এই চরিত্রে অভিনয় করেছে আইদা মোহাম্মদখানি)। রাজিয়েহ পাশের একটি দোকানে সাজানো একটি বড়সর আকারের গোল্ডফিশ মুগ্ধ হয়ে দেখে সেটি কিনতে চায়। আর তখনি এই সিনেমার কাহিনীতে মূল দ্বন্দ শুরু হয়। ছোট্ট রাজিয়েহ সুন্দর ও বড় আকারের গোল্ডফিশ কিনতে চাইলেও তার মা রাজি নন। যেহেতু সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারটির আর্থিক ক্ষমতা সীমিত এবং রাজিয়েহর মা মনে করেন যে ইতোমধ্যেই তাঁদের বাসায় যে ছোট্ট গোল্ডফিশটি রয়েছে, সেটাই যথেষ্ট। এই গোল্ডফিশ কেনা নিয়ে মা ও ছোট মেয়ের দ্বন্দ থেকেই পানাহি বয়ষ্কদের পৃথিবীতে শিশু ও বয়সীদের ভেতরকার ক্ষমতা-দ্বন্দ ফুটিয়ে তোলেন। বাচ্চাদের কাছে টাকা থাকে না এবং বাবা-মা‘র অনুমতি ছাড়া কোন কিছু কেনার স্বাধীণতাটুকুও তাদের থাকে না বলে ছোট মেয়েটি গোল্ডফিশ কেনার শখটুকু পূরণ করতে পারছে না। এছাড়াও পরিবারটিতে টাকা বিষয়টি বেশ মহার্ঘ বোঝাই যাচ্ছে, যা বয়ষ্কদের অন্য নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রয়োজন মেটাতে ব্যবহৃত হবে; নতুন গোল্ডফিশ কেনার জন্য রাজিয়েহ অনেক আব্দার করলেও শিশুটির এই সাধারণ আকাঙ্খাটুকু ছাপিয়ে বড়দের ভাবনা-চিন্তাই প্রবল হয়ে ওঠে।
চলচ্চিত্রে জাফর পানাহির হাতে-কলমে শিক্ষক আব্বাস কিয়ারোস্তমী যিনি আগে শিশুদের কেন্দ্র করে ‘হোয়্যার ইজ মাই ফ্রেন্ডস হাউস-১৯৮৭’ অথবা Ôহোমওয়ার্ক-১৯৮৯‘-এর মত ছবি নির্মাণ করেছেন, সেই কিয়ারোস্তমীই কিন্তÍ জাফর পানাহির এই ছবির স্ক্রিপ্ট লিখেছেন। সিনেমাটি যতই অগ্রসর হয়, ততই কাহিনীর এক পর্যায়ে রাজিয়েহর হাত থেকে তার টাকা বাচ্চা মেয়েটির অনুমতি ছাড়াই এক সাপুড়ের নিয়ে নেওয়া, অথবা যখন সে গোল্ডফিশের ন্যায্য দাম কত হওয়া উচিত এটা নিয়ে দোকানীর সাথে দামাদামি করে অথবা টাকাটি যখন আবার তার হাত থেকে একটি বন্ধ দোকানের শাটারের নিচে পড়ে গিয়ে তোলা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে, তখন শিশু হিসেবে রাজিয়েহর অসহায়তা তার ছোট্ট শরীরটির চারপাশ ঘিরে দীর্ঘতর বয়ষ্কদের শরীরের মাধ্যমে পরিচালক আরো মূর্ত করে তোলেন যদিও বয়সী শরীরগুলোও ফ্রেমে পুরোপুরি দেখানো হয়না। রাজিয়েহর অসহায়ত্ব নিয়ে তখন দর্শকের ভেতর এক ধরণের খারাপ লাগার বোধ তৈরি হওয়া শুরু হয়। এমন সব সময়ে ছোট্ট রাজিয়েহ কান্না শুরু করলে তাকে ঘিরে থাকা বয়ষ্কদের নিরুত্তাপ মুখভাব যেন রাজিয়েহকে উল্টো তার মন খারাপের জন্য পরোক্ষভাবে খানিকটা শাস্তিই দেয়। এভাবে পানাহি একটি অসহায় শিশুর দৃষ্টিকোণ থেকে চারপাশের প্রাপ্তবয়ষ্কদের দেখান। পানাহির সিনেমার মূল শক্তি বরং প্রতিদিনকার পার্থিব নানা দ্বন্দ্ব উপস্থানের মাধ্যমে মূর্ত হয়। এই সিনেমায় কেন্দ্রীয় চরিত্র রাজিয়েহ এবং তার গোল্ডফিশ কেনার আকাঙ্খায় প্রাথমিক ভাবে বাধা দানকারী মেয়েটির বাবা-মা’র ভেতর তীব্র লড়াই এখানে দেখানো হয়নি। সিনেমায় প্রাপ্তবয়ষ্করা (রাজিয়েহর বাবা-মা) যখন নতুন গোল্ডফিশ কেনার জন্য রাজিয়েহর আকাঙ্ক্ষা গুরুত্বকে প্রশ্ন করে (সিনেমাটি দেখার সময় এর দর্শকরাও এমন প্রশ্ন মনে মনে করতেই পারেন), তখন পানাহি (চলচ্চিত্রটির নির্মাতা) এবং কিয়ারোস্তমী (ছবিটির চিত্রনাট্য রচয়িতা) বরং শিশুটির এই চাওয়াকে বৈধ প্রমাণ করতে চান যেহেতু বহু শিশুই তাদের শৈশবের অপূরিত নানা আকাঙ্খা নিয়ে পরবর্তী জীবনেও অনুতাপ বোধ করে। Ôসোশ্যাল-রিয়েলিস্ট’ বা সামাজিক-বাস্তববাদী এই সিনেমাটির পরিচালনায় অনেক ক্ষেত্রেই পরিচিত বা নামী অভিনেতা-অভিনেত্রীর বদলে সাধারণ, অপেশাদারদের নেওয়া এবং কোন শ্যুটিং লোকেশন ব্যবহারের বদলে তেহরানের সড়ক বা বাজারের মত বাস্তব সব জায়গায় সিনেমাটি চিত্রায়িত করে পানাহি-কিয়ারোাস্তমী দেখান যে আধুনিক স্বল্প-বাজেট, স্বাধীণ চলচ্চিত্র নির্মাণের কৌশলগুলো ব্যবহার করেও কিভাবে চলচ্চিত্রের নাটকীয়তাকে সফল ভাবে ব্যবহার করা যায়।পানাহির জন্য ‘দ্য হোয়াইট বেলুন- ১৯৯৫’ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা যেহেতু পরবর্তী জীবনে সমাজে কম গুরুত্বহ সব চরিত্রদের নিয়ে তিনি আরো সিনেমা বানাবেন। এসব চরিত্রদের ভেতর রয়েছে ‘অফসাইড-২০০৬’ বা থ্রি ফেসেস-২০১৮। প্রাপ্তবয়ষ্ক এবং পুরুষ নিয়ন্ত্রিত পৃথিবীকে ছোট্ট মেয়ে রাজিয়েহর দৃষ্টিকোণ থেকে বলার গল্পের মাধ্যমে পানাহির মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গী আমরা বুঝতে পারি। এ সিনেমায় শিশুদের ছোট ছোট চাওয়া যে বড়দের চাওয়া-পাওয়ার মতই গুরুত্বপূর্ণ, সেটাই পানাহি প্রতিষ্ঠা করেছেন। যদিও বাস্তব জীবনে শিশুরা তাদের চাওয়া বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার গুরুত্ব খুব কম ক্ষেত্রেই পায়। গোটা সিনেমায় চারপাশের সব বড়রাই যেমন ছোট্ট রাজিয়েহর নানা সাহায্যের আব্দার বারবারই তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দেয়, পানাহি কিন্তÍ এই শিশু কন্যাটির জন্য দর্শক হৃদয়ে সহানুভূতি গড়ে তুলতে সক্ষম হন। রাজিয়েহর চেয়ে বয়সে সামান্য বড় তার ভাই আলী (এই চরিত্রে অভিনয় করেছে মোহসেন কাফিলি) বাড়ির বড়দের কাছে রাজিয়েহর চেয়ে আদৌ বেশি পাত্তা পায় না। সিনেমার শুরুতে তার বাবা তাকে ধমকায় শ্যাম্পুর বদলে ভুলে সাবান কিনে আনায় এবং বাবা বেচারা আলীর দিকে সাবানটা ছুঁড়েই মারেন। পরে রাজিয়েহ যখন গোল্ডফিশ কিনতে বাজারে ছুটছে, সেখানে ভাই আলীর সাথে তার দেখা হলে আলীর মুখে একটি আঘাতের চিহ্ন থেকে রাজিয়ে কিকরে এমন জখম হলো জাতীয় প্রশ্ন করলেও আলী এর কারণ তার বোনকে বলে না। কিন্তÍ এই একটি দৃশ্যর মাধ্যমে আলী হয় বাড়িতে বড়দের হাতে বা রাস্তায় অন্য কোন প্রাপ্তবয়সীর হাতে পিটুনি খেয়েছে এবং বড়দের পৃথিবীতে শিশুদের অসহায়তা পুনরায় তুলে ধরেন। পুরো কাজটি করা হয় আলীর গালের জখম চিহ্নটি কয়েকটি মিডিয়াম ও ক্লোজ শটের মাধ্যমে- বোনকে আলীর আর কিছুই ব্যখ্যা করে বলতে হয় না।
বাবা-মা‘কে অনেক অনুরোধ করে শেষমেশ দুই ভাই-বোন রাজিয়েহ ও আলীর একটি নতুন গোল্ডফিশ কিনে আনার ‘তোমান’ বা মুদ্রাটি যখন বাজারে বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি দোকানের ভূ-গর্ভস্থ কুঠুরিতে পড়ে যায়, তখন বারবার আশপাশের বড়দের কাছে সাহায্যের আবেদন করেও তারা ব্যর্থ হয়।গোল্ডফিশ কেনায় ব্যগ্র ছোট বোন রাজিয়েহর হাত থেকে তোমানটা অমন দূরূহ একটি জায়গায় পড়ে যাবার পর সেটা তোলা বা ছোট বোনকে সাহায্য করায় উন্মুখ বড় ভাই আলী যখন আশপাশে ছুটে যায়, এত তরুণ ইরানী সৈন্যকে দেখা যায় রাজিয়েহর পাশে বসে খোশ-গল্প শুরু করতে, যদিও রাজিয়েহ কথা বলতে অনিচ্ছুক ছিল। এই সিকোয়েন্সটি দীর্ঘ সব টেকের মাধ্যমে পানাহি ফুটিয়ে তোলেন যাতে দর্শক এই পারষ্পরিক সংলাপ ভাল ভাবে বুঝতে পারে এবং সৈন্যটির সাথে রাজিয়েহর জন্মশহর সহ আরো নানা ব্যবধান একটি সহজাত, কথোপকথনের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারে। এছাড়াও এই কথােপকথনের সময় ক্যামেরা খানিকটা দূর থেকে সৈনিকের পরণের উর্দির কাঠখোট্টা রং এবং সৈনিকটির দীর্ঘদেহের পাশে রাজিয়েহর ছোট্ট শরীর ও তার পরণের ঝলমলেতর পোশাকের বৈপরীত্যও স্পষ্ট করেন। একটি ছোট্ট বালিকা এবং তার চারপাশের প্রাপ্তবয়ষ্কদের এই বৈপরীত্য দ্য ফ্লোরিডা প্রজেক্ট-২০১৭ বা এইটথ গ্রেড-২০১৮-এর মত আরো কিছু সিনেমায় দেখা যায় যেখানে ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’-এর মতই নিচু স্বরের নাটকীয়তা ভরা ছবিতে বয়ষ্কদের ভুবনে ছোট মেয়েদের নিজ কর্তৃত্ব লড়াইয়ের প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
ছবিটার শেষ হয় যখন একটি কিশোর বেলুন বিক্রেতা তার বেলুন বইবার কাঠির শেষ প্রান্তে চ্যুইংগাম লাগিয়ে রাজিয়েহকে বদ্ধ দোকানের শাটারের নিচে ভূ-গর্ভ থেকে তার হারিয়ে যাওয়া ‘তোমান’ বা মুদ্রাটি তুলে দেয়। রাজিয়েহ এবং আলী তখন গোল্ডফিশ কিনতে পারে এবং নতুন বছর উদযাপনের জন্য বাড়ি ফেরে। ছবিটির শেষটি একটি আবেগপূর্ণ ইঙ্গিতের মাধ্যমে শেষ হয় যে শিশুদের ভেতর রয়েছে পারষ্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ যা বয়স্কদের নৈর্ব্যক্তিকতার পৃথিবীতে তাদের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে সাহায্য করে। দুই ভাই-বোন ও বেলুন বিক্রেতা কিশোরের ঐ হারিয়ে যাওয়া তোমান উদ্ধারের জন্য একসাথে কাজ করার দৃশ্যের মাধ্যমে খানিকটা দূরবর্র্তী প্রাপ্তবয়ষ্কদের সাথে শিশু-কিশোরদের পার্থক্যটি ভাল ভাবেই বুঝিয়েছেন পরিচালক। এছাড়াও সিনেমাটির শুরুতে বাড়ির বড় ও ছোটদের ভেতর দ্বন্দ খানিকটা কোমলভাবেই শেষ হয় যখন আলী ও রাজিয়েহ ভালয় ভালয় বাড়ি ফেরে এবং এতক্ষণ ধরে তারা দু’জন যা করেছে সেটা সিনেমায় প্রদর্শিত ভুবনে গুরুত্বপূর্ণ কি নয় সে বিষয়ে কোন সোচ্চার বক্তব্যও রাখা হয়নি। আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে পানাহির এই সিনেমায় এটাই দেখানো হয়েছে যে প্রাপ্ত-বয়ষ্কদের পৃথিবীতে কোণঠাসা শিশুরা মূলত: ভাল স্বভাবের এবং ছবিটির দর্শকেরাও শিশু-কেন্দ্রিক নানা নতুন শিল্পের আধেয় ও আধার প্রত্যক্ষ করতে পারে যেখানে নববর্ষ আয়োজনের চিরাচরিত প্রাপ্ত-বয়ষ্কদের হাতে শাসিত পরিবেশেও শিশুরা ঠিকই তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণে সক্ষম হয়।
পুনশ্চ:
১৯৯৫ সালে কানে ‘Prix de la Camera d'Or’ পুরস্কার-জয়ী এই সিনেমাটি ইরাণ সরকার পুরষ্কৃত হবার আগেই সিনেমাটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যামে জমা পড়া সিনেমার তালিকা থেকে প্রত্যাহার করতে চাইছিলেন। তবে ফেস্টিভ্যাল কমিটি সেই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন ও পরে ছবিটি পুরষ্কৃত হয়। গোটা ছবিটি ইরানের আদি অগ্নি-উপাসক সম্প্রদায় প্রবর্তিত বর্ষপঞ্জী অনুসারে উদযাপিত নববর্ষকে ঘিরে আজো ইরানীদের গভীর আবেগ পক্ষকাল ব্যপী এই নববর্ষ উদযাপনে তাদের জড়িয়ে থাকার বিষয়টি পারসিক সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের প্রবল সমর্থক পানাহির সিনেমায় এতটা উঠে আসায় সেদেশের ক্ষমতাসীন সরকারকে বিব্রত করেছিল। পানাহির সাথে এরপরেও নানা সময়ে সেদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের মতাদর্শিক লড়াই হয়েছে এবং গতবছর ইরাণের নারী আন্দোলনের সময় পানাহি আন্দোলনকারীদের সমর্থন দেবার জন্যও কর্তৃপক্ষের হাতে অযথা হয়রানির স্বীকার হন। ইরাণে পক্ষকাল ব্যপী ‘নওরোজ’ উদযাপনের প্রথম দিনে প্রতিটি ইরাণী পরিবারের টেবিলে আজো ‘হপ্ত সীন‘ বা ‘সাত ধরণের খাবার’ সাজানো থাকে। ছোট্ট রাজিয়েহ এই ‘হপ্ত সীন’ সাজানো টেবিলেই একটি সুন্দর ও নতুন গোল্ডফিশও বাড়তি চেয়েছিল। প্রকৃতির বার্ষিক পুনরুজ্জীবনের এই পনেরো দিন ব্যপী উদযাপনে ইরানের রাস্তায় রাস্তায় মুখে কালো রং মাখা ও লাল পোশাকের ‘হাজী পিরুজ’ যেন পশ্চিমা দুনিয়ার সান্টা ক্লাসের কথাই মনে করিয়ে দেয়। ইরাণী বা পারসিক পুরাণের বিনা দোষে নিহত, নিষ্পাপ রাজপুত্র তথা উদ্ভিদ দেবতা সীয়াউস মৃত্যুর পরের কালো পৃথিবীতে যেতে বাধ্য হয়েছেন বলে সেই কালো রংয়ে মুখ কালো করতে হয় ‘হাজী পিরুজ’ সাজিয়েদের। ‘হাজী‘ শব্দটি বর্তমানে ভারত উপমহাদেশে বিশেষত: হজ বা তীর্থযাত্রা করে আসা ব্যক্তি বোঝালেও ইরাণে ‘হাজী‘ শব্দটির অর্থ বৃদ্ধ বা বয়সে বড়, প্রাজ্ঞ ও প্রবীণ ব্যক্তি। ‘পিরুজ’ শব্দটির অর্থ ‘বিজয়ী’ যদিও আরবরা ইরাণ দখল করার পর ‘পিরুজ’ শব্দটি খানিকটা বদলে গেছে। ‘ঈদ- ই নওরোজ’ বা ইরাণী নববর্ষ উদযাপনের সময় এই ‘হাজী পিরুজে’র ভূমিকায় অভিনয়কারীরা তাম্বুরিন হাতে রাস্তায় রাস্তায় নাচ-গান ও সবার সাথে হাস্য-পরিহাস করে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন