ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(২৮)
হায়দরাবাদে
পৌঁছে শ্রুতি ফোন করেছিল লিপিকাকেও,
“দারুণ
এক্সাইটিং ট্রিপ মাসিমণি, লাইফে ফার্স্ট-টাইম! একটা পি-জিতে টেম্পোরারি থাকার অ্যারেঞ্জ
করেছি। দেখা যাক।”
লিপিকা
ভালো-খারাপ কোনো মন্তব্য করেনি, যাদের মেয়ে তারা বুঝুক। শুধু-শুধু মায়ায় জড়িয়ে পড়ে
দোষের ভাগী হওয়া কেন? শোভন মামপির কথা জিজ্ঞেস করেছিল, সংক্ষেপে জানিয়ে দিয়েছে লিপিকা।
এই ক-মাসে মামপির আন্তরিকতায় ভিজে গেছে মানুষটা। বড্ড স্নেহশীল, বাবুলের পরে একটি মেয়ের
ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিল, লিপিকা চায়নি। বাবুলকে যত প্রশ্রয় দিয়েছে শোভন, শাসনের ভার ছিল
লিপিকার। পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে হাসে লিপিকা, লিভিংরুমে মাছের বাক্সের দিকে তাকিয়ে সলমনের
নড়াচড়া দেখে। কত পথ পেরিয়ে আসা, কতবার কত কারণে ভেঙে গিয়েও সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা।
সন্ধে উৎরে গেছে, শাঁখের আওয়াজ ভেসে আসছে। হয়ত পুজো করছে কেউ, বা এমনিই। মা-র কথা মনে পড়ে, বিয়ের আগে পাড়ার প্রায় সব বাড়ি থেকে শঙ্খধ্বনি শোনা যেত। তারা চার ভাইবোন তখন বই খুলে পড়তে বসত। দেবিকার মন বসত না, উঠে যেত বারবার, পুজো শেষ হল কিনা উঁকিঝুঁকি দিত। পুজোয় বসলে গায়ত্রী বকাবকি করতেন না। বারের পুজো থাকলে সুর করে পাঁচালি পড়তেন, বাড়িময় ফুল-ফল-ধূপের গন্ধ। পুজো শেষ করে উঠে এসে মাথায় ফুল ছুঁয়ে আলগা করে প্রসাদের ফল দিতেন তাদের হাতে।
কোনো বাড়ি থেকে রাতের রান্নার মুসুরডাল ফোঁড়নের বা শুঁটকিমাছের তরকারি রাঁধার গন্ধ। ঊষাজ্যাঠাইমা সদরে এসে ডাকছেন,
“অ
গাইত্রি, শুটকীর বাটিখান রাখ, লিপিডা ত শুটকীর লাইগ্যা মরে। অরে দিস অ’ নে। আমার দেওর
আইন্যা কয়, বউদি রানধেন, তা—“.
কবে
থেকে শুঁটকিমাছের গন্ধে লিপিকার গা গুলোয়। কোন জন্মের কথা যেন, কেমন অবাস্তব লাগে।
মনে পড়লে গা শিরশির করে, পুরনো গলিপথে মন হারিয়ে যায়। সচেতন হয়ে ঝাঁকুনি দিয়ে সে সোজা
হয়ে বসে।
একপাশে
সোফায় বসে তন্ময় হয়ে আঁকছে শোভন, কী অনুভব করে লিপিকার দিকে তাকায়, নাক টেনে বলে,
“মুসুর
ডাল বানিয়েছ নাকি? ভালো গন্ধ।”
লিপিকা
অবাকভাবে হেসে মাথা নাড়ে, না। শোভন খাতায় মন দেয়, চব্বিশ-শেডের অয়েল প্যাস্টেলের বাক্স
কিনে এনেছে লিপিকা। স্কেচ করে রঙ দিলে ভরাট হয় ঝটপট, এরই মধ্যে খানদুই ছবি আঁকা হয়েছে।
দুয়েকটা রঙের ঘষা দিয়ে সামান্য উত্তেজিতভাবে খাতা বাড়িয়ে দেয় লিপিকার দিকে।
উঠোনের বেড়া ঘেঁষে চৌবাচ্চা, মস্ত বেলগাছ ছায়া ফেলেছে তার জলে। বাইরে বড় জামরুলগাছ ছাতা ধরেছে, ওই ছায়া মিশে আছে এই ছায়ায়। লিপিকা খুব খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখে—চৌবাচ্চার পাড়ে উবু হয়ে বসা এক মহিলার আদল, পাশে দাঁড়িয়ে আর একজন।
শোভনের মা-কে খুব বেশীদিন পায়নি লিপিকা। চাকরীসূত্রে অন্যত্র থাকত বলে বছরে দু-তিনবারের বেশী দেখাশোনা হত না। ভীতু আর সাবধানী মানুষ ছিলেন, আরশোলা, টিকটিকি, বিছে, ইঁদুর, বাদুড় ইত্যাদি ভারী অপছন্দ ছিল। কুঁয়োপাড়ে সাপ দেখার গল্পটি বিস্তারিতভাবে তাদের প্রায়ই বলতেন।
কাজের
লোক হরিমতী আছাড় মেরে-মেরে কাপড় কাচছে, উনি ঠাকুরের ফুল তুলছিলেন —
পেছনের
উঠোনে টগর, যুঁই, গন্ধরাজের ঝোপ ছিল, অজস্র ফুল হত। কী বলবেন ভেবে মাথা ঘুরিয়ে দেখেন
হরিমতীর ঠিক পেছনে লেজে পাকিয়ে বিরাট সাপ —
ওঁর
বক্তব্য অনুযায়ী ‘জাত-সাপ’! চীৎকার করে উঠেছিলেন। তাঁর চীৎকারে প্রায় কিছু না ভেবে
চোখের নিমেষে পেছন ফিরে হরিমতী কাপড়সুদ্ধু ভারী লোহার বালতি সাপটাকে লক্ষ করে ছুঁড়ে
মেরেছিল, তারপর তাঁকে টেনে সরিয়ে নিয়েছিল। দু-জনে প্রায় জড়াজড়ি অবস্থায় হুড়মুড়িয়ে বারান্দার
সিঁড়িতে, চোখের সামনে দিয়ে সরসর করে মস্ত সাপটা বেরিয়ে গিয়েছিল বেড়ার পাশ দিয়ে।
গল্পটা
বলার সময়ে উনি শিউরে উঠতেন অতবছর পরেও। পান খেতেন সারাদিন ধরে, মুখ ভরা থাকত পানে।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই পান-সুপুরি-খয়ের মেশানো গন্ধ, অস্বস্তি লাগত লিপিকার।
সেই
ছবিখানা এঁকেছে শোভন? বেড়ার ঘন সবুজে ছোট্ট ছোট্ট সাদা ফুটকী দিয়েছে ফুলের। লিপিকা
ছবি থেকে চোখ তুলে দেখে শোভন তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“মা
প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল। একটু পরে আমরা দু-ভাই ইস্কুল থেকে ফিরে দেখি মা-র জ্বর এসেছে,
ঠাকুমা মাথায় জল ঢালছে”।
“আমিও
শুনেছি তোমার মা-র কাছেই। এত ভয় পেয়েছিলেন?”
“সাপটা
আঁকিনি, আঁকব?”
কী
জবাব দেবে ভেবে পায় না লিপিকা। শোভন আবার ধীরে-ধীরে খাতার ওপরে ঝুঁকে পড়ে, প্রায় সাথে-সাথে
লিপিকার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে,
“ঠাকুমার
ভীষণ পানের নেশা ছিল, মা-রও ঐ অভ্যেস হয়েছিল”।
চোখ
বুজে সোফার পেছনে আলতো করে মাথা হেলিয়ে দিয়েছিল লিপিকা, শিউরে ওঠে। টেলিপ্যাথি? শোভনের
ঠোঁটে আলতো হাসি, সে ছবিতে মগ্ন।
“হ্যালো, হু-জ্ দেয়ার?”
ক্লান্ত
অনিচ্ছুক গলায় হর্ষ বলে, বিশ্রাম নিচ্ছিল। প্রচণ্ড কাজের চাপ পড়ছে প্রমোশন হওয়ার পরে।
আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো—সময় পাচ্ছে না। মা-বাবাকে ফোন করা অনিয়মিত,
করলেও দু-একটা কথা, ব্যস। মা অবশ্য কোনো অনুযোগ দেয় না, বোঝে। আর দু-এক জায়গায় চেষ্টা
করবে ভাবছে, গুছিয়ে বায়োডেটা রেডি করতে আলসেমি, সময়েরও অভাব। অফিসের কাছাকাছি গ্রেটার
নয়ডা বা গুরগাঁওতে অঞ্চলে ফ্ল্যাট নিলে সাময়িকভাবে যাতায়াতের ঝামেলা কমে। কিছু স্থির
করে উঠতে পারছে না হর্ষ, আলোচনা করে পরামর্শ দেওয়ার মতো ভরসাযোগ্য কারো নাম মনে পড়ে
না। মা-র সঙ্গে এসব আলোচনা মানে মাকে আরো চাপে ফেলা, এমনিতে সে মাকে কোনো সাহায্যই
করতে পারে না। তাছাড়া আরেকটা খচখচ মাথার মধ্যে, শিখাকে ফোন করবে ভেবে করতে পারেনি।
শিখাও আর যোগাযোগ করে না। একদিন স্বপ্নে দেখেছে বিয়ের সাজে অদিতি সাজানো গাড়িতে উঠছে,
পেছনে দীর্ঘকায় স্বাস্থ্যবান শেরওয়ানি-পরা অচেনা যুবক—দুজনের কারো
মুখ স্পষ্ট নয়। কষ্ট হচ্ছিল হর্ষর।
ফোনের
ওপাশ থেকে শব্দ নেই, নম্বরও চেনা নয়। পলকের জন্য মনে হয় নিশ্চিত অদিতি—
এ-নম্বর
তাকে দেয়নি। দ্বিধাগ্রস্তভাবে প্রায় অস্ফুটে বলে,
“বাত
নহীঁ করোগী অদিতি? ইয়ে নম্বর তুম মুঝে নহীঁ দী কিঁউ?”
“বা-বু-ল—আমি মামপি”।
অপ্রস্তুতে
পড়ে হর্ষ, নীরব হয়ে থাকে। শ্রুতিও চুপ করে থাকে, শুধু নম্বর দুটো সজাগ। মিনিট দু-তিন
পরে বলে,
“আসার
সময়ে মাসিমণি আপত্তি না করে নম্বরটা দিল—কী জানি কেন?
দূরে চলে গেলাম বলেই হয়ত”।
“দূরে
মানে? কলকাতায় নেই?”
“আমি
হায়দরাবাদে রে — মাসখানেক হল
জয়েন করেছি। তুই জানিস না?”
“আরেব্বাস!
গ্রেট নিউজ! কংগ্রাটস্—
“তুই
জানতিস না সত্যি?”
“আর
কী বলবো, উইকে দু-একদিন মাকে ফোন করি জাস্ট—অফিসে টু মাচ্
প্রেশার রে”।
“হুঁ
বড়ো কম্পানি, মোটা স্যালারিও নিশ্চয়ই, থাকবে না প্রেশার?”
ছোটো
একটা সম্মতিসূচক ‘হুঁ’ দিয়ে চুপ করে যায় হর্ষ, বলার কিছু খুঁজে পায় না। শ্রুতি বলে,
“স্যরি
টু ইন্ট্রুড ইন ইওর স্পেস— অদিতি কে? তোর
গার্লফ্রেণ্ড?”
হর্ষ
চমকায়, চুপ করে থাকে। শ্রুতি খুচখাচ কথা বলে যায়, হর্ষ খালি শোনে। কিছু পরে হতাশ হয়ে
সে বলে,
“সরি
রে বাবুল, তুই অনেক বদলে গেছিস, অনেক ম্যাচিওর, মনে হয় ক্যালকুলেটিভও। আমার অনেক কথা ছিল, তোকে বলতে ইচ্ছে
করছিল—বাট্—থাক!”
“পরে
একদিন শুনবো। আর অদিতির কথা মাকে জানাস না। বাই!”
(ক্রমশঃ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন